গাংনীতে পুলিশ কনস্টেবল হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দুটি মামলা দায়ের : তদন্ত কমিটি

 

গাংনী প্রতিনিধি: মেহেরপুর গাংনী উপজেলার পীরতলা পুলিশ ক্যাম্পের কনস্টেবল আলা উদ্দীন হত্যাকাণ্ডের আলোচিত ঘটনায় গতকাল রোববার গাংনী থানায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলা দুটি তদন্তের পাশাপাশি ঘটনার সময় এএসআই সুবিরের পেশাগত দায়িত্বে কোনো গাফলতি কিংবা অপরাধ ছিলো কি-না তা তদন্ত করছে একটি তদন্ত কমিটি। অপরদিকে জীবনবাজি রেখে পেশাগত দায়িত্ব পালনকারী আলা উদ্দীনের জন্য খেতাব প্রস্তাব ও পরিবারকে অর্থ সহায়তা দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

গাংনী থানার ওসি আকরাম হোসেন জানান, কনস্টেবল আলা উদ্দীন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় হত্যা মামলা ও মাদকের বিষয়ে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে আরেকটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার বাদী হয়েছেন পীরতলা পুলিশ ক্যাম্প ইনচার্জ সহকারী এএসআই সুবির। মামলা দুটি তদন্ত করছেন গাংনী থানার ওসি (তদন্ত) মোক্তার হোসেন। আটকৃত মাইক্রোবাসচালক কুষ্টিয়ার মিরপুরের বরইপাড়ার কালু মণ্ডলের ছেলে আনিছকে প্রধান আসামি করে অজ্ঞাতনামা আরো কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে। মামলা তদন্ত ও আসামি গ্রেফতারের স্বার্থে আসামিদের নাম পরিচয় গোপন করেন তিনি। ঘটনার সাথে জড়িতদের দ্রুত পুলিশ গ্রেফতার করতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

এদিকে আলা উদ্দীন হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি এলাকায় বেশ আলোচিত। গত দু দিন আলোচনার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু ছিলো হত্যাকাণ্ড ও এর আগে পরের কিছু বিষয়। মাইক্রোবাস আটক অভিযানের নেতৃত্বদানকারী পীরতলা পুলিশ ক্যাম্প ইনচার্জ এএসআই সুবিরের ভূমিকা নিয়েও এলাকার মানুষের মাঝে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। স্থানীয়রা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছেন, শাদা একটি মাইক্রোবাস প্রায়ই এলাকা দিয়ে যাওয়া আসা ছিলো। তাদের ধারণা ছিলো মাদক কিংবা অস্ত্রের চালান যেতো মাইক্রোতে। গভীর রাতের পাশাপাশি দিনের বেলাতেও পাচার করা হতো বলে এলাকায় গুঞ্জন রয়েছে। তাছাড়া সাহেবনগর-তালতলা এলাকা সীমান্তবর্তী এবং মাঝে মধ্যেই সেখানে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটে। বেশ কিছু দিন সেখানে তেমন কোনো অপরাধ সংঘঠিত না হলেও জায়গাটি সম্পর্কে এলাকার মানুষের দীর্ঘদিনের ভীতি ছিলো। এরকম একটি জায়গায় অভিযান চালানোর সময় এসআই সুবিরের দক্ষতা, সক্ষমতা ও দূরদর্শিতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন এলাকার মানুষ। তাছাড়া সুবিরের বিরুদ্ধে মাদকব্যবসায়ীদের সাথে আঁতাতেরও গুঞ্জন রয়েছে এলাকাজুড়ে।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, সম্প্রতি সময়ে কিছু মাদকদ্রব্য উদ্ধার ও মাদকসহ মাদকসেবীদের গ্রেফতারের পর আলোচনায় আসে এএসআই সুবিরের নাম। উদ্ধার ও আটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোনো মাদকব্যবসায়ীর নাম না থাকায় এলাকার মানুষের মাঝে হতাশাসহ মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কয়েক পুরিয়া গাঁজা হেরোইন উদ্ধার ও মাদকসেবী গ্রেফতার অভিযান মাদক নিয়ন্ত্রণে কতোটুকু ফলপ্রসূ তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। আলোচিত ও শীর্ষ তেমন কোনো মাদকব্যবসায়ী গ্রেফতার না হওয়া এবং মাদকের বড় চালান আটক না হলে এমন সমালোচনার মুখে পড়েন এএসআই সুবির। শীর্ষ মাদকব্যবসায়ীদের বাদ রেখে মাদকসেবীদের গ্রেফতারের ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেন এলাকার সচেতনমহল।

