কৌশল খুঁজতে হন্তদন্ত দুই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি

স্টাফ রিপোর্টার: খুব বেশি দূরে নেই নির্বাচন। আবার এত সহজ নয় এ বৈতরণী পার হওয়া। কীভাবে এ পথ পাড়ি দেয়া যাবে তা নিয়ে কৌশল খুঁজতে হন্তদন্ত দুই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এখন দাঁড়িয়ে পাহাড়সম চ্যালেঞ্জের সামনে।

নির্বাচনকালীন সরকার আর সরকারপ্রধান নিয়ে এ দু দল ও তাদের নেতৃত্বাধীন জোটের মতৈক্য এখনও দূর অস্ত। বর্তমান সংবিধানের আলোকেই নির্বাচন করার জন্য কিরা-কসম কেটে একপায়ে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকা তাদের জন্য যেমন চ্যালেঞ্জের, তেমনিই চ্যালেঞ্জ হলো নির্বাচনে সব দলকে আনা। জয়লাভ করা। আন্তর্জাতিকভাবে সে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করা। বিরোধী দল যে কঠোর-কঠিন আন্দোলনের হুমকি দিয়েছে, তা মোকাবেলা করাও এত সহজ নয়। মহাজোট অক্ষুন্ন রাখতেও কম আদাজল খেতে হবে না তাদের। আর নির্বাচন-পূর্ব আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামাল দিতেও যে কঠোর সংগ্রামই করতে হবে এরই মধ্যে বুঝে গেছে দলটি।

বিপরীতে বিএনপিও হাঁটু গেড়ে বসেছে তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকারের জন্য। এক্ষেত্রে কঠোর আন্দোলনের বিকল্প নেই তাদের কাছে। বিপরীতে কঠিন আন্দোলন করতে গিয়ে জনমত যেন বিপক্ষে না যায়, ভাবনার কম নেই তা নিয়েও। আবার সরকারকে তত্ত্বাবধায়কে বাধ্য করতে না পারলে যে সবই বৃথা যাবে তাদের! এ ইস্যুতে বিদেশী শক্তির সমর্থন আদায়ও চ্যালেঞ্জই দলটির সামনে। এর মধ্যে রয়েছে একতরফা নির্বাচনের ভয়ও। আওয়ামী লীগ তা দিয়ে বসলে কীভাবে বিষয়টি মোকাবেলা করবে তারা। অন্যদিকে যদি শেষ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে জিতেই যায় দলটি, তাহলে উপযুক্ত প্রার্থী বাছাইয়ের সংগ্রাম তো থাকছেই।

আওয়ামী লীগের সামনে যত চ্যালেঞ্জ: বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবেলার পাশাপাশি আগামী নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে সরকারের সামনে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ। পর্যবেক্ষকদের মতে, এ দুটি ইস্যুর সঙ্গে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের কাছে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করা সরকারের জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ। কারণ একতরফাভাবে নির্বাচন করলে তা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। অথবা সমঝোতার পর বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণে নির্বাচন হলে জয়লাভের চ্যালেঞ্জ নিতে হবে আওয়ামী লীগকে। ফলে সব দিক ভেবেচিন্তে অগ্রসর হতে হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলটিকে। দলটির নীতিনির্ধারকরা এসব বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করছেন। সর্বশেষ শনিবার অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের ‘থিংক ট্যাংক’ বলে পরিচিত উপদেষ্টা পরিষদ এবং সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের রোববারের বৈঠকেও এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

জানা গেছে, এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট অক্ষুন্ন রাখাকে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছেন। বিশেষ করে বড় অংশীদার জাতীয় পার্টিকে জোটে ধরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। বাম ও প্রগতিশীল দল এবং ইসলামী ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলোও যাতে বের হয়ে না যায়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা। পাশাপাশি কিছু বাম ঘরানার রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে। ইতোমধ্যে সিপিবিসহ এসব দলের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। আগামী নির্বাচনের আগে জোটে অন্তর্ভুক্ত কিংবা তাদের সঙ্গে যে কোনোভাবে নির্বাচনী সমঝোতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। একই সঙ্গে মহাজোট থেকে বের হয়ে কোনো দল বিশেষ করে জাতীয় পার্টি যাতে বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে হাত না মেলায় ভেতরে ভেতরে সে ধরনের তৎপরতাও চালিয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। নেতারা মনে করেন, পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে এসব বিষয় মোকাবেলা এখন আওয়ামী লীগের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

পর্যবেক্ষক মহলের মতে, সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার হলে ওই সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে নাও আসতে পারে। সেক্ষেত্রে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে নির্বাচনে যাওয়া এবং এ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করে আন্তর্জাতিক মহলকে সন্তুষ্ট করা সরকারি দলের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। আর বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতা হলে নির্বাচনে জয়লাভ করাটা তাদের জন্য আরও বড় চ্যালেঞ্জ। তার আগে বিভিন্ন কারণে ক্ষুব্ধ সুশীল সমাজ এবং দেশের গণমাধ্যমকে নিজেদের পক্ষে আনা ক্ষমতাসীন জোটের জন্য আরও একটা চ্যালেঞ্জ বলে তারা মনে করেন। কেননা বিভিন্ন কারণে গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজ সরকারের সমালোচনায় মুখর। টকশোর আলোচনা উদ্ধৃত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিষয়টি স্বীকার করেছেন। সর্বশেষ রোববার গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুশীল সমাজ কর্তৃক সরকারের সমালোচনার উল্লেখ করে বলেন, তার সরকারের আমলে অনুমোদন পাওয়া টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর টকশোতে টক টক কথা বলে সরকারের সমালোচনা করছে। যা তারা প্রত্যাশা করেননি।

এদিকে বিরোধী দলকে ছাড়াই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করাটাকে কোনো চ্যালেঞ্জ হিসেবে মানতে নারাজ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ। তিনি মনে করেন, সংবিধান অনুযায়ী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচন হলেও বিএনপি তা মেনে নেবে। অর্থাৎ তারা এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। কারণ পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জয়লাভের পর বিএনপি নেতারা ধরেই নিয়েছেন জাতীয় নির্বাচনে তাদের ঠেকানোর কোনো পথ নেই। তাছাড়া ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নির্বাচনে অংশ নেয়া ছাড়া তাদের কোনো উপায় নেই- এটাও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ভালোভাবে জানে। তবে হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে সরকারবিরোধী যে অপপ্রচার চলছে তা মোকাবেলা করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হওয়া আওয়ামী লীগের জন্য ‘বিগ চ্যালেঞ্জ’ বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এ নেতা। শুধু তাই নয়, এটা গণতন্ত্রের জন্যও চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন তিনি।

এদিকে সংঘাতপূর্ণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে দেশি-বিদেশি কূটনৈতিক মহলের পাশাপাশি বিভিন্ন দাতা সংস্থা নজর রাখছে বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে নির্বাচনে যাওয়াও ঠিক হবে কি-না তা সরকারের অন্যতম ‘বিবেচ্য’ বিষয়। বিশেষ করে কূটনৈতিক মহলসহ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রভাবশালী দেশগুলোর কাছে নির্বাচনী ফলাফল গ্রহণযোগ্য হতে হবে। এ ছাড়া নির্বাচন-পূর্ব ও নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতিও সরকারকে সামাল দিতে হবে। ঘরে-বাইরে সরকারকে মোকাবেলা করতে হবে নানা চাপ।
আর তাই সরকারের বিরুদ্ধে সব ধরনের অপপ্রচার রুখে দিতে আওয়ামী লীগ ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে এগুচ্ছে।

জানা গেছে, এ জন্য বিলবোর্ড প্রচারণা, রোডশো এবং গণমাধ্যমের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে জোর প্রস্তুতি চলছে। নেতিবাচক প্রচারণার বিরুদ্ধে পাল্টা প্রচারণা চালাতে তৈরি করা হচ্ছে বিজ্ঞাপন।

বিএনপির সামনে যত চ্যালেঞ্জ: আন্দোলন ও নির্বাচনসহ বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি এখন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে হচ্ছে দলটিকে। তবে এক্ষেত্রে তারা কতটুকু সফল হবে তা নির্ভর করছে পরিকল্পনা সুনির্দিষ্ট বাস্তবায়নের ওপর। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কারও কারও মতে, এবারের এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার ওপর দলটির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও অনেকাংশে নির্ভর করছে। কারণ সরকার একতরফা নির্বাচনের উদ্যোগ নিলে আন্দোলনের মধ্যদিয়ে বিএনপিকে তা মোকাবেলা করতে হবে। একইভাবে তত্ত্বাবধায়কের দাবিও তাদের আদায় করতে হবে আন্দোলনের মাধ্যমে। এসব ইস্যুতে দেশি-বিদেশি শক্তির সমর্থন আদায়ের চ্যালেঞ্জও রয়েছে দলটির সামনে। আবার সমঝোতা হলেও নির্বাচনে জয়লাভ করার জন্য রয়েছে আরেক ধরনের চ্যালেঞ্জ।
পর্যবেক্ষকদের মতে, আন্দোলন ও দলীয় কর্মকাণ্ডের প্রতি সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে আস্থায় আনা, মিডিয়ার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি, নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ক্লিন ইমেজের নেতাদের অগ্রাধিকার দেয়া, নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতি সাধারণ মানুষকে আস্থায় আনা, সর্বোপরি অভ্যন্তরীণ কোন্দল মিটিয়ে দলকে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে বিএনপিকে। এসব চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা হচ্ছে বলে জানান বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর মনিরুজ্জামান মিয়া বলেন, সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দলকেও আগামী কয়েক মাসে নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। সরকারি দল মনে করছে, সব কিছু তাদের কব্জায় রয়েছে। তাই তারা নিজেদের অধীনে নির্বাচন করার চেষ্টা করবে। কিন্তু সরকারি দলের এমন সিদ্ধান্ত প্রতিহত করে নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়ে বিরোধী দলকে অনেকটা কঠিন ও কৌশলী ভূমিকা নিতে হবে। সাধারণ মানুষের মন-মেজাজ উপলব্ধি করতে হবে। অন্য দলকে ছাড় দিলে ভবিষ্যতে নিজেরা টিকবে কি-না এ নিয়ে ভাবতে হবে। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনে ভালো ফলাফল পেতে দলের ভেতর কোন্দল থাকলে তা নিরসনসহ সঠিক প্রার্থী বাছাই করার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হাফিজউদ্দিন খান বলেন, সরকারের মনোভাব দেখে মনে হচ্ছে তারা নিজেদের অধীনেই নির্বাচন করবে। ইতোমধ্যে তারা ঘোষণা করেছেন, ২৫ অক্টোবর সংসদ ভেঙে দেয়া হবে। তাই আসছে অধিবেশনে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তন করা না হলে আর সম্ভব হবে না। সরকারের এমন মনোভাব মোকাবেলায় বিএনপিকে কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ২৫ অক্টোবরের আগে সংবিধান সংশোধন না হলে হরতাল, অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও ছাড়া বিএনপির আর বিকল্প থাকবে না। এর ফলে কি পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে সেদিকেও সতর্ক থাকতে হবে দলটির।
হাফিজউদ্দিন বলেন, আন্দোলনের পাশাপাশি মামলা নিয়েও বিএনপিকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে থাকতে হবে। দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নিতে হবে। তিনি বলেন, প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে যোগ্য নেতাদের প্রাধান্য দেয়া বিএনপির জন্য কঠিন হবে। এ ছাড়া তৃণমূলের কোন্দল নিরসন করে দলকে শক্তিশালী করার মতো কঠিন চ্যালেঞ্জ তো রয়েছেই।

