কুষ্টিয়ায় পুলিশের সাথে গুলির লড়াই ॥ গাংনীর লালনসহ নিহত ২

গাংনী প্রতিনিধি: কুষ্টিয়া শহরতলির বাড়াদী কবরস্থান এলাকায় ও ভেড়ামারা উপজেলার ১২ মাইলে পুলিশের সাথে আলাদা দুটি বন্দুকযুদ্ধে আট মামলার আসামি সোবহান ও হাফডজন মামলার আসামি লালন নামের দু সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে। বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় সাত পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্র উদ্ধার করেছে। মঙ্গলবার দিনগত রাতে ওই বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। নিহত হাসানুজ্জামান ওরফে লালন মেহেরপুর গাংনী উপজেলার মানিকদিয়া গ্রামের আলী মালিথার ছেলে। তার নামে ছিনতাই, ডাকাতি ও বোমা বিস্ফোরণের সাথে জড়িত বিষয়ে গাংনী ও কুষ্টিয়া থানায় ছয়টি মামলা রয়েছে।
কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নুর হোসেন খন্দকার জানান, মঙ্গলবার দিনগরত রাতে ভেড়ামারা উপজেলার ১২ মাইলে সড়কে গাছ ফেলে ডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছে ডাকাতদল। এমন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ সেখানে গেলে ডাকাতদলের সদস্যরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। পুলিশও এ সময় পাল্টা গুলি ছোড়ে। বন্দুকযুদ্ধের এক পর্যায়ে ডাকাতদল পিছু হটে পালিয়ে যায়। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ডাকাত দলের সদস্য গুলিবিদ্ধ লালন নামের একজনকে উদ্ধার করে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়। সেখানে কর্তৃব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে একটি সর্টগান ও দেশীয় ধারালো অস্ত্র তিনটি হেঁসো উদ্ধার করে।
অপরদিকে কুষ্টিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাসির উদ্দিন জানান, কুমারখালীর মনোহরপুর গ্রামের মৃত নুরুদ্দীনের ছেলে সোবহান হোসেন ডাকাতি ও অস্ত্রসহ মোট আট মামলার আসামি। একটি মামলায় তিন বছর সাজাভোগ শেষে সম্প্রতি সে জেলখানা থেকে বের হয়ে নাটোরের বড়াইগ্রামে বসবাস শুরু করে। গত মঙ্গলবার কুষ্টিয়া পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। জিজ্ঞাসাবাদে সে অস্ত্রের সন্ধান দয়। তাকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে বাড়াদী কবরস্থানে গেলে সেখানে ওত পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। পুলিশও এ সময় পাল্টা গুলি চালায়। বন্দুকযুদ্ধের একপর্যায়ে পালাতে গিয়ে সোবহান গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়। পুলিশ সেখান থেকে একটি পিস্তল, একটি এলজি সার্টারগান ও দুইটি ধারালো অস্ত্র হেঁসো উদ্ধার করেছে। দুজনের মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল বুধবার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছে পুলিশ। পৃথক দুটি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় কুষ্টিয়া ও ভেড়ামারা থানায় মামলা দায়ের করেছে পুলিশ।
এদিকে নিহত হাসানুজ্জামান ওরফে লালনের মরদেহ গতকাল সন্ধ্যায় সাতটার দিকে নিজ বাড়িতে নেয়া হয়। রাতেই জানাজা শেষে গ্রাম্য কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়েছে। হাসানুজ্জামান ওরফে লালন এলাকায় সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিতি। কারো কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক আবার কারো কাছে প্রিয় মুখ। এলাকার কিছু ছিঁচকে চোরের সঙ্গদোষে সে অন্ধকার জগতে পাড়ি জমায় বলে জানায় একটি সূত্র। ছোটখাটো অপরাধের মধ্যদিয়ে আন্ডারওর্য়াল্ডে প্রবেশ করে। কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার সাথেও সখ্য গড়ে ওঠে। পুলিশের খাতায় তার বিরুদ্ধে সড়কে ছিনতাই, বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ডাকাতি ও ইটভাটাসহ বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে চাঁদাবাজির ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে।
