কুষ্টিয়ার দৌলতপুর গোবরগাড়ার দৃষ্টিহারা আবদুল্লাহ ও তার মায়ের সংগ্রাম

 

 অদম্য মেধাবীর পাশে দাঁড়ালো সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়

স্টাফ রিপোর্টার: ছেলের পড়া মোবাইলফোনে রেকর্ড করেন মা। মোবাইলফোনের রেকর্ড শুনে পড়া আয়ত্বে নেয়া অদম্য মেধাবী দৃষ্টিহারা শিক্ষার্থী এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। তাকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে। মোটা অংকের অনুদান প্রদানের ঘোষণা দয়ে বলা হয়েছে, ভর্তি-সংক্রান্ত যাবতীয় খরচ বহন ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেলে তার পড়ার খরচ বাবদ মাসিক সরকারি উপবৃত্তি ও অনুদান দেয়ার ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

ঢাকা থেকে প্রকাশিত পত্রিকায় ‘অদম্য মা, মেধাবী ছেলে’ শিরোনামে প্রতিবেদনটি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাছিমা বেগমের দৃষ্টিগোচর হয়। বিষয়টির প্রতি সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। মন্ত্রী এ বিষয়ে একজন সাধারণ মায়ের অসাধারণ ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব, প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সমাজসেবা অধিদপ্তরে মহাপরিচালককে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন।সে অনুযায়ী সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে মেধাবী শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আল শাইমকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি সহায়তার জন্য তাত্ক্ষণিকভাবে সমাজকল্যাণ পরিষদ থেকে ১০ হাজার টাকা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।আগামী ১৫ অক্টোবর বিশ্ব সাদা ছড়ি নিরাপত্তা দিবসে এই অদম্য মা ও মেধাবী ছেলেকে আনুষ্ঠানিক সম্মাননা দেয়ার বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে সংশ্লিষ্টসূত্র জানিয়েছে।

প্রকাশিত সচিত্র প্রতিবেদনে বলা হয়, দৃষ্টিশক্তিহারা ছেলের পড়া রেকর্ড করেন মা। মোবাইলফোনে ওই রেকর্ড মন দিয়ে শোনেন ছেলে। এটাই তার পড়ার একমাত্র উপায়।মা-ছেলের অনবদ্য এই প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয়েছে। এবার এইচএসসি পরীক্ষায়জিপিএ-৫ পান আবদুল্লাহ আল শাইম। আর সাধারণ এক নারী চায়না খাতুন হয়ে ওঠেনঅদম্য মা।মায়ের তৈরি করা পড়ার রেকর্ড শুনেই এবার কুষ্টিয়ার দৌলতপুরউপজেলার পিপলস ডিগ্রি কলেজের মানবিক বিভাগ থেকে পরীক্ষা দিয়েছেন আবদুল্লাহ।তিনি পরীক্ষা দিয়েছেন শ্রুতিলেখকের সহায়তায়।আবদুল্লাহ জন্মান্ধ ছিলেননা। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রথম তিনি বুঝতে পারেন তার দুই চোখেইসমস্যা হচ্ছে। কোনো কিছুই ভালো করে দেখতে পেতেন না। কিন্তু চিকিৎসকেরকাছে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। ভাত-বস্ত্রের সংস্থানই ঠিকমতো হয় না তাদের। কিন্তুচোখের সমস্যা দিনে দিনে মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। আবদুল্লাহ চিকিৎসকের কাছেগিয়েছেন ঠিকই, ততো দিনে তার দুচোখ প্রায় দৃষ্টিশূন্য হয়ে গেছে।আবদুল্লাহরবাড়ি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার গোবরগাড়া গ্রামে। তার বাবা মনিরুলইসলাম কৃষিকাজ করে সংসারের খরচ মেটান। মা চায়না খাতুন গৃহিণী। একমাত্র বোনস্থানীয় ডিজিএম হাইস্কুলে পড়ে। সংসার খরচ চালানোর জন্য তাদের সহায়-সম্বলবলতে আছে আড়াই বিঘা জমি।

অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় আবদুল্লাহকেচক্ষুচিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে ওই যাওয়া পর্যন্তই! অর্থকষ্টেরকারণে তার যথাযথ চিকিৎসা আর হয়ে ওঠেনি। চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, আবদুল্লাহরদুচোখ ‘রেটিনাইটস পিগসোনটোসা’ রোগে আক্রান্ত।ঢাকার ইসলামিয়া চক্ষুহাসপাতালের সাবেক চিকিৎসক বর্তমানে মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসাকর্মকর্তা (মেডিকেল অফিসার) আবদুল্লাহ হেল আজম বলেন, এটি জেনেটিক (বংশগত)রোগ। এর কারণে দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে কমে যায়। রোগী রাতের বেলা একদমইদেখতে পায় না। এই রোগের ভালো চিকিৎসাও নেই। এই রোগের কারণে সম্পূর্ণঅন্ধ হয়ে যাওয়া ব্যক্তির চলাফেরাসহ স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য লো ভিশনএইড (অতি ক্ষীণ দৃষ্টির অধিকারী ব্যক্তিদের জন্য সহায়ক বিভিন্ন উপকরণ) নিতেপারে।প্রায় অন্ধ অবস্থায় এসএসসি পরীক্ষা দিতে হয় আবদুল্লাহকে।পরীক্ষার হলে টেবিলের দুপাশে দুটি টেবিলল্যাম্প জ্বেলে কোনো রকমে পরীক্ষাশেষ করেন তিনি। প্রশ্নই ঠিকমতো পড়তে পারতেন না তিনি। মন ভেঙে দেয়া সেইপরীক্ষার কথা আজও ভুলতে পারেননি আবদুল্লাহ। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৪পেয়ে পাস করেন তিনি।

