খালেদা জিয়ার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা

তারেককে ৪ মার্চ আদালতে হাজির হওয়ার আদে

 

স্টাফ রিপোর্টার: দুর্নীতির দু মামলায় ধার্য তারিখে হাজির না হওয়ায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। ঢাকার তিন নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আবু আহমেদ জমাদার গতকাল বুধবার এ তিনজনের জামিন বাতিল করে পরোয়ানা জারির আদেশ দেন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা ছাড়া বাকি দুজন হলেন- মাগুরার সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ। খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা পরে পরোয়ানা বাতিলের আবেদন করলে তাও নাকচ করে দেন আদালত। এ পরোয়ানা গতকাল বিকেলেই রাজধানীর তিন থানা রমনা, গুলশান ও ক্যান্টনমেন্টে পাঠানো হয়েছে। জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট ও জিয়া এতিমখানা ট্রাস্টে দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের দায়ের করা এ দুটি মামলার বিচার চলছে ঢাকার বকশিবাজার এলাকার আলিয়া মাদরাসা ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সংলগ্ন মাঠে নির্মিত অস্থায়ী আদালত ভবনে। এদিন বিএনপি চেয়ারপারসনের অনুপস্থিতিতেই এতিমখানা দুর্নীতি মামলার বাদী হারুন অর রশীদের অবশিষ্ট সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। আসামিরা উপস্থিত না থাকায় প্রথম সাক্ষীর জেরা বাতিল করে পরবর্তী সাক্ষীর জবানবন্দি শোনার জন্য ৪ মার্চ দিন রাখেন বিচারক। দুদকের আইনজীবীর আবেদনে এতিমখানা দুর্নীতি মামলায় খালেদার ছেলে ও বিএনপির জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকেও ৪ মার্চ আদালতে হাজির করতে আদেশ দেন আদালত, যিনি চিকিৎসার জন্য উচ্চ আদালতের জামিনে গত ছয় বছরের বেশি সময় ধরে লন্ডনে অবস্থান করছেন। ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুতে শোকের কথা জানিয়ে গত ২৯ জানুয়ারি আদালতে না এসে আইনজীবীর মাধ্যমে সময়ের আবেদন পাঠান খালেদা জিয়া। বিচারক সেদিন তা মঞ্জুর করে সাক্ষ্য শোনার জন্য ২৫ ফেব্রুয়ারি দিন রাখেন। এর আগে ১৫ জানুয়ারিও আদালতে যাননি খালেদা। ওইদিন আদালতে হাজির না হওয়ার কারণ হিসেবে গুলশান কার্যালয়ে খালেদাকে অবরুদ্ধ করে রাখার কথা বলেছিলেন আইনজীবীরা। বিচারক তাকে সেদিনের হাজিরা থেকে রেহাই দিলেও সময়ের আবেদন নাকচ করে বাদীর সাক্ষ্য চালিয়ে যাওয়ায় আদেশ দেন। এ নিয়ে আদালতে হইচই হয় এবং খালেদার আইনজীবীরা বিচারকের প্রতি অনাস্থা জানান। ৩ জানুয়ারি থেকে নিজের গুলশানের কার্যালয়েই অবস্থান করছেন বিএনপিনেত্রী। অবরোধ-হরতালের মধ্যে বুধবারও খালেদা জিয়া আদালতে না এসে সাক্ষ্য পেছাতে আইনজীবীদের মাধ্যমে আবারো আবেদন করেন। উচ্চ আদালতে লিভ টু আপিলের কথা জানিয়ে এ আবেদন করা হয়। শুনানি শেষে বিচারক দু আবেদনই খারিজ করে দেন। টানা কয়েকটি ধার্য দিনে আদালতে হাজির হতে ব্যর্থ হওয়ায় জামিন বাতিল করে তিন আসামির বিরুদ্ধে দায়ের করেন গ্রেফতারি পরোয়ানা। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই জিয়া এতিমখানা ট্রাস্টের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে এবং ২০১১ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় জিয়া দাতব্য ট্রাস্টে দুর্নীতির অভিযোগে এ দুটি মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন। গত বছর ১৯ মার্চ অভিযোগ গঠনের মধ্যদিয়ে আদালত সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ আসামিদের বিচার শুরু করে। এর মধ্যে এতিমখানা ট্রাস্ট মামলায় খালেদা ও তার বড় ছেলে তারেক রহমানসহ ছয়জন এবং জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার সঙ্গে আরো তিনজন আসামি হিসেবে রয়েছেন। এ দু মামলায় অভিযোগ গঠন ও অভিযোগ গঠনকারী বিচারকের নিয়োগের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে খালেদা জিয়া আপিল বিভাগে গেলেও তা খারিজ হয়ে যায়। খালেদার অনুপস্থিতিতেই গতবছর ২২ সেপ্টেম্বর এতিমখানা দুর্নীতির মামলায় বাদী হারুন অর রশীদের জবানবন্দি শোনা শুরু করেন তিনি। কিন্তু আসামিপক্ষ দফায় দফায় সময়ের আবেদন করায় তার সাক্ষ্য এখনো শেষ করা যায়নি। এ দুটি মামলায় হাজিরা দিতে সর্বশেষ ২৪ ডিসেম্বর আদালতে গিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। ওইদিন বকশিবাজার থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ পর্যন্ত এলাকায় সরকার সমর্থকদের সাথে বিএনপিকর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এ পর্যন্ত এ দুটি মামলায় মোট ৬৩ দিন আদালত বসেছে, যার মধ্যে খালেদা হাজির ছিলেন মাত্র সাত দিন।