আন্দোলনে সুশীল সমাজ, মিডিয়াসহ সাধারণ মানুষের সমর্থন আদায়: আপাতত জনগণকে সম্পৃক্ত করে নির্দলীয় সরকারের দাবিতে চলমান আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ দেয়ার দিকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে দলটি। এ লক্ষ্যে মাসব্যাপি গণসংযোগ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বিভাগীয় শহর ছাড়াও কয়েকটি জেলায় সমাবেশ করবেন খালেদা জিয়া। ওই সমাবেশ সফল করার পাশাপাশি দাবির প্রতি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সমর্থন আদায়ে জেলা সফর শুরু করেছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। কেন্দ্রীয়ভাবে গঠিত ৫৬ টিমকে ৩১ আগস্টের মধ্যে জেলা সফর শেষ করতে নির্দেশ দিয়েছেন চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরে ও জনমত সৃষ্টির জন্য মফস্বলের বুদ্ধিজীবী বলে পরিচিত শিক্ষক-সাংবাদিক-কবি-সাহিত্যিকসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করার চিন্তাভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি সমানতালে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখবে তারা। জনগণ ও কূটনৈতিক চাপকে কাজে লাগিয়ে দাবি আদায়ের শেষ চেষ্টা চালাবে।

ঘোষিত সাদামাটা কর্মসূচি নিয়ে নানা সমালোচনা হচ্ছে। সহিংসতা, জ্বালাও-পোড়াও এড়িয়ে আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার কৌশল হিসেবে এমন কর্মসূচি নেয়া হয়েছে বলে নীতিনির্ধারকদের দাবি। এতকিছুর পরও বিএনপি কঠোর কর্মসূচি দেয়নি; জনগণ ও বিদেশীদের মাঝে এমন উপলব্ধি সৃষ্টি হবে। ফলে শেষ মুহূর্তে এসে কঠোর কর্মসূচি দিলেও তাতে জনগণের সায় থাকবে। জনগণ বুঝতে পারবে, আমাদের আর কিছুই করার নেই। বাধ্য হয়েই এ ধরনের কর্মসূচি দিয়েছি।

এদিকে নির্দলীয় সরকারের দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে দেশের সুশীল সমাজ ও মিডিয়ার সমর্থন পাওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে বিএনপি। এ লক্ষ্যে অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো হচ্ছে। নির্দলীয় সরকার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়- এ বিষয়ে জনমত তৈরি করতে মিডিয়ার সহায়তা প্রয়োজন বলে মনে করছে দলটি। মিডিয়ার মাধ্যমে দেশের সুশীল সমাজও যাতে ওই দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরেন সে পরিকল্পনাও রয়েছে তাদের।

বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন হলে তা প্রতিহত করার প্রস্তুতি: সূত্র জানায়, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়ের পাশাপাশি দলীয় সরকারে অধীনে নির্বাচন ঠেকানোর চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে নানা কর্মকৌশল চূড়ান্ত করছে দলটি। ঈদুল আজহার পর চট্টগ্রাম ও ঢাকায় মহাসমাবেশ করবে তারা। এর আগে নির্দলীয় সরকার নিয়ে সরকার কোনো সমঝোতায় না এলে চট্টগ্রামের জনসভা থেকে ঘোষণা করা হতে পারে ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচি। এরপরও সরকার তাদের অধীনে নির্বাচন করতে অনড় থাকলে ঢাকার সমাবেশ থেকে ঘোষণা করা হবে নির্বাচন প্রতিহতের কর্মসূচি। অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে ঢাকায় মহাসমাবেশ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি। ওই সমাবেশ থেকে সরকারকে দাবি আদায়ে চূড়ান্ত আলটিমেটাম দিয়ে রাজপথে অবস্থান নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। বেধে দেয়া সময়ের মধ্যে দাবি না মানলে লাগাতার হরতাল, অবরোধসহ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়া হবে।

সূত্র জানায়, চূড়ান্ত আন্দোলনের পরও যদি সরকার বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করে সেই নির্বাচন যাতে গ্রহণযোগ্যতা না পায় সে ব্যাপারে দেশি-বিদেশি নানা শক্তির সহায়তা আশা করছে তারা। এ লক্ষ্যে কাজও শুরু করেছেন। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিদেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের এ ব্যাপারে অবহিত করার উদ্যোগ নেয়া হবে। পাশাপাশি দেশিয় বিভিন্ন পর্যবেক্ষক, সুশীল সমাজ, মিডিয়া যাতে এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা পালন করে সে লক্ষ্যেও কাজ করা হচ্ছে।

কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার: নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়ে বিভিন্ন মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের ওপর চাপ সৃষ্টি করার পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে বিএনপি। বিশেষ করে বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করার জোর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে কয়েকজন নেতাকে দায়িত্ব দিয়েছেন খালেদা জিয়া। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো যাতে বিএনপির প্রতি ইতিবাচক মনোভাব দেখায় সেদিকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। বিদেশিদের সমর্থন আদায়ে অনেক সময় আন্দোলনে কৌশল পরিবর্তন করতে হচ্ছে বলেও গুঞ্জন রয়েছে। নানা ইস্যুতে শক্তিশালী দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করছে তারা। সর্বশেষ গত সপ্তাহে খালেদা জিয়ার সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন মজিনা।

এদিকে দলের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফরে রয়েছেন। খালেদা জিয়াও বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র সফর করেন। ভারতবিরোধী বলে যে অভিযোগ রয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে দীর্ঘদিন পর ভারত সফর করেন খালেদা জিয়া। গত বছর ওই সফরে বর্তমান ক্ষমতাসীন কংগ্রেস ও বিরোধী দল বিজেপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন তিনি। তার ওই সফরের পর ভারত সরকার বিএনপির প্রতি কিছুটা নমনীয় হয়েছে বলে দাবি দলটির। এ ছাড়া চীন, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক বরাবরই ভালো। ওই সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করতে নিয়মিত সৌদি সফর করছেন খালেদা জিয়া।

কোন্দল নিরসন ও প্রার্থী বাছাই: সারাদেশে অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন ও আগামী নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে বিএনপিকে। ইতোমধ্যে মনোনয়নকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অভ্যন্তরীণ কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। দলটির হাইকমান্ড চাচ্ছে, নির্বাচনের আগে কোন্দল নিরসন করে দলকে শক্তিশালী করতে। সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন কম থাকলেও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে নির্বাচনে তার সুফল পাওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে। এ ছাড়া প্রার্থী বাছাই নিয়ে এখন থেকে ভাবতে হচ্ছে তাদের। কারণ গত সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ে তাড়াহুড়া এবং দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন করতে না পারায় বিএনপির ঘাঁটি বলে পরিচিত এমন অনেক আসনেও পরাজিত হয়েছে। দলের ভেতর দুর্নীতিবাজ ও সুবিধাভোগী নেতাদের বাদ দিয়ে সৎ, যোগ্য ও ক্লিন ইজেমের নেতাদের মনোনয়ন দিতে দেশি-বিদেশি নানা চাপ রয়েছে। দলের প্রভাবশালী অনেক নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির নানা অভিযোগ রয়েছে। তাদের নির্বাচন থেকে দূরে রাখার মতো কঠিন চ্যালেঞ্জ রয়েছে দলটিতে। অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন ও সঠিক প্রার্থী বাছাই করতে না পারলে এবারের নির্বাচনে প্রত্যাশিত রেজাল্ট নিয়ে অনেকের সংশয় রয়েছে।

ইতিমধ্যে দলের চেয়ারপারসনকে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে গঠিত সাতটি সাংগঠনিক টিমকে কোন্দল নিরসন ও সংগঠন পুনর্গঠনে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা কাজ করে যাচ্ছেন। এ ছাড়া সম্ভাব্য প্রার্থীদের ব্যাপারে নানা মাধ্যমে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। দেশি-বিদেশি কয়েকটি সংস্থা দিয়ে গোপনে জরিপও চালানো হয়েছে। নির্বাচনের আগে আরও কয়েক দফা জরিপ চালানো হতে পারে। এরপর তৃণমূলের নেতাদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে যোগ্য প্রার্থী বাছাইয়ের পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপির হাইকমান্ডের।