কুষ্টিয়ায় সাত নিখোঁজের ভাগ্যে কি ঘটেছে

স্টাফ রিপোর্টার: কুষ্টিয়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ সাজ্জাদ হোসেন সবুজ, গড়াই ইটভাটার মালিক বিএনপি নেতা মিরাজুল ইসলাম মিরাজ, কুষ্টিয়া পৌরসভার কমিশনার আলেক মাহমুদ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিবিরের দু নেতা আল মোকাদ্দাস ও ওয়ালিউল্লাহ, কুমারখালী উপজেলার কয়া গ্রামের জাফর ইকবাল এবং সদর উপজেলার বালিয়াপাড়া গ্রামের রফিকুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ রয়েছেন। এই সাতজনকে হত্যার পর লাশ গুম করা হয়েছে বলে স্বজনদের অনেকেই আশঙ্কা করছেন। নিখোঁজ ব্যক্তিদের ভাগ্যে কি ঘটেছে- এ নিয়ে পুলিশের কাছেও সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে নিখোঁজ ব্যক্তিরা ফিরে আসবেন- এ আশায় এখনো বুক বেঁধে আছে তাদের পরিবারের সদস্যরা।

কুষ্টিয়া জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ সাজ্জাদ হোসেন সবুজ নিখোঁজ রয়েছেন প্রায় ছয় মাস ধরে। গত বছরের ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে যুবলীগ কর্মী সবুজ খুন হন। ওই হত্যা মামলায় সবুজকে প্রধান আসামি করা হয়। মামলা দায়েরের পর পরই তিনি আত্মগোপন করেন। পরে গত বছরের ২১ আগস্ট জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আক্তরুজ্জামান লাবু ও সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন সবুজকে ঢাকা গাজীপুরের একটি রিসোর্ট থেকে র‌্যাব অভিযান চালিয়ে আটক করে বলে সবুজের পরিবার থেকে কয়েক দফায় সংবাদ সম্মেলনে করে জানানো হয়। তবে র‌্যাব তাদেরকে আটকের বিষয় অস্বীকার করেছে।

গত বছরের ২৬ আগস্ট লাবু কুষ্টিয়ায় ফিরে এলেও সবজু নিখোঁজ রয়েছেন। সবুজের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস জিনিয়া বলেন, সবুজের সন্ধানে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারি দলের ক্ষমতাধর  নেতাদের কাছে বার বার ধর্ণা দিয়েছি। কিন্তু আজও তার কোনো খোঁজ পাইনি।

কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার গড়াই ইটভাটার মালিক বিএনপি নেতা মিরাজুল ইসলাম মিরাজ সাড়ে আট মাস ধরে নিখোঁজ রয়েছেন। তিনি কুমারখালীর চাপড়া ইউনিয়নের লাহিনীপাড়ার মৃত আব্দুল গণি শেখের ছেলে। গত বছর ৪ জুন রাত ৯টার দিকে মিরাজ তার ব্যবসার অংশীদার কোহিনূরের মোটরসাইকেলে লাহিনী বটতলা মোড়ে আসার পর নিখোঁজ হন। এ ঘটনায়  মিরাজের স্ত্রী শখি খাতুন গত বছরের ৫ জুন কুমারখালী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন, পরে সেটি অপহরণ মামলার হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়। ওই মামলার বেশ কয়েকজন আসামি গ্রেফতার হলেও এখনো পুলিশ অপহূতকে উদ্ধার করতে পারেনি। মামলারও কোনো কিনারা হয়নি।

কুমারখালীর কয়া গ্রামের সামসুদ্দিনের ছেলে কৃষক জাফর ইকবাল নিখোঁজ রয়েছেন সাড়ে তিন মাস ধরে। জাফরের স্ত্রী ববি জানান, গত বছর ৯ নভেম্বর রাত ১টার দিকে পুলিশের পোশাক পরা এবং পুলিশ পরিচয়ে ৫-৬ জন লোক এসে জাফরকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। ঘটনার পর কুমারখালী থানায় যোগাযোগ করা হলে জাফর নামে কোনো ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেফতার করেনি বলে থানার ডিউটি আফিসার জানান। পরবর্তী সময়ে গত ৩০ নভেম্বর জাফর ইকবালের পিতা সামসুদ্দিন বাদী হয়ে কুষ্টিয়ার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। কিন্তু আজও জাফরের সন্ধান মেলেনি।