ফল ঘোষণার পর আবদুল্লাহর পরিবার শেষ চেষ্টা হিসেবেকুষ্টিয়া থেকে তাকে ঢাকায় নিয়ে আসে। আরও দু-তিনজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরসঙ্গে পরামর্শ করেন তারা। শেষমেশ আবদুল্লাহকে নেয়া হয় ফার্মগেট এলাকারইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতাল ও ইস্পাহানী ইনস্টিটিউট অব থালমোলোজিতে। ততো দিনেতিনি পুরোপুরি অন্ধ হয়ে গেছেন।

ঢাকা থেকে ফেরার পর আবদুল্লাহর পরিবারকুষ্টিয়া শহরের একটি প্রতিবন্ধী স্কুলে যোগাযোগ করে। সেখানে ব্রেইলপদ্ধতিতে লেখাপড়া হয়। তবে সেখান থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিতে হলে তাকে শহরেথাকতে হতো। সেই খরচ তার পরিবারের পক্ষে মেটানো সম্ভব ছিলো না। কিন্তুলেখাপড়ার প্রতি আবদুল্লাহর আগ্রহ দেখে ওই স্কুলের কর্মকর্তা এনামুল হক (বর্তমানে প্রয়াত) তাকে ক্যাসেটে পড়া রেকর্ড করে তা শোনার পরামর্শ দেন।এই পদ্ধতি তার ভালো লাগলে শ্রুতিলেখক দিয়ে তিনি এইচএসসি পরীক্ষা দিতেপারবেন বলে তিনি জানান। পরে বাড়িতে ফিরে তার মায়ের পরামর্শে মুঠোফোনেইপড়া রেকর্ড করে এইচএসসি পরীক্ষা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন আবদুল্লাহ।

লেখাপড়ারপ্রতি আগ্রহ ছিলো আবদুল্লাহর মা চায়না খাতুনেরও। তবে হাজার প্রতিকূলতাপেরিয়ে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত বিদ্যালয়ে গেছেন তিনি। নিজের অপূর্ণতা পূরণেরজন্য বেছে নিয়েছিলেন দুই ছেলে-মেয়েকে। মায়ের আশা পূরণে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেনআবদুল্লাহও। ক্লাসে কখনো দ্বিতীয় হননি তিনি।
পিপলস ডিগ্রি কলেজেরউপাধাক্ষ্য আবু সাঈদ মো. আজমল হোসেন জানান, এবার তার কলেজ থেকে ২৭৮ জনশিক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন। তাদের মধ্যে শুধু আবদুল্লাহইজিপিএ-৫ পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হলেও নিয়মিত ক্লাস করারপাশাপাশি ক্লাসে মনোযোগী থাকতো সে। এ ছাড়া কলেজের নির্বাচনী পরীক্ষায়সম্মিলিত মেধাতালিকায় প্রথম হয় সে। এ কারণে কলেজ কর্তৃপক্ষ তার বেতন মাফকরে দেয়। তার পরীক্ষার আবেদনপত্র জমা দেয়ার (ফরম ফিলাপ) টাকাও দেয় কলেজ।’

মাচায়না খাতুন বলেন, ‘দৃষ্টি হারানোর পরও আবদুল্লাহ কখনো মনোবল হারায়নি।সারাদিন সংসারের কাজ শেষ করে রাতের বেলায় মুঠোফোনে পড়া রেকর্ড করেদিতাম। পরে সেটা শুনে আবদুল্লাহ আয়ত্ত করত। ওর স্মৃতিশক্তি খুব ভালো।দু-একবার শুনলেই পড়া আয়ত্ত করে নিতে পারত। পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলেবৃত্তি পেয়েছে সে।’ছেলের সাফল্য চায়না খাতুনের গর্বে বুক ভরে যায়সত্যি। তবে এর আড়ালে বিষাদও আছে। ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে পড়ার খরচআর সংসার খরচ চলবে কীভাবে? বাড়িতে দুটি গরু ছিলো। একটা গরু ২০ হাজার টাকায়বিক্রি করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ওই টাকা দিয়ে ছেলেকে কোচিংকরাচ্ছেন। কিছু টাকা রেখে দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফরম কেনার জন্য।প্রতিদিন মায়ের সঙ্গেই কোচিঙে যান আবদুল্লাহ।
কোথায় উচ্চশিক্ষা নিতেচান জানতে চাইলে আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমার ইচ্ছা ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বা রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হওয়া। আর মাস্টার্সশেষ করে শিক্ষকতা করতে চাই।’