গাংনী থানার একটি সূত্র জানায়, গাংনী ও কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা থানায় লালনের নামে ৫টি মামলা রয়েছে। ২০১৩ সালে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে গাংনী থানার তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের হয়। বোমা ফাটিয়ে ডাকাতির অভিযোগে দায়ের করা মামলার মধ্যদিয়ে প্রশাসনসহ বিভিন্ন মহলের নজরে আসে লালন। ওই মামলায় জামিনে মুক্ত হয়ে সে অন্ধকার জগতের সঙ্গে আবারো যুক্ত হয়। বিস্ফোরক ও ডাকাতির মামলায় গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপন করে। গোপনে জামিন নিয়ে সে এলাকা ছাড়ে। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠেয় ইউপি নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণায় অংশ নেয়ার মধ্যদিয়ে আবারো এলাকায় আত্মপ্রকাশ করে লালন। এক চেয়ারম্যান প্রার্থীর পক্ষে সরাসরি প্রচারণায় নামে। ওই সময় তার বিরুদ্ধে পেশিশক্তি প্রয়োগের অভিযোগ ওঠে।
এদিকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পর এলাকায় আবারও আধিপত্য বিস্তার শুরু করে লালন। ২০১৬ সালের ২২ জুন রাতে গাংনীর আমতৈল-ভোলাডাঙ্গা মাঠের সড়কে ছিনতাইকারীদের হামলায় ৪ গরু ব্যবসায়ী আহত হন। ছিনতাইকারীদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে বাবলু মিয়া (৪৭) নামের এক গরু ব্যবসায়ী গুরুতর আহত হন। বাকি তিনজনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। ওই ঘটনার পর থেকে ছিনতাইকারী গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছিলেন গাংনী থানার ওই সময়কার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা ওসি আকরাম হোসেন। রাতেই মানিকদিয়া গ্রামের আব্দুল আজিজের ছেলে মিজানুর রহমান মোমিন (২৬) ও তার ভাই আবুল কালাম (৩০), একই গ্রামের মুক্তাকুল ইসলামের ছেলে মহিবুল ইসলাম (৩৮) এবং পাশর্^বর্তী হেমায়েতপুর গ্রামের আক্কাস আলীর ছেলে আব্বাব আলীকে (৪০) গ্রেফতার করে পুলিশ। পরদিন সকালে লালনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার ৫ জনকে গরু ব্যবসায়ীদের ওপর হামলা ও ছিনতাইয়ের মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে সোপর্দ করে পুলিশ। বেশ কিছুদিন পর জামিন পেয়ে বাড়ি ফেরে। তবে জামিনের পর তার বিরুদ্ধে ইটভাটায় চাঁদাদাবির অভিযোগ ওঠে বলে জানায় গাংনী থানার একটি সূত্র।
এদিকে ২০১৩ সালের দিকে এলাকায় বিভিন্ন ডাকাতি, ছিনতাই ও বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় লালনের জড়িত থাকার অভিযোগ আসতে থাকে পুলিশে কাছে। একপর্যায়ে সে এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে প্রশাসনের কাছে পরিচিতি পায়। পর্যায়ক্রমে তার নামে মামলা দায়ের হতে থাকে। তবে জামিনে মুক্ত হয়ে এলাকায় ফিরলে আবারো সেই পুরাতন অভিযোগে অভিযুক্ত হতে থাকে।
এদিকে গতকাল দুপুরে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিহত লালনের স্ত্রীসহ পরিবারের সদস্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করে সাংবাদিকদের বলেন, লালন এতো খারাপ ছেলে নয়। তাকে সন্ত্রাসী ও ডাকাত বানানোর অপচেষ্টা হয়েছে। এলাকার চিহ্নিত কিছু মানুষের রোষানলে পড়ে বার বার মামলার আসামি হয়েছে। জামিন পেলেও তার বিরুদ্ধে আবারো মিথ্যা অভিযোগ করে তার নামে মামলা দেয়া হয়েছে। কিছু মানুষ তাকে ব্যবহারও করেছে। গত মঙ্গলবার কুষ্টিয়া থেকে তাকে পুলিশ পরিচয়ে গ্রেফতার করা হয়েছিলো বলেও দাবি করেন তার পরিবারের সদস্যরা।
গাংনী থানার ওসি (তদন্ত) কাফরুজ্জামান বলেন, নিহত হাসানুজ্জামান লালনের নামে গাংনী থানায় ৪টি মামলা রয়েছে। কুষ্টিয়া ও ভেড়ামারা থানায় মামলা রয়েছে। পুলিশের খাতা ও স্থানীয় মানুষের কাছে সে এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত।