কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৬ কর্মকর্তা রিজার্ভ হ্যাকিংয়ে জড়িত

অর্থ খোয়া যাওয়ার ঘটনায় অর্থমন্ত্রীর কাছে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা

স্টাফ রিপোর্টার: রিজার্ভ চুরির ঘটনায় সরকার গঠিত তদন্ত কমিটির পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৬ জনের নাম এসেছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। এর আগে প্রাথমিক তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ জড়িত নয় এমনটি বললেও গতকাল সোমবার দেয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এ অবস্থান থেকে সরে এসেছে ড. ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত তদন্তকারী কমিটি। গতকাল অর্থমন্ত্রণালয়ে চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন অর্থমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন ড. ফরাসউদ্দিন। এরপর সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগে মনে হয়েছিলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এখন পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু কী ধরনের পরিবর্তন তা প্রতিবেদনের মধ্যে আছে। তিনি আরো বলেন, সুইফটেরও দায় দায়িত্ব আছে, সম্পূর্ণ দায় বা মূল দায় তাদের কি-না, সেই বিশ্লেষণও প্রতিবেদনে আছে। সুফইট কখনো দায় এড়াতে পারে না। তবে সুইফটের সাহায্য নিয়েই আমাদের ভবিষ্যতের সমস্যাটা সমাধান করতে হবে। চুরি যাওয়া টাকার মধ্যে কতোটা আদায় করা সম্ভব- তার একটা চিত্রও প্রতিবেদনে দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের আট কোটি ১০ লাখ ডলার গত ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে ফিলিপাইন ও শ্রীলংকার দুইটি ব্যাংকে সরানো হয়েছিলো ভুয়া বার্তা পাঠানোর মাধ্যমে। একইভাবে শ্রীলংকায় ২ লাখ ডলার সরানো হলেও শেষ মুহূর্তে তা আটকানো হয়। এর পর গত ১৫ মার্চ ৩ সদস্যের এ তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। এ কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন- বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উপ-সচিব গকুল চাঁদ দাস।

কমিটিকে ৩০ দিনের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্ট ও ৭৫ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছিলো। সে অনুযায়ী গত ২০ এপ্রিল অর্থমন্ত্রীর কাছে অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি। এরপর ৭৫তম দিনে গতকাল পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দেয়া হলো। এ ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের বলেন, বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকরা খুব বেশি হৈচৈ করেছে। অবশ্য এমন ঘটনা নিয়ে শুধু আমাদের দেশের নয়, সারাবিশ্বের সাংবাদিকরাই এমন করেন। তদন্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে এখন কিছু বলব না। এটা প্রকাশ করা হবে। আমি এটা পড়ে নেই। ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। এটার মধ্যে যা কিছু আছে তাই প্রকাশ করা হবে। তদন্ত প্রতিবেদনে শাস্তির সুপারিশ যদি থাকে তাহলে তা বাস্তবায়ন করা হবে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, যা কিছু থাকবে তাই প্রকাশ করা হবে।

তিনি আরো বলেন, এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন। কেননা, এটার প্রধান উদ্দেশ্যে হচ্ছে অভ্যন্তরীণ সংস্কার। আমাদের অনেক দোষ আছে, সেগুলো দেখানোই আসল উদ্দেশ্য। তিনি আরো বলেন, টাকা আদায়ের ব্যাপার তো অন্যখানে আছে। এজন্য ইনভেস্টিগেশন চলছে। টাকা আদায়ের ব্যাপার এটা না। এটা হচ্ছে টাকাটা কেন চলে গেল, এটা বের করার জন্যই। যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে।

তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন প্রতিবেদন সম্পর্কে বলেন, শর্ত অনুযায়ী ৭৫তম দিনেই প্রতিবেদন পেশ করা হলো। এর আগে দেয়া অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনের সঙ্গে বলতে গেলে চূড়ান্ত প্রতিবেদনের কিছুই মিল নাই। অনেক পরিবর্তন হয়েছে। একদম আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে। প্রায় ৯০ শতাংশই পরিবর্তন হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, আমরা দেখেছি কারা দায়ী। কে কোন উদ্দেশে কাজটা করেছে। বাইরের কোনো সাইবার অপরাধী জড়িত কি-না সেটা নির্ধারণ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। আমাদের কর্মপরিধিতেও তা ছিল না। কিভাবে টাকাটা আদায় করা সম্ভব তা দেখেছি। আমরা একটা আশাব্যঞ্জক চিত্র দিয়েছি। বাইরের কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান দায়ী সেটাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। যে এভিডেন্স আমরা পেয়েছি তাতে আমাদের পজিশন থেকে খুব বেশি একটা নড়তে পারিনি। এ রিপোর্টের মধ্যে আছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কি ধরনের সম্পৃক্ততা ছিল। এটা আমরা অনুসন্ধান করেছি। বিশ্লেষণ করেছি। এ বিষয়ে বেশি কিছু বলা ঠিক হবে না। উচিত হবে না। কারণ, সরাসরি সরকারকে আগে দেখতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের যাদের নাম এসেছে: তদন্ত প্রতিবেদন ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৬ জনের নাম এসেছে। তারা হলেন- অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের যুগ্মপরিচালক জুবায়ের বিন হুদা, উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান ভুঁইয়া, জিএম আব্দুল্লাহ ছালেহীন, শেখ রিয়াজউদ্দিন ও রফিক আহমেদ মজুমদার, গভর্নর সচিবালয় বিভাগে কর্মরত মইনুল ইসলাম। এদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা এবং অবহেলার কারণে সার্ভার হ্যাকিংয়ের ঘটনা ঘটেছে কিম্বা তারা হ্যাকারদের সহায়তা করেছেন এমনটাই ধারণা করা হচ্ছে। গভর্নর সচিবালয় বিভাগে কর্মরত মইনুল ইসলাম এবং অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের শেখ রিয়াজউদ্দিন তাদের ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড ‘কমপ্রোমাইজড’ হয়েছে কিম্বা ব্যবহার হয়েছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়- জুবায়ের বিন হুদা ও জি এম আব্দুল্লাহ ছালেহীনের ইউজার আইডির পাসওয়ার্ড চুরি করে তা ব্যবহার করেছে হ্যাকাররা। এমন কি এরাই আগে জানতে পারে তাদের পাসওয়ার্ড চুরি হয়েছে কিন্তু তারা সেটা আমলে নেয়নি। এতে তারা দায়িত্ব পালনে চরম অবহেলা করেছেন। কাণ্ডাজ্ঞানহীনের মতো কাজ করেছেন বলে উল্লেখ করেছে তদন্তকারী দল।