খুনের আগে টিনের চালে ইট নিক্ষেপ করে করা হয় তটস্থ : পালানোর সময় বোমার বিস্ফোরণ

আলমডাঙ্গার বেগুয়ারখালে স্ত্রীর সামনে স্বামীকে কুপিয়ে খুন : ময়নাতদন্ত শেষে আজিজের মৃতদেহ নিজ গ্রামে দাফন

 

ajiat ar 2 sonton

ঘটনাস্থল থেকে ফিরে কেএ মান্নান/আলমডাঙ্গা ব্যুরো: আলমডাঙ্গা বেগুয়োরখাল গ্রামে মধ্যরাতে নৃশংসতার শিকার আজিজুল হক ওরফে আজিতের মৃতদেহ ময়নাতদন্ত শেষে দাফনকাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। গতকাল রোববার বাদ আছর দাফনকাজ সম্পন্ন করা হয়। নিহতের স্ত্রী বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় ৫ জনের নাম উল্লেখ করে ৮/৯ জনকে আসামি করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টসূত্র জানালেও গতকাল আসামিদের নাম প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে পুলিশ। গতরাতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত পুলিশ আসামিদের তেমন কাউকে ধরতে পারেনি। তবে অভিযান চলছিলো।

জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার বেগুয়ারখাল গ্রামের মৃত আমোদ আলীর ছেলে আজিজুল হক আজিজ ওরফে আজিত (৩৫) অন্যান্য রাতের মতো গত পরশু শনিবার দিনগত রাতে খাওয়া-দাওয়া করে ঘরের বারান্দায় চৌকির ওপর ঘুমোতে যায়। এক পর্যায়ে আজিজ ঘুমিয়ে গেলে রাত প্রায় ১২টার দিকে অজ্ঞাত ব্যক্তি তার বসত ঘরের টিনের চালে লাঠি দিয়ে সজোরে আঘাত করে। এতে বেশ জোরে শব্দ হলে বাড়িতে থাকা ছাগলগুলো শব্দ করে ডাকাডাকি শুরু করে। এতে আজিজ ঘুম থেকে জেগে উঠে না দেখলেও তার স্ত্রী ঘরের ভেতর থেকে বের হয়ে ছাগল-গরু ঠিক আছে কি-না তা দেখে যান। এ ঘটনার অল্প সময়ের ব্যবধানে মুখ ঢাকা ও হাঁটুর ওপর লুঙ্গি উল্টো ভাজ করে পরা ৪ জনের একদল দুর্বৃত্ত তাদের ঘরের বারান্দায় উঠে পড়ে। বারান্দার চৌকির ওপর ঘুমন্ত আজিজকে জোর করে তুলে ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় চেঁচামেচিতে আজিজের স্ত্রী দ্রুত ঘরের ভেতর থেকে বের হয়ে স্বামীকে ঘাতকদের নিকট থেকে আগলে রাখতে চেষ্টা করেন। সে সময় ঘাতকদের একজন তাকে চুলের মুঠি ধরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। আজিজ যেতে না চাইলে তাকে পেছন দিক থেকে ঘাতকরা ঘাড়ে, পিঠে ও মুখে উপর্যুপরি ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে মারাত্মক রক্তাক্ত জখম করে ফেলে রেখে যায়। রাস্তায় উঠে ঘাতকচক্র একটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এ বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় গ্রামবাসী ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। আজিজের পরিবারের কান্নাকাটির কারণে পরে প্রতিবেশিরা ছুটে যায় তার বাড়িতে। তারা রক্তাক্ত জখম আজিজকে অজ্ঞান অবস্থায় নসিমনে করে আলমডাঙ্গার নিউ লাইফ সার্জিক্যাল ক্লিনিকে নিয়ে আসে। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনা পুলিশকে জানালে পুলিশ ক্লিনিক থেকে লাশ রাতেই থানায় নিয়ে যায়।