মামলা বৃত্তান্ত: ২০১১ সালের ৮ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা দায়ের করেন দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক হারুনুর রশিদ। তেজগাঁও থানার এ মামলায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ আনা হয় আসামিদের বিরুদ্ধে। ২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি খালেদা জিয়াসহ চারজনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। এ মামলার অপর আসামিরা হলেন- খালেদার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, হারিছের তখনকার সহকারী একান্ত সচিব ও বিআইডব্লিউটিএ’র নৌনিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান। এদের মধ্যে হারিছ চৌধুরী মামলার শুরু থেকেই পলাতক। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও রয়েছে। খালেদাসহ বাকি দু আসামি জামিনে রয়েছেন। জিয়া এতিমখানা ট্রাস্টে অনিয়মের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় অন্য মামলাটি করে। এতিমদের সহায়তার জন্য একটি বিদেশি ব্যাংক থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয় এ মামলায়। দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক হারুনুর রশিদ ২০১০ সালের ৫ আগস্ট বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে এ মামলায় অভিযোগপত্র দেন। মামলার অপর আসামিরা হলেন- মাগুরার সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী এবং প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান। তারেক রহমান উচ্চ আদালতের জামিনে গত ছয় বছর ধরে বিদেশে অবস্থান করছেন। সালিমুল হক কামাল ও শরফুদ্দিন আছেন জামিনে। বাকি দুজন পলাতক।

খালেদার গ্রেফতারের আদেশ বেআইনি: এদিকে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেফতারের আদেশকে বেআইনি আখ্যায়িত করেছেন সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন। তিনি বলেন, আমরা আইনের যতো রকম ব্যাখ্যা ছিলো দিয়েছি। তারপরও আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন। এটা আইনের পরিপন্থি। সিনিয়র আইনজীবীদের সাথে পরামর্শ করে এ বিষয়ে সব ধরনের আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হবে বলেও জানান তিনি। সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতির কক্ষে গতকাল বুধবার দুপুরে সাংবাদিকদের তিনি এ সব কথা বলেন। তিনি বলেন, সারা পৃথিবীর মানুষ জানে ৫১ দিন ধরে বেগম খালেদা জিয়া অভুক্ত, অসুস্থ ও অবরুদ্ধ অবস্থায় আছেন। আমরা বলেছি পরবর্তী তারিখ পর্যন্ত তাকে সময় দেয়া হোক। আমরা আইনের সমস্ত ব্যাখ্যা দিয়েছি। কিন্তু আদালত আমাদের কথা শোনেননি। এ আদালতের প্রতি আমাদের আস্থা নেই। আমাদের বিশ্বাস আমরা এ আদালতে ন্যায়বিচার পাবো না। খন্দকার মাহবুব বলেন, এ মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আমরা সিনিয়র আইনজীবীদের সাথে কথা বলে উচ্চ আদালতে যাবো। এমনকি আইনিভাবে যা যা করা দরকার তার সবই করবো। আমরা আশা করি সেখানে ন্যায়বিচার পাবো। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া গ্রেফতার হলে হবেন। রাজনীতি করতে হলে গ্রেফতার হতে হয়, এটা অস্বাভাবিক কিছু না। রাজনৈতিক নেতারা জনগণের স্বার্থে, জনগণের কল্যাণে বহুবার গ্রেফতার হয়। এ সময় খালেদা জিয়ার আইনজীবী এজে মোহাম্মদ আলী, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন উপস্থিত ছিলেন।