খালেদা জিয়ার গতিরোধ : পথে পথে পুলিশ ও ক্ষমতাসীনদের নজিরবিহীন বাধা চুয়াডাঙ্গা মেহেরপুরের কোচগুলো কানাইডাঙ্গা থেকে ফেরত : মার্চ ফর ডেমোক্রেসি চলবে : সারাদেশে অবস্থান কর্মসূচি

স্টাফ রিপোর্টার: বাসা থেকে বের হলেও রাস্তায় নামতে পারেননি বিরোধী নেতা খালেদা জিয়া। তার গতিরোধ করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বাধা পেয়ে মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচি সোমবারও চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। একই সাথে সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন কড়া ভাষায়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার আচরণে ক্ষুব্ধ খালেদা তাদের সরকারের দালালি না করারও পরামর্শ দিয়েছেন। বলেছেন, তাকে এভাবে বাধা দেয়া হলে ১৮ দলের কর্মসূচিও চলতে থাকবে। ১৮ দলের ডাকা গতকালের কর্মসূচি ঘিরে দিনভর উত্তেজনা ছিলো রাজধানী জুড়ে। সকালে নয়াপল্টনের কর্মসূচি যাওয়ার কথা ছিলো খালেদা জিয়ার। প্রস্তুত ছিলেন গুলশানের বাসায়। কিন্তু তার বাসা ঘিরে ছিলো নিরাপত্তা বাহিনীর কড়া বলয়। পরিস্থিতি বিবেচনায় বাসা থেকে বের হতে বিলম্ব হচ্ছিলো। বেলা ২টা ৫৩ মিনিটে তিনি বাসা থেকে নিচে নামেন নয়াপল্টনে যাওয়ার জন্য। কিন্তু পুলিশ বাসা থেকে তার গাড়ি বের করতে দেয়নি।

ঢাকার কোনো প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকতে দেয়া হয়নি নেতাকর্মী; এমনকি সাধারণ মানুষকেও। তল্লাশির নামে পথে পথে মানুষকে হয়রানি করা হয়েছে। পূর্ব ঘোষিত ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ গণতন্ত্রের অভিযাত্রা কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে রোববারও সারাদেশে ছিলো অঘোষিত অবরোধ। যানবাহন না চলায় সাধারণ মানুষকে পড়তে হয় সীমাহীন দুর্ভোগে। রোববার সকাল থেকে জাতীয় পতাকা হাতে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জমায়েত হওয়ার কথা ছিলো। কিন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর নিরাপত্তাব্যূহ ভেদ করে কেউ সেখানে যেতে পারেনি। কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ নয়াপল্টনের আশপাশ ছিলো পুরোপুরি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে। তবে গণজমায়েতকে কেন্দ্র করে বিএনপির কেন্দ্রীয় ও মহানগরীর কোনো নেতাকে রাজপথে দেখা যায়নি। গণজমায়েত প্রতিহত করতে আগেই ঘোষণা দেয় ক্ষমতাসীন দল। শনিবার রাত থেকেই রাজধানীকে সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় সরকার। আর শুক্রবার থেকে অঘোষিতভাবে বন্ধ করে দেয় বাস, লঞ্চ ও ট্রেন চলাচল। রোববারও তা বলবৎ ছিলো। ভোর থেকেই রাজধানীর প্রবেশপথসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো নিয়ন্ত্রণে নেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নাশকতা ঠেকানোর নামে পুলিশ এপিসি, রায়ট কন্ট্রোল, সাউন্ড ও জলকামানসহ সাঁজোয়া যান প্রস্তুত রাখে। রাজধানীর বিভিন্ন প্রবেশমুখে সেনাবাহিনীকে মাইক নিয়ে জনসাধারণকে আশ্বস্ত করতে দেখা যায়। কেউ যাতে কোনোভাবে আতঙ্কিত না হয় সেজন্য সেনাবাহিনী মাইকে ঘোষণা দেয়- আতংকের কিছু নেই আমরা আছি।

চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর থেকে গতকাল বেলা ১১টার দিকে কয়েকটি কোচ ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলেও তা প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ভাঙচুরও করা হয়। ফরিদপুরের কানাইডাঙ্গা থেকে কোচগুলো ফেরত আসে। কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানা গেলেও বিস্তারিত জানা যায়নি। কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। দুপুরে মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায় মনসুর প্রাধানীয়া নামে এক শিবির নেতা নিহত হয়েছেন। হাইকোর্টে প্রবেশ করে বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের ওপর হামলা চালায় ক্ষমতাসীনরা। বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে কমলাপুর রেলস্টেশনে তল্লাশির সময় বোমা বিস্ফোরণে রেলের নিরাপত্তাকর্মী আবুল কাশেম মারা যান।

সুপ্রিমকোর্টের সামনে কদম ফোয়ারার পাশের রাস্তায় শিক্ষকদের ওপর হামলা চালায় পুলিশ। রাজধানীতে গ্রেফতার করা হয় বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতাকে। সরকারের বাধার কারণে কর্মসূচি পালন করতে পারেনি এমন অভিযোগ এনে আজ সোমবারও একই স্থানে গণজমায়েত কর্মসূচির ঘোষণা দেন বিএনপি চেয়ারপারসন।

রোববার গণজমায়েতকে কেন্দ্র করে রাজধানী ও আশপাশের প্রত্যেকটি পথে পুলিশি বাধা, হয়রানি ও তল্লাশি কার্যক্রমের কারণে রাজধানীর ভেতরে প্রবেশ করা মানুষদের পোয়াতে হয়েছে নজিরবিহীন দুর্ভোগ। চেকপোস্টে র‌্যাব-পুলিশের বাড়াবাড়ি তল্লাশি পেরিয়ে আসতে ঢাকামুখি মানুষকে শিকার হতে হয়েছে নানা জিজ্ঞাসার। অবশ্য এসব পথ হয়ে ভোর থেকে রাজধানীর ভেতরে কিছুসংখ্যক লোক প্রবেশ করলেও ছিলো কড়াকড়ি। অনেকের প্রয়োজন থাকলেও নজিরবিহীন বাধার কারণে রাজধানীর ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি। প্রবেশপথগুলো ছিলো আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য ও শাসক দলের নেতাকর্মীদের দখলে। এসব পয়েন্টে যুবলীগ-ছাত্রলীগ নেতারা লাঠি হাতে মহড়া দিতে থাকে। তারাও পুলিশের সঙ্গে যোগ দেয় বাধা দিতে এবং তল্লাশিতে। লাঠিয়াল বাহিনীর দৃশ্য দেখে অনেকে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। পাঞ্জাবি আর দাড়ি টুপি থাকলেই সন্দেহ করা হয়। তাদের আর কোনো প্রয়োজনকেই গুরুত্ব দেয়া হয় না। ফিরিয়ে দেয়া হয় প্রবেশমুখ থেকে। পুলিশের বাড়াবাড়ি ও তল্লাশির হাত থেকে রেহাই পায়নি শিশু, নারী, বয়স্ক থেকে শুরু করে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষও। কয়েকটি পুলিশ চেকপোস্টে জিজ্ঞাসার মুখে পড়ে সময়ক্ষেপণ হওয়ায় হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই প্রাণ হারান দারুস সালাম থেকে আসা মাবিয়া বেগম।

নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও আশপাশের এলাকা ছিলো পুরোপুরি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। শনিবার রাত থেকেই এসব এলাকায় মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত র‌্যাব ও পুলিশ। রোববার সকালে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয় কেন্দ্রীয় কার্যালয়। বিপুলসংখ্যক র‌্যাব পুলিশের পাশাপাশি শাদা পোশাকে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা ছিলো বেশ তৎপর। প্রস্তুত রাখা হয় জলকামান, রায়টকার, প্রিজনভ্যানসহ বেশ কয়েকটি বাস ও মিনিবাস। ফকিরাপুল ও নাইটিঙ্গেল মোড়সহ নয়াপল্টনে ঢোকার সব পথে ব্যারিকেড দিয়ে সেখানে অবস্থান নেয় পুলিশ। এসব এলাকায় যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। সাধারণ মানুষ এসব এলাকা দিয়ে হেঁটে পার হতে পারলেও সবাইকে তল্লাশি করা হয়। কাউকে কোনো স্থানে দাঁড়াতে দেয়া হয়নি। পরিচয়পত্র দেখে নিশ্চিত হওয়ার পরই কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে প্রবেশ করতে দেয়া হয় মিডিয়াকর্মীদের। বন্ধ ছিলো এসব এলাকার সব দোকানপাট।

