গণিতে সৃজনশীল প্রশ্নের প্রভাবসহ রাজনৈতিক অস্থিরতা পাশের হার হ্রাস?

 

স্টাফ রিপোর্টার: এসএসসির ফলে বড় ধরনের ছন্দপতনে দেশ জুড়েই কিছু প্রশ্ন দানা বেধেছে। পাসের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা উভয়ই কমার কারণে কেন্দ্রভিত্তিক রেশারেশির বিষয়টি নিয়েও চুয়াডাঙ্গায় জোরদার আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে গণিতে সৃজনশীল প্রশ্নের কারণেও ফলাফল বিপর্যায়ের অন্যতম কারণ বলেও মন্তব্য শিক্ষানুরাগীদেরর অনেকের। একই সাথে পরীক্ষার সময় রাজনৈতিক অস্থিরতাকেও দায়ী করেছেন অভিজ্ঞ মহল।

জানা গেছে, ২০০৮ সালের পর এবারই প্রথম পাসের হার কমল। ২০০৯ সালে ২০০৮ সালের চেয়ে পাসের হার ৩ দশমিক ৪ শতাংশ কমেছিল। গত বছর ৮ শিক্ষাবোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষায় পাস করেছিল ৯২ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এবার এ হার কমেছে ৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ। এবার এসএসসিতে পাস করেছে ৮৭ দশমিক ৭২ শতাংশ। জিপিএ-৫ এর সংখ্যাও এবার কমেছে। গতবার এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১ লাখ ২২ হাজারের বেশি। এবার জিপিএ ৫ পেয়েছে ৯৩ হাজার ৬৩১ জন। চুয়াডাঙ্গাতেও এর ধারাবাহিকতা ছিলো অম্লান। এবার দুই সূচকে অবনতি শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের ভাবিয়ে তুলছে।

 

এবার পাসের হার কমে যাওয়ার কারণ হিসাবে সংশ্লিষ্টরা রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি দু’টি বিষয়ে সৃজনশীল প্রশ্নের আলোকে পরীক্ষা হওয়ার প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন। তবে আট বোর্ডে পাসের হার কমলেও মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাবোর্ডে পাসের হার ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। এবছর এসএসসিতে গণিত এবং উচ্চতর গণিত বিষয়ে সৃজনশীল প্রশ্নে পরীক্ষা হয়েছে। এছাড়া শারীরিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য বিজ্ঞান ও খেলাধুলা নামে একটি নতুন বিষয়ে সৃজনশীল প্রশ্নে পরীক্ষা হয়েছে।

চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি থেকে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বিএনপি জোটের হরতাল অবরোধের কারণে একটি পরীক্ষাও নির্ধারিত দিনে অনুষ্ঠিত হয়নি। ৬ ফেব্রুয়ারি শুরু করে হরতালে ১৬ দিনের পরীক্ষা পিছিয়ে যায়। এসব পরীক্ষা শুক্র ও শনিবার নেয়া হয়েছে। ৩০ মার্চ পরীক্ষা শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ৩ এপ্রিল পরীক্ষা শেষ হয়। হরতালের কারণে ব্যবহারিক পরীক্ষা পিছিয়ে ২৯ মার্চ থেকে ২ এপ্রিলের মধ্যে শেষ করা হয়। এ কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অস্থিরতা ছিল। হরতাল অবরোধের ভীতিও ছিল। শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদও পরীক্ষায় পাসের হার কমার কারণ হিসাবে প্রধানত রাজনৈতিক অস্থিরতাকে দায়ী করেছেন।

 

অন্যদিকে এসএসসির গণিতে প্রথমবারের মতো সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালু, শিক্ষকদের অপূর্ণাঙ্গ পাঠদান ও ছাত্র-ছাত্রীদের সৃজনশীল গণিতে দুর্বলতার কারণে ২০১৫ সালের এসএসসির ফল বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছিলেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে নবম শ্রেণিতে সৃজনশীল গণিতে পাঠদান শুরু হলেও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এ নিয়ে ভীতি বিরাজ করছে। এই ভীতির কারণে রাজধানীর নামিদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ চট্টগ্রাম ও বরিশালের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা গণিতে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি অন্তত দু’বছর পিছিয়ে দেয়ার দাবিতে মানববন্ধন, মৌন মিছিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে।

 

নবম শ্রেণির অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় দেখা গেছে, রাজধানীতে ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী গণিতে ফেল করে আর গ্রামাঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী গণিতে ফেল করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সংসদীয় কমিটি ২০১৫ সালের এসএসসি ও দাখিলে গণিত এবং উচ্চতর গণিত বিষয়ের সৃজনশীল প্রশ্নে পরীক্ষা গ্রহণের জন্য শিক্ষকদেরকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে সুপারিশ করে। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলেও তা পর্যাপ্ত ছিল না।  ফলে এর প্রভাব পড়ল এবারের এসএসসিতে।

