কুষ্টিয়ায় ২ মাস পর কবর থেকে লাশ উত্তোলন

মামলা হলেও ধরা ছোয়ার বাইরে আসামিরা হত্যাকাণ্ডের দুমাস পর কবর থেকে

তোলা হলো ব্যবসায়ী সজলের লাশ

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি: অবশেষে হত্যাকান্ডের প্রায় দু মাস পর আদালতের নির্দেশে গতকাল বুধবার কুষ্টিয়ার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কাজী মাহমুদুল হক সজলের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য কবর থেকে উত্তোলন করা হয়েছে। বুধবার দুপুর দুই টায় নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট এসএম মাজহারুল ইসলামের উপস্থিতিতে ব্যবসায়ী সজলের লাশ উত্তোলন করে পুলিশ। এ সময় কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. তাপস কুমার সরকার, হাসপাতালের চিকিৎসক উবাইদুর রহমান, চিকিৎসক আশরাফুল রহমান এবং মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা থানার ওসি তদন্ত আব্দুল খালেক উপস্থিত ছিলেন। ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হওয়ার পর ম্যাজিষ্ট্রেটের উপস্থিতিতে নিহতের লাশ পুনরায় দাফন করা হয়। নিহতের ভাই কাজী ইমাজ উদ্দিন দাবি করেন সুরতহালের সময় তার ভায়ের মাথার পেছনে একাধিক আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে ময়নাতদন্তকারী দলের চিকিৎসক কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. তাপস কুমার সরকার জানান, ভিসেরা রিপোর্ট ঢাকায় প্রেরণ করা হবে। রিপোর্ট হাতে পেলে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে।

এদিকে মামলা দায়ের হলেও আসামিরা গ্রেফতার না হওয়ায় মামলা তুলে নেয়ার জন্য বাদীসহ নিহতের পরিবারের সদস্যদের হুমকি দিচ্ছে বলে জানা গেছে। নিহতের পরিবার ও মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, কুষ্টিয়ার চৌড়হাস বিসিক এলাকার মৃত কাজী আনোয়ারুল হকের ছেলে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কাজী মাহামুদুল হক সজল চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা থানার লোকনাথপুর গ্রামের পিন্টু শাহ পোল্টি ফার্ম ওই গ্রামের মৃত আব্দুল ওয়াদুদ শাহর ছেলে পিন্টু শাহের কাছ থেকে ১০ বছরের জন্য লিজ নিয়ে লাইভ পোল্টি ফার্ম অ্যান্ড হ্যাচারী নামে বৃহৎ একটি পোল্টি ফার্ম গড়ে তোলেন। বর্তমানে ওই হ্যাচারীতে প্রায় ৪০ লাখ টাকার মুরগী রয়ে গেছে। ফার্ম পরিচালনার জন্য কাজী মাহামুদুল হক সজল নিজ বাড়ি ছেড়ে ফার্মের মধ্যেও বসবাস করে আসছিলেন। কুষ্টিয়ার জগতি চিনিকল সড়কের মো. আব্দুল হামিদের ছেলে মামলার ১ নং আসামি মো. নাজমুল হাসান মুরগির ফার্মে খাদ্য সরবরাহের কথা বলে বিভিন্ন লোকজনকে সাথে নিয়ে উক্ত ফার্মে যাতায়াত করতো। ফার্মে আসা-যাওয়া করার সুবাদে আসামি নাজমুল হাসান বৃহৎ এই ফার্ম দখলের পাঁয়তারা শুরু করে। এর অংশ হিসেবে গত ১৮ মার্চ রাত ৮টার দিকে দেশীয় অস্ত্র-সস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নাজমুলসহ ৮/৯ জন ব্যবসায়ী কাজী মাহামুদুল হক সজল ও তার ছোট ভাই কাজী ইমাজ উদ্দিনের কাছে ২০ লক্ষ টাকা চাঁদা দাবি করে। নাজমুলসহ অন্য আসামীরা ব্যবসায়ী কাজী মাহামুদুল হক সজলের বুকে ছুরি ধরে এক সফতাহের মধ্যে ২০ লাখ টাকা চাঁদা না দিলে হত্যা করা হবে বলে হুমকি দিয়ে যায়। ব্যবসায়ী কাজী মাহামুদুল হক সজল এ বিষয়ে নিজ হাতে জিডি লিখলেও অন্য জেলার বাসিন্দা এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখার স্বার্থে শেষ পর্যন্ত পরিবারের সদস্যদের পরামর্শে আইনী সহায়তা গ্রহণ করা থেকে নিবৃত থাকেন। নিহতের ছোট ভাই কাজী ইমাজ উদ্দিন ঘটনার দুই দিন পর গত ২০ মার্চ কুষ্টিয়া মডেল থানায় বড় ভাই কাজী মাহামুদুল হক সজল ও তার নিজের জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে ১ নং আসামি নাজমুল হাসান ও ২ নং আসামি কুষ্টিয়ার মিনাপাড়া এলাকার বরখাস্তকৃত এ এস আই আনিছুর রহমানের নামে একটি জিডি দায়ের করেন। জিডি নং- ৯৯৮। পরবর্তীতে নাজমুলের নেতৃত্বে আসামিরা গত ৩০ মার্চ পুনরায় ব্যবসায়ী কাজী মাহামুদুল হক সজলের নিকট পূর্বের দাবিকৃত ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে আসামীরা চাঁদা দেওয়া না পর্যন্ত ফার্মের মধ্যেই অবস্থান করা শুরু করে এবং ফার্মের মধ্যে মদ, গাঁজা, ফেন্সিডিল সেবনসহ নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকে। পূর্ব থেকে ফার্মে অবস্থানরত আসামিরা চাঁদার টাকা না পাওয়ায় গত পহেলা এপ্রিল বেলা ১২ টার দিকে নাজমুল এবং বহিষ্কৃত পুলিশের এএসআই আনিসুর রহমানসহ আসামিরা ব্যবসায়ী কাজী মাহামুদুল হক সজলকে ফার্মের মধ্যেই হাত-পা চেপে ধরে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে ফেলে রাখে। পরবর্তীতে ফার্মের কর্মচারীরা বিষয়টি টের পেয়ে গেলে আসামীরা তাদেরকে হুমকী-ধামকী দিয়ে ষ্ট্রোক করে মৃত্যু হয়েছে বলে এলাকায় প্রচার করতে থাকে এবং পরিবারের লোকজনকে না জানিয়েই গোসল করিয়ে লাশ কাফন পরিয়ে ফেলে। বাদী নিহতের ছোট ভাই কাজী ইমাজ উদ্দিন খবর পেয়ে বগুড়া থেকে রাতে ঘটনাস্থলে এসে দেখেন লাশের মাথায়, গলায়, নাকে, বাম কানের নিচের অংশে কপালের উপরেসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানেসহ আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। নিহতের পরিবারের লোকজন হত্যার বিষয়টি বুঝতে পেরে পুলিশকে জানাতে চাইলে আসামীদের হুমকী এবং প্রভাবশালীদের চাপে লাশ নিয়ে কুষ্টিয়া চলে আসতে বাধ্য হন এবং পরের দিন সকালে কুষ্টিয়ার চৌড়হাস মোড় গোরস্থানে দাফন করেন। দাফনের পূর্বে বাদী লাশের কয়েকটি ছবি তুলে রাখেন তাতে নিহতের শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখা যায়। পরবর্তীতে খোঁজ নিয়ে বাদী হত্যার বিষয়টি নিশ্চিত হন।