সকাল সাড়ে দশটার দিকে মহিলা দলের তিন নেতাকর্মী কার্যালয়ের সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের আটক করে পুলিশ। তারা হলেন সাবেক সংসদ সদস্য রওশন আরা ফরিদ, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সাদিয়া হক ও জান্নাতুল ফেরদৌস। এর আগে সকাল ১০টার দিকে নাইটিঙ্গেল মোড়ে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরি করার অভিযোগে আবু তাহের ও ইসমাইল নামের দুজনকে আটক করে পুলিশ।

সকাল ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে যেকোনো মূল্যে নয়াপল্টনের সামনে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছিলো বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। সারাদেশ থেকে নেতাকর্মীদের জাতীয় পতাকা হাতে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জমায়েত হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরাপত্তা বেষ্টনী উপেক্ষা করে কোনো নেতাকর্মী সেখানে যেতে পারেননি। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রোববার সকাল ১০টার মধ্যে কেন্দ্রীয় নেতাদের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয়ার নির্দেশ দিলেও সারাদিনেও কাউকে সেখানে দেখা যায়নি। মহানগর বিএনপির কোনো পর্যায়ের নেতাকর্মীকেও কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও এর আশপাশে চোখে পড়েনি। সারাদেশ থেকে আসা নেতাকর্মীদের কোনো মিছিলও দেখা যায়নি সেখানে। শুধু তাই নয়, গণজমায়েতকে কেন্দ্র করে বেলা ১১টা থেকে সমাবেশের ঘোষণা দিলেও তার কোনো প্রস্তুতি ছিলো না। দীর্ঘদিন ধরে অবরুদ্ধ থাকা কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের প্রধান গেট ছিলো তালাবদ্ধ। কার্যালয়ের ভেতরে কাউকে ঢুকতে দেখা যায়নি, কার্যালয়ের ভেতরে কয়েকজন অফিস সহকারী অবস্থান করছিলেন।

গাবতলীর মাজার রোডে স্থানীয় সংসদ সদস্য আসলামুল হক আসলামের নেতৃত্বে লাঠিসোঁটা নিয়ে শাসক দলের ক্যাডারদের সমাবেশ হয়েছে। মাজার রোডের একটি অংশ ভোর থেকে আওয়ামী লীগের দখলে ছিলো। ওই পথ হয়ে কোনো রিকশা-ভ্যান বা প্রয়োজনীয় গাড়িও ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি। মাজার রোডে রাজধানীর মিরপুরের দিকে মোটরসাইকেলে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাদের মহড়া দিতে দেখা যায়। রাজধানীর অন্যতম প্রবেশপথ গাবতলী হয়ে যেসব মানুষ নগরীতে প্রবেশ করেছেন তাদের ব্যাপক বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। ভোর থেকেই নবীনগর বাসস্ট্যান্ড, সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড, হেমায়েতপুর ও আমিনবাজারে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে এবং আশুলিয়ার বাইপাইল, আশুলিয়া বাজারসহ ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের বিভিন্ন স্থান থেকে রাজধানীর প্রবেশপথ গাবতলীতে যেসব ছোট ছোট যানবাহন এসেছে সেগুলো আবার ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে।

পুলিশের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা লাঠি হাতে অবস্থান নিয়ে অনেক সাধারণ মানুষের গায়েও হাত তুলেছে। মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে ঢাকামুখি পণ্যবাহী ট্রাক ছাড়া সব ধরনের যান চলাচলে বাধা দেয় পুলিশ ও আওয়ামী লীগ তারা। রাজধানীর প্রবেশমুখ আমিনবাজারে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে পুলিশের সঙ্গে যানবাহনে তল্লাশি চালায় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এসব পয়েন্টে যানবাহন থেকে সাধারণ মানুষকে নামিয়ে দেয়া হয় বলেও অভিযোগ করেছেন অনেকে।