 

এবার যশোর বোর্ডে পাসের হার ৮৪ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। গতবছর এ বোর্ডে পাসের হার ছিল ৯২ দশমিক ১৯ শতাংশ। গতবারের চেয়ে পাসের হার কমেছে ৮ দশমিক ১৭ শতাংশ। পাসের হার কমার কারণ হিসাবে বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাধব চন্দ্র রুদ্র বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি গণিতে সৃজনশীল প্রশ্নের প্রভাবও পড়েছে। এই বোর্ডে ইংরেজিতে ৯৭ দশমিক ৮৪, রসায়নে ৯৯ দশমিক ৫৫, পদার্থ বিজ্ঞানে ৯৯ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ পাস করলেও গণিতে পাস করেছে ৮৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এ কারণে সার্বিক পাসের হার অনেক কমেছে।

 

বরিশাল শিক্ষাবোর্ডে ১ হাজার ৩৪২টি স্কুলের ৭০ হাজার ৪৫৬ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে ৫৯ হাজার ৪৪৬ জন। গত বছর পাসের হার ছিল ৯০ দশমিক ৬৬ শতাংশ। ৬.২৯ ভাগ কমে এবার পাস করেছে  ৮৪.৩৭ ভাগ। এ বিষয়ে বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ শাহ্ আলমগীর জানান, গণিতে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা হওয়ায় ৯ দশমিক ৬ ভাগ পাসের হার কমেছে। আবার হরতাল অবরোধের কারণে শুক্র ও শনিবার পরীক্ষা নিতে হয়েছে। পরীক্ষার্থীদের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ও পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে পরীক্ষায় কিছুটা প্রভাব পড়েছে।

 

এছাড়া বরিশাল বোর্ডে এবছর ইংরেজিতে ৯৭ দশমিক ২৭, রসায়নে ৯৮ এবং পদার্থে ৯৮ দশমিক ১২ ভাগ পাস করে। অথচ এবছর গণিতে পাস করে ৮৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ। গত বছর গণিতে পাসের হার ছিল ৯৭ দশমিক ৫২ শতাংশ।

 

রাজশাহী বোর্ডেও এবার পাসের হার গত বছরের চেয়ে কমেছে। বোর্ডের সচিব অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ রাজনৈতিক অস্থিরতাকে দায়ী করেন।

 

চট্টগ্রাম বোর্ডে পাসের হার কমার পাশাপাশি জিপিএ ৫ প্রাপ্তদের সংখ্যাও ব্যাপক কমেছে। গতবার জিপিএ ৫ পেয়েছিল ১০ হাজার ৮৮৪ জন। এবার পেয়েছে ৭ হাজার ১১৬ জন। গতবার বিজ্ঞানে ৭৩৯১ জন জিপিএ ৫ পেয়েছিল। এবার পেয়েছে ৬৩৪২ জন। জিপিএ ৫ সবচেয়ে বেশি কমেছে ব্যবসা শিক্ষায়। এই বিভাগে গতবার ৩ হাজার ৩৭৭ জন জিপিএ ৫ ছিল। এবার পেয়েছে মাত্র ৭৫৭ জন। মানবিকে গতবার ১১৬ জন পেয়েছিল। এবার পেয়েছে মাত্র ১৭ জন। পাসের হার ১০০ ভাগ এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা গতবার ছিল ৯১টি। এবার কমে হয়েছে ৪০টি।

 

ফলাফল খারাপ হওয়ার কারণ হিসেবে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. মাহবুব হাসান বলেন, এবার এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে। দেশের অস্থির পরিস্থিতির কারণে পরীক্ষার্থীরা উদ্বেগ, উত্কণ্ঠা ও ভয় নিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে। স্বাভাবিকভাবেই এটা পরীক্ষার ফলাফলে প্রভাব ফেলেছে।

 

দিনাজপুর বোর্ডের সচিব আমিনুল ইসলাম তালুকদার বলেন, এবছর গণিতে ১২ থেকে ১৮ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে।

 

কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ইন্দু ভূষণ ভৌমিক বলেন, গণিত বিষয়ে সৃজনশীল পরীক্ষা। প্রথমবারের মতো হওয়ায় হয়তো পরীক্ষার্থীরা আশানুরূপ ফলাফল করতে পারেনি। এছাড়া হরতাল-অবরোধসহ নাশকতার আতংকে শুক্র ও শনিবার পরীক্ষা নিতে হয়েছে। পর পর দুইদিনের পরীক্ষার মাঝে বিরতি না থাকায় পরীক্ষার্থীদের প্রস্তুতির ক্ষেত্রেও সমস্যা হতে পারে।