কুষ্টিয়া সদর উপজেলার আলামপুর ইউনিয়নের বালিয়াপাড়া গ্রামের রফিকুল ইসলাম গত ৩ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টার দিকে মোটরসাইকেলযোগে বাড়ি থেকে কুষ্টিয়া শহরের উদ্দেশে বের হন। পথে গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেতু থেকে চার অস্ত্রধারী লোক রফিকুলকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তিনি নিখোঁজ রয়েছেন। এ ব্যাপারে রফিকুলের স্ত্রী শিলা বাদী হয়ে কুষ্টিয়া মডেল থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। লিখিত অভিযোগে শিলা অভিযোগ করেন, বালিয়াপাড়া পশুহাট ও বালিয়াপাড়া কলেজিয়েট স্কুল নিয়ে দুটি পক্ষের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব চলছিলো। এর জের ধরে প্রতিপক্ষের লোকজন রফিকুলকে অপহরণ করেছে। থানার এসআই রফিকের ওপর মামলার তদন্তভার দেয়া হলেও রফিকুল এখনো উদ্ধার হননি।

এদিকে ২০১২ সালের ৪ নভেম্বর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের দু ছাত্র, শিবিরের নেতা আল মোকাদ্দাস ও ওয়ালিউল্লাহ এবং ২০১০ সালের ২ এপ্রিল কুষ্টিয়া পৌরসভার নির্বাচিত কাউন্সিলর আলেক মাহমুদ অপহৃত হন। এখনো তাদের হদিস মেলেনি। অপহৃত ওই দু ছাত্র ঢাকা থেকে নৈশকোচে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরার সময় ঢাকার সাভারের নবীনগর এলাকায় র‌্যাব পরিচয়ে তাদের বাস থেকে নামিয়ে নেয়া হয়। এরপর থেকে তারা দুজনই নিখোঁজ রয়েছেন। আল মোকাদ্দাস বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-ফিক্হ বিভাগের এবং ওয়ালিউল্লাহ দাওয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্ট্যাডিজ বিভাগের ছাত্র ছিলেন। এ ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের আল-ফিক্হ ও দাওয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষকসহ ছাত্রছাত্রী ও অন্যান্য সংগঠনের নেতারা তাদের উদ্ধারের দাবিতে ক্লাস বর্জন, মানববন্ধন ও সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালন করেন।

এছাড়া নিখোঁজ দু ছাত্রকে উদ্ধারের জন্য ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহের পুলিশ সুপারকে লিখিত অভিযোগ দেয়া হয়। পাশাপাশি দু ছাত্রের পরিবারের পক্ষ থেকেও ওই সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে লিখিতভাবে অপহরণের ঘটনা জানানো হয়।

২০১০ সালের ২ এপ্রিল সন্ধ্যায় কুষ্টিয়া শহরের কাটাইখানা মোড় এলাকা থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে শাদা পোশাকে ৫-৬ জন লোক পৌরসভার কাউন্সিলর আলেক মাহমুদকে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে যায়। তবে আলেক মাহমুদকে আটকের বিষয়টি ডিবি পুলিশ স্বীকার করেনি। ওই ঘটনার পর থেকে আলেক মাহমুদ নিখোঁজ রয়েছেন।

নিখোঁজ এই সাত ব্যক্তি কি আদৌ বেঁচে আছেন, নাকি তাদের হত্যার পর লাশ গুম করা হয়েছে- এ সংক্রান্ত কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য কারো কাছে নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে কে বা কারা ওই ব্যক্তিদের উঠিয়ে নিয়ে গেছে পুলিশের কাছেও এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই।

জানতে চাইলে কুষ্টিয়া পুলিশ সুপার প্রলয় চিসিম জানান, ইবির দু ছাত্র নিখোঁজের ঘটনাটি কুষ্টিয়া এলাকায় ঘটেনি। অন্যদের মধ্যে অপহৃত মিরাজের মামলার তদন্ত চলছে। এছাড়া স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা সবুজ একটি হত্যা মামলার আসামি হওয়ায় পুলিশ তাকে খুঁজছে। কিন্তু এখনো তার সন্ধান মেলেনি। নিখোঁজ অন্যদের বিষয়ে তদন্ত অব্যাহত রয়েছে বলে দাবি করেন পুলিশ সুপার।