গ্রেফতার আতঙ্ক বিএনপিতে : গাঢাকা দিচ্ছেন নেতাকর্মীরা

স্টাফ রিপোর্টার: আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়কে কেন্দ্র করে বিএনপিতে অস্থিরতা ও মারমুখি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় কঠোর হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত মঙ্গলবার হাইকোর্টের সামনে পুলিশের ওপর আক্রমণ ও প্রিজনভ্যান ভাঙচুর করে তিন নেতাকে ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনার পর গতকাল বুধবারও পুলিশের সাথে একই স্থানে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়েছে বিএনপি নেতা-কর্মীদের। পুলিশের ওপর হামলার ঘটনার পর থেকে হঠাৎ তীব্র চাপের মুখে পড়েছে দলটি। গ্রেফতার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে নেতাদের মধ্যে। গত দু’দিনে গ্রেফতার হয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, বিএনপির তথ্য বিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, সহসাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও জাতীয়তাবাদী মহিলা দল ঢাকা মহানগরীর সভাপতি রাজিয়া আলিম, ছাত্রদল কেন্দ্রীয় কমিটির সহগণসংযোগ বিষয়ক সম্পাদক আমজাদ হোসেন শাহাদাত, যুবদল কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক আব্দুল জাব্বারসহ শতাধিক নেতাকর্মী।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেফতারের জন্য অর্ধশতাধিক নেতাকর্মীর বাসায় অভিযান চালিয়েছে। ইতোমধ্যে পুলিশের ওপর হামলা, অস্ত্র ভাঙচুর, আসামি ছিনতাই, রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতিসাধন ও আইনশৃঙ্খলায় বিঘ্ন ঘটানোর অভিযোগ এনে পুলিশ বাদি হয়ে শাহবাগ থানায় দুইটি ও রমনা থানায় দুইটি মামলা করেছে। চার মামলায় আসামি করা হয়েছে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ ৮ থেকে ৯শ নেতাকর্মীকে। রমনা থানার মামলায় গয়েশ্বর ও মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ শীর্ষ ৪৪ বিএনপি নেতার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে শাহবাগ থানায় দুইটি মামলায় রিজভীসহ শীর্ষ নেতাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের  মধ্যে বিভিন্ন মেয়াদে ৫৩ জনকে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। আর কারাগারে পাঠানো হয়েছে গয়েশ্বর রায়কে।

পুলিশ জানিয়েছে,হামলার ভিডিও ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্যের ভিত্তিতে গ্রেফতার চলছে। যারা জড়িত তারা কেউ রেহাই পাবে না। এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া গতকাল বলেছেন, পুলিশের গাড়িতে হামলা-ভাঙচুর ছিলো পরিকল্পিত। এদিকে মঙ্গলবার রাতে গয়েশ্বর রায় গ্রেফতার হওয়ার পর বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তারা নিজেদের বাসা-বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেন। এর রেশ পড়ে গতকাল বুধবারও। আদালতে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার হাজিরাকে কেন্দ্র করে অন্য সময় নেতাকর্মীরা শোডাউন করলেও গতকাল এর মাত্রা ছিলো অনেকটাই কম। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেছেন,মঙ্গলবার রাতে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারের বাসভবনে পুলিশ হানা দেয়। এছাড়া বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান, ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী, যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সভাপতি হাবিব উন নবী খান সোহেল, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবু, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আহসান উল্লাহ হাসান, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও আইনজীবী রফিক সিকদার, সাবেরা আলাউদ্দিন, যুবদল কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক যুগ্মসাধারণ সম্পাদক কাজী আজিজুল হাকিম আরজুর বাসাসহ শতাধিক বিএনপি নেতাকর্মীর বাসায় পুলিশ তল্লাশির নামে ব্যাপক তাণ্ডব চালায়। এছাড়া রুহুল কবির রিজভী গতকাল রাতে জানিয়েছেন, দলের আরও ৮ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আদালতে হাজিরা দিয়ে ফেরার পথে হাইকোর্টের সামনে পুলিশের গাড়িতে হামলা, ভাঙচুরের ঘটনা ছিলো পূর্বপরিকল্পিত। প্রশিক্ষিত একদল দাঙ্গাবাজ দিয়ে এ হামলা চালানো হয়। আর এ হামলার পরিকল্পনার ছক তৈরি করা হয় কয়েকদিন আগেই। সে কারণে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে থেকে আগেই জড়ো করা হয়েছিলো প্রশিক্ষিত দাঙ্গাবাজদের। ঘটনার দিন পুলিশের হাতে আটক হওয়া কয়েকজন পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এ তথ্য জানিয়েছে বলে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মহানগর পুলিশের এক শীর্ষকর্তা। মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) দেবদাস ভট্টাচার্য বলেন, হামলার ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত। ভিডিও ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে হামলাকারীদের গ্রেফতারে অভিযান শুরু হয়েছে। তবে মামলার তদন্তের স্বার্থে হামলার নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিদের নাম বলতে তিনি অস্বীকৃতি জানান।

ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, হামলার পর পুলিশ ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে। কারণ হামলাকারীরা চাইছিলো পুলিশ কঠোর অ্যাকশনে যাবে। আর ওই অ্যাকশনের মধ্যে বিএনপি একটি ইস্যু তৈরি করার চেষ্টা করবে। তিনি বলেন, হামলাকারীরা সবাই প্রশিক্ষিত। কারণ পুলিশের ওপর হামলার ধরন দেখেই তা অনুমান করা যায়। পাশাপাশি গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে বেশ কয়েকজন পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্যই দিয়েছে। পুলিশের এ কর্মকর্তা আরও বলেন,২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের ওপর যে ধরনের হামলা হয়েছে তার প্রত্যেকটির সঙ্গে এ হামলার মিল রয়েছে। তিনি বলেন, হামলার নেপথ্য পরিকল্পনাকারীদের শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের গ্রেফতার করা গেলে পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে।

বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের জামিন আবেদন না-মঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানো নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল বুধবার বিকেলে ঢাকা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মাহমুদুল ইসলাম জামিন আবেদন না-মঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানো নির্দেশ দেন। গত মঙ্গলবার  রাতে গুলশান-১ পুলিশ প্লাজার সামনে থেকে গয়েশ্বরকে আটক করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। পরে গতকাল দুপুরে তাকে আদালতে পাঠানো হয়।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল রাতে এক বিবৃতিতে নেতাকর্মীদেরকে অব্যাহত গতিতে গ্রেফতারের পাশাপাশি বাড়িতে বাড়িতে হামলা ও তল্লাশির ঘটনাকে সরকারের এক ভয়ঙ্কর জুলুম হিসেবে চিহ্নিত করে গভীর উদ্বেগের সাথে বলেন,‘ভবিষ্যত দুরভিসন্ধিমূলক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে জাতীয়তাবাদী শক্তিকে বিরাট বাধা হিসেবে গণ্য করে সরকার বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর নিষ্ঠুর নিপীড়ন ও অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি করেছে। আজিজুল বারী হেলালের ন্যায় দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় নেতাকে বাসা থেকে উঠিয়ে নেয়ার পরও তাকে গ্রেফতারের বিষয়ে পুলিশের অস্বীকৃতি জানানো অত্যন্ত আতঙ্কজনক। আমি এই ন্যক্কারজনক ও অমানবিক ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ এবং অবিলম্বে তার অবস্থান সর্বসম্মুখে অবহিত করে মুক্তির জোর দাবি জানাচ্ছি।