বাদী এ বিষয়ে দামুড়হুদা মডেল থানায় মামলা দায়ের করতে গেলে থানার ওসি মো: লিয়াকত হোসেন বাদীকে বলেন আপনার ভাই হার্ট এ্যাটাকে মারা গেছে, বিষয়টি ভুলে যান। এ বিষয়ে মামলা নেয়া যাবে না বলে ওসি বাদীকে সাফ সাফ জানিয়ে দেন। থানা মামলা গ্রহণ না করায় মামলার বাদী নিহতের ছোট ভাই কাজী ইমাজ উদ্দিন শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই গত ৮ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আমলি আদালতে অভিযোগ দাখিল করলে বিজ্ঞ বিচারক ড. এবিএম মাহমুদুল হক অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গণ্য করার জন্য দামুড়হুদা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লিয়াকত হোসেনকে নির্দেশ প্রদান করেন। ওসি লিয়াকত হোসেন অনিচ্ছা সত্বেও আদালতের নির্দেশে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে গত ১১ এপ্রিল থানায় মামলা গ্রহণ করেন। মামলা নং ১৫ । ধারা-৩৮৫/৩৮৭/৩০২/৩৪। আসামীরা হচ্ছে জগতি চিনিকল এলাকার আব্দুল হামিদের ছেলে নাজমুল হাসান, গত ১৫ আগষ্ট কুষ্টিয়া শহরের মজমপুর গেটে শোক দিবসের কর্মসূচি চলাকালে প্রকাশ্যে শর্টগান বের করে গুলি চালানো পুলিশের বরখাস্তকৃত এএসআই মিনাপাড়া এলাকার আনিসুর রহমান, চৌড়হাস চিনিকল সড়ক এলাকার জাহিদ এবং দামুড়হুদার ঈশ্বরচন্দ্রপুর গ্রামের রফিকুল ইসলাম রফিক। মামলার তদন্তভার দেয়া হয়েছে দামুড়হুদা থানার ওসি (তদন্ত) আব্দুল খালেকের উপরে।

এদিকে থানায় মামলা গ্রহণ করতে বাধ্য হলেও রহস্যজনক কারণে দামুড়হুদা থানা পুলিশ আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও আসামীদের গ্রেফতার করছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে নিহতের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। এদিকে আসামীরা গ্রেফতার না হওয়ায় ব্যবসায়ী কাজী মাহমুদুল হক সজল হার্ট এ্যাটাক করে মৃত্যু বরণ করেছে মর্মে প্রমাণের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। আলোচিত এই মামলার বাদী নিহত ব্যবসায়ী কাজী মাহমুদুল হক সজলের ছোট ভাই কাজী ইমাজ উদ্দিন জানান, হত্যাকাণ্ডের পর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে তার ভায়ের (নিহতের) রক্ত মাখা স্যান্ড গেঞ্জি তুলে দেওয়াসহ শরীরে নানা জখমের চিহ্নের ছবি দেখানো হলেও রহস্যজনক কারণে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা থানার ওসি রহস্যজনক কারণে মামলা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন। অনিচ্ছাসত্বেও অবশেষে আদালতের নির্দেশের পর চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা মডেল থানার ওসি লিয়াকত হোসেন থানায় মামলা এন্ট্রি করতে বাধ্য হলেও আসামীদের গ্রেফতারের বিষয়ে রহস্যজনক ভূমিকা পালন করছে বলে নিহতের পরিবার অভিযোগ করেছে। এ ঘটনায় দামুড়হুদা মডেল থানা পুলিশের ভূমিকা নিয়ে পরিবারের সদস্যদের মাঝে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।