এদিকে মাইক্রোবাসটি আটক করতে বীরত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন কনস্টেবল আলা উদ্দীন। কিন্তু আগ্নেয়াস্ত্র থাকা সত্ত্বেও আলা উদ্দীনকে রক্ষা এবং মাইক্রোবাস থামাতে এএসআই সুবির কেন গুলি ছুড়লেন না, তা নিয়েও এলাকার মানুষের মাঝে উত্তর না জানা অসংখ্য প্রশ্ন রয়েছে। তবে এসব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর খুঁজতে মেহেরপুর পুলিশ সুপারের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। মেহেরপুর সহকারী পুলিশ সুপার (সার্কেল) মোস্তাফিজুর রহমানকে প্রধান করে গঠিত তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটিকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন মেহেরপুর পুলিশ সুপার হামিদুল আলম। তিনি গতকাল দৈনিক মাথাভাঙ্গা বলেন, অভিযানের সময় এএসআই সুবিরের দায়িত্বে অবহেলা ও কোনো প্রকার দুর্বলতা ছিলো কি-না তা তদন্ত প্রতিবেদন পেলেই পরিষ্কার হবে। তদন্তে সুবিরের বিরুদ্ধে পেশাগত দায়িত্ব পালনে গাফলতি ও দুর্বলতা প্রমাণ হলে অবশ্যই বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

কনস্টেবল আলা উদ্দীনের মৃত্যুতে পুলিশ বিভাগের পাশাপাশি গোটা এলাকার মানুষের মাঝেই শোক বিরাজ করছে। মাদকের মতো একটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জীবন বলি দেয়া আলা উদ্দীনকে বীর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এলাকার মানুষ। তাইতো আলা উদ্দীন ও তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করতে ভোলেননি তারা। এলাকার মানুষের সহানুভূতি প্রকাশের পাশাপাশি নিহতের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে পুলিশ বিভাগ। প্রাপ্য অর্থ সহযোগিতা ও রাষ্ট্রীয় খেতাবের সুপারিশের কথাও ভাবছে মেহেরপুর জেলা পুলিশ।

মেহেরপুর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আহমার উজ্জামান জানান, আলা উদ্দীনের আত্মার মাগফেরতা কামনায় দোয়া মাহফিলের জন্য পুলিশ সুপারের পক্ষ থেকে পরিবারকে ১৫ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। জেলা পুলিশের কল্যাণ তহবিল, পুলিশ সুপারের ব্যক্তিগত তরফ ও গাংনী থানার পক্ষ থেকে অর্থ সহযোগিতা প্রদানের কথা বলেছেন পুলিশ সুপার। পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় নিহত হওয়ায় সরকারি তহবিল থেকে আলা উদ্দীনের পরিবার পাচ্ছেন ৫ লাখ টাকা। তাছাড়া তার জিপিএফ ফান্ডের টাকাও পাবে পরিবার। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত তহবিলেও সহযোগিতার জন্য আবেদন করা যাবে। অর্থ সহযোগিতার পাশাপাশি আলা উদ্দীনকে স্মরণীয় ও যথাযথ মর্যাদা দিতে পুলিশের সর্বোচ্চ খেতাব বাংলাদেশ পুলিশ পদক ও প্রেসিডেন্ট পুলিশ পদকের (মরণোত্তর) জন্য পুলিশ সুপারের পক্ষ থেকে সুপারিশ করা হবে।

উল্লেখ্য, গত শুক্রবার রাত পৌনে আটটার দিকে গাংনী উপজেলার সাহেবনগর নামক স্থানে সঙ্গীয় পুলিশ সদস্যদের সাথে একটি মাইক্রোবাস থামান কনস্টেবল আলা উদ্দীন। এ সময় মাইক্রোবাসের যাত্রীবেশী দুর্বৃত্তরা তাকে মাইক্রোবাসের মধ্যে তুলে নিয়ে আঘাত করে কিছু দূরে ফেলে সটকে পড়ে। রক্তাক্ত জখম অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত দশটার দিকে আলা উদ্দীনের মৃত্যু হয়। আলা উদ্দীনকে তুলে নেয়ার পর সম্ভাব্য বিপদের আশঙ্কায় মাইক্রোবাস থেকে দু বস্তা ফেনসিডিল সড়কের পাশে ফেলে দেয় মাইক্রোবাসের যাত্রীবেশী মাদকব্যবসায়ীরা।