কোন্দল নিরসন নিয়ে সংশয় শাসকদলেই : জেলা নেতাদের সাথে সিরিজ বৈঠক

 

স্টাপ রিপোর্টার: অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটাতে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ জেলা নেতাদের সাথে সিরিজ বৈঠক শুরু করলেও এর সফলতা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন খোদ দলের নীতিনির্ধারকরা। বরং নানা ইস্যুতে দীর্ঘদিন ধরে কোন্দলে জড়িয়ে থাকা নেতাদের একত্রিত করলে নতুন কোনো সমস্যার সৃষ্টি হবে কিনা এ নিয়েও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছেন তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কেন্দ্রীয় নেতার মতে, কিছু জেলা ও উপজেলায় অভ্যন্তরীণ সমস্যা অনেক বেশি। নেতাদের পারস্পরিক সম্পর্ক এতটাই খারাপ যে তা সহসা নিরসন হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তাই কোন্দল নিরসনে দল কতটুকু সফল হবে এখনি তা বলা মুশকিল।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের খুলনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, চিহ্নিত কিছু সমস্যা সমাধানের বিষয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক জেলা নেতাদের সাথে কথা বলছেন। আশা করা যায় সেগুলো সমাধান হবে। এছাড়া সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং যে সব উপজেলা, থানা ও ইউনিয়নের কমিটি হয়নি সম্মেলনের মাধ্যমে তা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে সমস্যা সমাধান ও কোন্দল নিরসনে খুব বেশি সফলতার আশা করছেন না কেন্দ্রীয় নেতারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সাংগঠনিক সম্পাদক যায়যায়দিনকে বলেন, ‘দল বড়, সমস্যাও অনেক। সব সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান তো হবে না। আর অনেক জায়গায় বৈঠকের পরও সমস্যার সমাধান হয়নি। তাই সময় অতিবাহিত না হলে বলা যাবে না, সমস্যার সমাধান হলো কি না। তবে কোন্দল নিরসনের চাইতে সহিংসতা নিরসনের বেশি জোর দেয়া হচ্ছে এ ব্যাপারে আমরা আশাবাদী।’

সূত্র জানায়, ২৪ এপ্রিল কোন্দল মেটানোর বৈঠকে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সামনেই বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন যশোর জেলা নেতারা। একজন আরেকজনকে দোষারোপও করেন। এছাড়া চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক ও চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের কোন্দল মেটাতে কয়েকবার বৈঠক করা হলেও তাদের সংঘর্ষ-মারামারি থামেনি। সর্বশেষ একটি সমাবেশে দুইজন মিলে যাওয়ার কথা বললেও পরদিন সুইমিংপুল নিয়ে সংগঠিত সংঘর্ষ উভয় নেতার দ্বন্দ্বের ফসল হিসেবেই ভাবা হচ্ছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সাংসদ র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী ও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী ছায়েদুল হকের দ্বন্দ্বে সরকারের বিরুদ্ধেই হরতাল পালন করেছেন মোকতাদির চৌধুরী। এছাড়া রাজধানীতে গণপরিবহনের সিটিং সার্ভিস নৈরাজ্য বন্ধে সরকারের তরফ থেকে উদ্যোগ নেয়া হলেও তা থেকে পিছিয়ে আসা হয়।

সূত্র জানায়, পরিবহন নেতারা সবাই সরকারদলীয় লোক। এরপরও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সংকট ও নৈরাজ্য সমাধানে পরিবহন নেতাদের সাথে বৈঠক করলেও তারা কোনো কর্ণপাত করেনি বরং তারা পরিবহন সেক্টরে আরও বেশি অরাজকতা তৈরি করেছেন। এ ব্যর্থতা সরকার ও আওয়ামী লীগ উভয়েরই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আলোচনার মাধ্যমে কোন্দল নিরসন কতখানি সম্ভব হবে তা নিয়ে সন্দিহান সাতক্ষীরা জেলার সভাপতি মনসুর আহমেদ। তিনি মনে করেন, ‘কোন্দল মীমাংসায় সবাইকে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে একমত হতে হবে। তাহলে হয়তো সুফল আসতে পারে।’

সূত্র জানায়, জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকার নির্বচানের দলীয় মনোনয়ন, দলীয় পদ, দলীয় পদ-পদবি ও জনপ্রতিনিধিত্বের প্রভাব খাটিয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, ভূমি দখল, বালুমহল-জলমহলের দখল, সেতু-ফেরিঘাটের টোল আদায়, ডিশ ব্যবসা, বাস-টেম্পো-সিএনজি স্ট্যান্ড ও বাজারের চাঁদা আদায় নিয়েই নেতাদের যত বিরোধ ও কোন্দল। মারামারি-খুনোখুনির পেছনে মূল কারণ এগুলোই। সূত্রটির দাবি, ঢাকায় নেতাদের ডেকে নিয়ে বিরোধ মেটানোর জন্য তাগিদ দিলেও ভাগবাটোয়ারার সমাধান তো কেন্দ্রীয় নেতারা করে দেবেন না তাহলে সমস্যার সমাধান হবে কিভাবে? এছাড়া ক্ষমতার দীর্ঘ নয় বছরে দলে অনেক নেতা তৈরি হয়েছে যারা জাতীয় নির্বাচনে দলের মনোনয়ন চান। এই নেতারা বর্তমান নেতাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিভিন্ন পরিস্থিতি পার হয়ে নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছেন। তাই তারা সহজে ছাড় দিতে রাজি নয়।