কেন হত্যাকাণ্ড? নানামুখি গুঞ্জন রয়েছে গ্রামে। অনেকেই বলেছে, একই গ্রামের শামসুল হকের ছেলে জীবন (১৬) বখাটে প্রকৃতির। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। গ্রামের অনেকে বলেছেন, নিহত আজিজের মেয়ে রেশমাকে সে সুযোগ পেলেই উত্ত্যক্ত করতো। গত ২৭ রোজার দিন জীবন আজিজের বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে উচ্চ স্বরে বিশেষ ধরনের আওয়াজ করছিলো। এতে আজিজুল ছুটে গিয়ে জীবনকে ওই ধরনের আওয়াজ করতে নিষেধ করলে সে তর্ক শুরু করে। জীবন দাবি করে সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আওয়াজ দিচ্ছে। তার বাড়ি গিয়ে তো না। এ কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে আজিজ জীবনকে লাঠি দিয়ে আঘাত করলে জীবনের হাতে লেগে একটা আঙ্গুল ভেঙে যায়। এ ঘটনায় জীবনের পিতা শামসুল বাদী হয়ে আলমডাঙ্গা থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন। নিহত আজিজের নোয়া ভাই বিজিবি সদস্য সিরাজুল ইসলাম বাড়িতে এসে গত ২৫ জুলাই ৯ হাজার টাকা দিয়ে কিছুটা চাপের মুখে বিষয়টির মীমাংসা করেছেন।

অনেকেরই অভিমত, এ মীমাংসার পরও শামসুলের ক্রোধ ছিলো আজিজের ওপর। এরই জের ধরে গতপরশু রাতে আজিজকে তার বাড়িতে স্ত্রীর সামনে কুপিয়ে খুন করা হয়েছে কি-না তা খতিয়ে দেখছে স্থানীয় অনেকে। পুলিশও শামসুলকে ধরতে গতরাতে অভিযান চালিয়েছে। তবে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তাকে ধরতে পারেনি। নিহতের পরিবারের তরফে অভিযোগ করে বলেছে, জীবনের পিতা শামসুল, একই গ্রামের আয়নালের ছেলে আরেক শামসুল, ভাদুর ছেলে বর্তমানে ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুণ্ডু উপজেলার পার্বতীপুর আমতলায় শ্বশুরবাড়িতে অবস্থানকারী রশিদ, ভেদামারী ও খেজুরতলার আরও ২ জন আজিজকে এক দফা হত্যার চেষ্টা করে। সে দফা দৌঁড়ে পালিয়ে আজিজ প্রাণে রক্ষা পায়।

এছাড়া আজিজের ভাইয়ের ছেলেকে বিদেশ পাঠানোর জন্য ওই রশিদকে দেড় লাখ টাকা দেয়। টাকা নিয়ে রশিদ পানি পথে মালয়েশিয়া পাঠাতে সম্মত হলে আজিজ ও তার ভাইয়েরা কেউ রাজি ছিলো না। তারা টাকা ফেরত চাইলেও রশিদ টাকা না দিয়ে নানা ধরনের হুমকিধামকি দিতো। এক পর্যায়ে গত ২৫ জুলাই অনুষ্ঠিত এক সালিসে বিষয়টি মীমাংসা করা হয়েছে। দেড় লাখ টাকার পরিবর্তে রশিদ এক লাখ ২০ হাজার ফেরত দেবে বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। কিছু টাকা ইতঃমধ্যে ফেরত দিয়েছে বলে জানা যায়। তবে এভাবে সালিসে টাকা নিয়ে মীমাংসার বিষয়টি ভালোভাবে মানতে পারেনি রশিদ। তারই জের ধরে এ হত্যাকাণ্ড? এ প্রশ্ন এখন অনেকের মাঝেই ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে পার্বতীপুর থেকে ছুটে এসে ২ শামসুলের সাথে রশিদ যোগ দিয়ে ঘোলদাড়ি বাজারে আজিজকে মারতে তাড়ার ঘটনা প্রমাণিত হয়ে পড়ে রশিদের এ খুনে সম্পৃক্ততার বিষয়টি বলেও অনেকে জোরালো মন্তব্য করেছেন।

নিহতের পরিবার অভিযোগ করে জানিয়েছে, জীবনের পিতা শামসুল তার ছেলেকে মারধরের সামান্য ঘটনা ভুলতে পারেননি। তিনি প্রতিশোধ নিতে উন্মত্ত হয়ে ওঠেন। এ খুনের কয়েকদিন আগে তিনি নিজ গ্রামে তার এক আত্মীয় বাড়িতে তার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত আয়নাল হকের ছেলে যার বিরুদ্ধে ইতঃপূর্বে পাঁচলিয়া স্কুল বিল্ডিঙের ঠিকাদারের নিকট চাঁদা দাবি ও পরবর্তীতে চাঁদার দাবিতে বোমা হামলার অভিযোগ ছিলো, সেই শামসুল, রশিদসহ বেশ কয়েকজন গোপনে মিটিং করেছিলো। ‘শত্রুর শত্রু আমার মিত্র’ এমন কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলো জীবনের পিতা শামসুল। এ ব্যাপারে নিহতের ভাইদের নিকট তথ্য ছিলো বলে তাদের দাবি। ভুক্তভোগি পরিবারটি দাবি করেছে, জীবনের পিতা শামসুলই, রশিদ ও একই গ্রামের চাঁদাবাজ-বোমাবাজ শামসুলকে দিয়ে এ নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। ঘটনার রাতে অভিযুক্তদের খুঁজতে পুলিশ তাদের বাড়ি গিয়ে কাউকে পাই নি। অভিযুক্তদের গভীর রাতে বাড়িতে অনুপস্থিতির কারণে তাদের প্রতি সন্দেহ আরও তীব্রতর হয়েছে।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই রফিকুল ইসলাম বলেছেন-ঘটনাস্থল পুলিশ বার বার পরিদর্শন করেছে। এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের সঠিক কারণ কিংবা ঘাতকদের সনাক্ত করা তাতক্ষণিকভাবে সম্ভব হয়নি। প্রাথমিকভাবে বাদীর অভিযোগকেই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হচ্ছে।

নিহতের পরিচয়: বেগুয়ারখাল গ্রামের মৃত আমোদ আলীর ৭ সন্তানের মধ্যে নিহত আজিজ ছিলেন সকলের ছোট। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান আজিজ কৃষিকাজ করতেন। তার ২ সন্তান। বড় মেয়ে রেশমার বয়স ১৩ বছর। ছেলে সালামের বয়স মাত্র ৭ বছর। বখাটে জীবনকে মারধর করা ছাড়া তার বিরুদ্ধে গ্রামে কারোর তেমন অভিযোগ ছিলো না।

গতকাল ময়নাতদন্ত শেষে নিহতের লাশ বিকেলে তার গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। বাদ আছর জানাজা শেষে লাশ গ্রামের গোরস্তানে দাফন করা হয়। এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী রেহেনা খাতুন বাদী হয়ে গতকাল আলমডাঙ্গা থানায় ৫ জনের নির্দিষ্ট নাম উল্লেখ করে ও আরও অজ্ঞাত ২ জনকে আসামি করে এজাহার দায়ের করেছেন।

এদিকে, এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রকাশিত সংবাদে নিহত আজিজকে কোরবান বাহিনীর সদস্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ তথ্য মিথ্যা ও আপত্তিকর বলে দাবি করে নিহতের ভাই সিরাজুল ইসলাম বলেন, কেউ হত্যার অপরাধ আড়াল করতে মোবাইলফোনে উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে সাংবাদিককে মিথ্যা তথ্য দিয়েছে।