খুলনার জনসভায় বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া

শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন প্রতিহত করা হবে

 

স্টাফ রিপোর্টার: শেখ হাসিনার অধীনে নিবাচন বর্জনই নয়, প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছেন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না, হতে দেয়া হবে না। সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন- এখনও সময় আছে, ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত আপনাদের সময় আছে। এর মধ্যে সংসদে নির্দলীয় সরকার বিল এনে পাস করে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করুন। নইলে আমরা আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি দেব।

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সরকারকে আগামী ২৫ অক্টোবরের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নেয়ার চূড়ান্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় সমাবেশ শেষে নতুন কর্মসূচি দেবো। সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, দাবি না মানলে সংঘাতের জন্য প্রস্তুত থাকুন। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। বেগম জিয়া বলেন, বিদ্যুতকেন্দ্র আমরা চাই, তবে রামপালে করা যাবে না। করতে দেয়া হবে না। তেল-গ্যাস-বিদ্যুত-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটিকে বলবো, আমরা আপনাদের পাশে আছি।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে চূড়ান্ত আন্দোলনের প্রস্তুতি হিসাবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল সফরের শেষ দিনে গতকাল রোববার বিকেলে খুলনায় সার্কিট হাউস মাঠে এক বিশাল জনসভায় খালেদা জিয়া এসব কথা বলেন। বৃষ্টি কাদা উপেক্ষা করে সমাবেশে এমন বড় জমায়েত হওয়ায় খুলনাবাসীকে অভিনন্দন জানিয়ে বেগম খালেদা জিয়া বলেন, আপনারা সরকারকে হলুদ কার্ড দেখিয়েছেন মেয়র নির্বাচন করে। এখন তারা ভয়ে একলা নির্বাচন করতে চায়। শিল্পনগরী খুলনাকে ধ্বংসের জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করে খালেদা জিয়া বলেন, এ শহরের পুরনো গৌরব ফিরিয়ে আনতে হবে। বন্ধ কলকারখানা আমরা চালু করবো। বেগম জিয়া বলেন, তাদের দুর্নীতির কারণে আজ পদ্মা সেতু হলো না। ১৮ দল ক্ষমতায় এলে দুটি পদ্মা সেতু হবে।

খালেদা জিয়া বলেন, ১৯৯৬-২০০১ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে শেয়ার মার্কেটের টাকা লুট হলো। এবার ৩৩ লাখ পরিবার নিঃস্ব হয়েছে। তিনি বলেন, পাঁচটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেছে। বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, মানুষ এ সরকারের হাতে জিম্মি। ইলিয়াস আলীকে তারা গুম করেছে। কোনো পেশার মানুষই আজ নিরাপদ নয়। খালেদা জিয়া বলেন, সরকারের অনুমতি নিয়েই হেফাজতে ইসলাম ঢাকায় প্রতিবাদ জানাতে এসেছিলো। তাদের হাতে কোনো অস্ত্র ছিলো না। রাতের অন্ধকারে লাইট বন্ধ করে দিগন্ত টিভি, ইসলামী টিভি বন্ধ করে বহু আলেমকে হত্যা করা হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত হয়নি। বিচার হয়নি।

খালেদা জিয়া বলেন, এ সরকারের আমলে ১৮ সাংবাদিক নিহত হয়েছে। সাগর-রুনী হত্যার বিচার আজও হয়নি। তিনি বলেন, পাপ চিরদিন চাপা থাকে না। সব তথ্য আমাদের হাতে রয়েছে। আমরা সময় মতো এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেব। রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্রের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান প্রকাশ করে খালেদা জিয়া বলেন, রামপালের মতো জায়গায় বিদ্যুত কেন্দ্র করতে দেয়া হবে না। সুইটেবল জায়গায় এটি করতে হবে। বিদ্যুতকেন্দ্র হলে সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে। তিনি রামপাল বিদ্যুত প্রকল্প বাতিলের দাবিতে চলমান আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানান।

নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে খালেদা জিয়া বলেন, এ সরকার কাউকে সম্মান দিতে জানে না। গ্রামীণ ব্যাংক ড. ইউনূসের কাছে ফিরিয়ে দেয়া উচিত। গ্রামীণ ব্যাংক ধ্বংস হতে দেয়া যাবে না। খালেদা জিয়া বলেন, তত্ত্বাবধায়কের দাবিটি কার ছিলো? এই আওয়ামী লীগের। ৯৪, ৯৫, ৯৬ সালে তারা ১৭৩ দিন হরতাল করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আমরাই দিয়েছি। তারা কখনো, আবার আমরা কখনো জিতেছি। তারা বলেছিলো, তাদের আন্দোলনের ফসল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্তু এখন কেন সে ফসল সরানো হচ্ছে। তিনি বলেন, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে।

খালেদা জিয়া বলেন, এ সরকার বিচার বিভাগকে দলীয়করণ করেছে। সকল স্থানে তারা দলীয়করণ করেছে। তাই কি করে এ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে? তিনি বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন অথর্ব, অযোগ্য, মেরুদণ্ডহীন। এই নির্বাচন কমিশন দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। খালেদা জিয়া বলেন, আমরা হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাব না। তাদের নির্বাচন করতেও দেয়া হবে না। আমরা নির্বাচন প্রতিহত করব ইনশাল্লাহ।