অন্য একটি সূত্র জানায়, যেকোনো সমস্যার সমাধানে দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্ভরতা অনেক বেশি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিরোধ মীমাংসায় সাধারণ সম্পাদক নয়, দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার সাথে বসতে চান তৃণমূলের নেতারা। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকেও অনেক নেতা মানতে চান না। তাই সমস্যার সহসা সমাধানেও জটিলতা বেড়েছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের চাইতে অনেক মহানগর ও জেলা নেতা সিনিয়র ও এলাকাতে বেশি প্রভাবশালী হওয়ায় এই সমস্যা বেশি দেখা দিচ্ছে। নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনের সময় শামীম ওসমান ও সেলিনা হায়াৎ আইভীর দ্বন্দ্ব নিরসনে কেন্দ্রীয় নেতাদের বৈঠকে কোনো সমাধান না হলে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তা ঠিক হয়। কিন্তু চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ না করায় এখনো তার সমাধান হয়নি। গত ২৩ এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলা নেতাদের সাথে বিভিন্ন সমস্যার প্রেক্ষিতে বৈঠক করেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

এ বিষয়ে কুষ্টিয়া জেলার সভাপতি সদর উদ্দিন খান বলেন, কুষ্টিয়ায় দলে তেমন কোন্দল নেই। দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ এখানকার সমস্যা দেখাশোনা করেন। আমরা মনে করি, অল্পস্বল্প যে সমস্যা আছে তা কেটে যাবে। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা হস্তক্ষেপ করলে সমস্যার আরও দ্রুত সমাধান হবে। তবে সবার মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব থাকলে অভ্যন্তরীণ সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে মনে করেন চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজাদুল ইসলাম আজাদ।
কোন্দল কতখানি নিরসন হবে জানতে চাইলে তৃণমূলের এই নেতা বলেন, এ বিষয়ে পরিষ্কার কিছু বলতে পারব না। সমাধান না এলে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা হস্তক্ষেপ করবেন শেষ পর্যায়ে। সাধারণ সম্পাদকের পরে সভাপতি নিশ্চয়ই দেখবেন।

দলীয় সূত্র জানায়, বছরের শুরু থেকেই ঘর গোছানো ও আগামী নির্বাচনের প্রচারণার কৌশল হাতে নিয়ে এগোয় ক্ষমতাসীনরা। সে জন্য অঙ্গ সংগঠনের সম্মেলনের পাশাপাশি প্রত্যেক জেলায় উন্নয়ন মেলা করে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরা ও জেলা জেলায় কেন্দ্রীয় নেতাদের সফর অব্যাহত ছিলো। কেন্দ্রীয় নেতারা অনেকগুলো জেলায় সফর করে সংকট ও কোন্দল মিটিয়ে সংগঠনকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করেছেন। সংগঠন শক্তিশালী করা ও আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতির প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও জেলা সফর করেছেন। তিনি বগুড়া, লক্ষ্মীপুর, ফরিদপুর ও মেহেরপুর সফর করে নৌকার জন্য ভোট চেয়েছেন। কিন্তু হঠাৎ বিভিন্ন স্থানে কোন্দল ও খুনোখুনি বেড়ে যাওয়ায় নির্বাচনী প্রচারণা বাদ দিয়ে ঘর গোছাতে মনোযোগী হতে বাধ্য হয় দলটি।

প্রসঙ্গত, গত ১৯ এপ্রিল আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সভায় দলীয় বিরোধপূর্ণ জেলাগুলোর সাথে ধারাবাহিকভাবে মতবিনিময়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বৈঠক শেষে এ বিষয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় সাংগঠনিক অবস্থা, সংকট এবং সমাধান নিয়ে আমাদের সাংগঠনিক নেতারা তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেছেন। আমাদের কিছু কিছু সংকট আছে। সেগুলো আমরা ধারাবাহিকভাবে জেলা-উপজেলা নেতাদের ঢাকায় সভানেত্রীর কার্যালয়ে ডেকে এনে এ মাস থেকেই আলাপ-আলোচনা করে সমাধানের চেষ্টা করব।

এরপর ২৩ এপ্রিল কুষ্টিয়া এবং চুয়াডাঙ্গা, ২৪ এপ্রিল যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক এবং সংসদ সদস্যদের সাথে বৈঠক করে ওবায়দুল কাদের। এছাড়া ২৭ এপ্রিল নীলফামারী এবং ৪ মে বিকাল সাতক্ষীরার নেতাদের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।

এ বিষয়ে আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, আমাদের সব কর্মকা- একই গতিতে চলছে। তবে গরমের মাঝে হঠাৎ বর্ষা শুরু হওয়ায় সব দিক বিবেচনা করে আপাতত জেলা সফর ও নির্বাচনী প্রচারণার বিষয়টি পিছিয়ে সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য কোন্দল মিটানো ও বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে আলোচনা হচ্ছে। যাতে করে সামনের দিনগুলোতে নির্বাচনের জন্য ভালো প্রস্তুতি নেয়া যায়। এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও দলের অন্যতম মুখপাত্র মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, আমরা সংগঠন করি। সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড দিয়েই দ্বন্দ্ব-সংঘাত বন্ধের চেষ্টা করছি। সারা বিশ্বেই সামাজিক অস্থিরতা-উচ্চাকাঙ্ক্ষা বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ এর বাইরে নয়। আমরা চেষ্টা করছি, চেষ্টা চালিয়ে যাবো।

এ বিষয়ে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, দোষারোপ না করে জেলার রাজনীতিকে সবাই মিলে কোন্দলমুক্ত করতে হবে, ঐক্যবদ্ধ হয়ে সবাইকে কাজ করতে হবে। সংগঠনকে এগিয়ে নিতে হবে। সোমবার রাতে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে দলের স্থানীয় সরকার, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বিভাগওয়ারি তৃণমূল নেতাদের সাথে বৈঠক করবেন তিনি।