তিনি বলেন, ২৫ অক্টোবর এ সরকারের বিদায় নেয়া উচিত। এখনও সংসদ আছে। শেখ হাসিনাকে বলতে চাই, বিল পাস করে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করুন। জনতার রোষ সামলাতে পারবেন না। দেশের মানুষ জেগে উঠেছে। খালেদা জিয়া বলেন, আমরা নতুন ধারার রাজনীতি করবো। সময়মতো এই নতুন ধারার রাজনীতি সম্পর্কে জানানো হবে।

খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম মঞ্জু্র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় বক্তৃতা করেন খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা অধ্যক্ষ মো. ইসাহাক, ইসলামী ঐক্যজোটের আবদুল লতিফ, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, বিভাগীয় জনসভার প্রধান সমন্বয়কারী সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলাম, সাবেক মন্ত্রী বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক মন্ত্রী ড. আব্দুল মঈন খান, জামায়াতের সংসদ সদস্য আ ন ম সামসুল ইসলাম, জাগপার সভাপতি শফিউল আলম প্রধান, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা, জামায়াতে ইসলামীর অধ্যক্ষ মো. ইজ্জত উল্লাহ, এলডিপির মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ, জমিয়তে ইসলামের মাওলানা শাহীন পাশা, জামায়াতে ইসলামীর ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, ইসলামী পার্টির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আব্দুল মমিন, বিএনপির এম নূরুল ইসলাম দাদু, অধ্যাপক মাজিদুল ইসলাম, কৃষকদলের সভাপতি শামসুজ্জামান দুদু, জামায়াতে ইসলামীর আমিনুর ইসলাম, মোহাদ্দীস আব্দুল খালেক, বিএনপির আমান উল্লাহ আমান, রাজশাহীর সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু, যুবদলের বরকত উল্লাহ বুলু, ব্যারিস্টার মাহমুদ উদ্দিন রোকন, সাবেক হুইপ মশিউর রহমান, শাহ কামাল তাজ, অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি অ্যাডভোকেট হাবিবুন্নবী খান সোহেল প্রমুখ।

অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন খুলনা সিটি মেয়র মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনি, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শফিকুল আলম মনা ও খুলনা মহানগর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ফখরুল আলম।

যশোরে খালেদা জিয়া যা বললেন: গতকাল বেলা পৌনে ১২টায় যশোর সার্কিট হাউজে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সাথে মতবিনিময়কালে বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, দেশ ও মানুষকে বাঁচাতে আগে শেখ হাসিনা সরকারকে হঁটাতে হবে। তার আগে কোনো নির্বাচন নয়।

তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর মতো রাশিয়া থেকে অস্ত্র কেনা এবং রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রে সরকার দুর্নীতি করেছে। খালেদা জিয়া বলেন, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া আমরা নির্বাচনে যাব না। বর্তমান সরকারের দুর্নীতির বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও তাদের লোকজন অপপ্রচার চালিয়েছিলো। কিন্তু এবার তারা বহুগুণ বেশি দুর্নীতি করেছে। খালেদা জিয়া বলেন, সরকারের এ দুর্নীতি দেখছে না দুদক। কারণ তাদের দলীয় লোকদেরকেই দুদকে বসিয়ে দেয়া হয়েছে।

দলীয়করণের অভিযোগ করে খালেদা জিয়া বলেন, সরকার দলীয়করণ করতে করতে প্রশাসন, পুলিশ, সেনাবাহিনী ও বিডিআর (বিজিবি) সর্বক্ষেত্রে দলীয়করণ করা হয়েছে। খালেদা জিয়া বলেন, ২০০৮ সালে গণতন্ত্রের স্বার্থে আমরা নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। জনগণ দেখেছে সে নির্বাচনে কি ধরনের কারচুপি হয়েছে।

খালেদা জিয়া বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আদালত যে রায় দিয়েছে তাতেও দু’বার তত্ত্বাবধায়ক থাকে। তারা আজীবন ক্ষমতায় থাকতে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি বাতিল করেছে। দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেন, ঐক্যই শক্তি। আমরা কে কি পেলাম সেটা বড় বিষয় নয়। দেশকে কি দিলাম সেটাই বড়। এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগের হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে হবে। পরে নির্বাচন। কাকে মনোনয়ন দেয়া হবে সেটা বসে ঠিক করা হবে। দল যাকে মনোনয়ন দেবে তার পক্ষে কাজ করতে হবে।

দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলামের প্রশংসা করে বিরোধী দলীয় নেতা বলেন, তরিকুল ইসলামকে কেবল যশোরের নয় গোটা দক্ষিণাঞ্চলের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এরপর দুপুর ১২টায় খুলনার উদ্দেশে রওনা দিয়ে বেলা ২টার পর তিনি খুলনা সার্কিট হাউজে পৌঁছেন। খুলনায় প্রবেশের ১০ কি.মি আগে থেকে তোরণ আর ডিজিটাল ব্যানার দিয়ে সাজানো হয় রাস্তার দু’ধার। খুলনা শহরে সকাল থেকেই মানুষের ঢল নামে। সকাল থেকে জাসাসের শিল্পীরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করে নেতাকর্মীদের মাতিয়ে রাখেন।

যশোরের মতবিনিময় সভায় জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শামসুল হুদার সভাপতিত্বে বক্তৃতা করেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম ও জেলা কমিটির সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু। এ সময় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান, আবুল হোসেন আজাদ, যশোরসহ ছয়টি পৌরসভার মেয়র, উপজেলা কমিটিগুলোর সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।