কিলিং মিশনে ছিলেন র‌্যাবের ১৮ সদস্য

তারেকের তত্ত্বাবধানে অপহরণের পর হত্যায় নেতৃত্ব দেন আরিফ ও রানা

স্টাফ রিপোর্টার: নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাতজনকে অপহরণ ও হত্যার ঘটনায় সরাসরি নেতৃত্বদিয়েছেন ৱ্যাবের সাবেক কর্মকর্তা মেজর (অব.) আরিফ হোসেন ও লে. কমান্ডার (অব.) এম এম রানা। আর ৱ্যাব-১১’র সাবেক সিও লে. কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদমাহমুদ পুরো হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি তদারকি করেছেন। হত্যা মিশনে ছিলেনৱ্যাবে১৮ জন সদস্য। এর বাইরে নূর হোসেনের দেয়া দুজন চালকসহ পাঁচজন ছিলেন। রানারনেতৃত্বে ছিলেনৱ্যাবের ৮ জনের একটি টিম আর আরিফের নেতৃত্বে ছিলো ১০ জনের একটিটিম। ঘটনার পরদিন সকালে অপহরণ ও হত্যার বিষয়টি নিশ্চিত হয় ৱ্যাব সদর দফতর।এরপর পুরো ঘটনাটি প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে জানানো হয়। ফলে লাশ উদ্ধারেরপর ৱ্যাবের ওই তিন কর্মকর্তাকে নিজ নিজ বাহিনীতে ফেরত পাঠিয়ে বাধ্যতামূলকঅবসর দেয়া হয়।

পুলিশের কাছে দেয়া জবানবন্দিতে পুরো বিষয়টি বর্ণনাকরেছেন আরিফ ও রানা। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৱ্যাব সদর দফতরকে অবহিত নাকরেই গোপনে এ মিশন বাস্তবায়ন করেছে ৱ্যাব-১১। এ মিশনের জন্য এমএম রানামাত্র ১২ লাখ টাকা পেয়েছেন। সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছেন আরিফ। তিনি গত একবছর ধরে নূর হোসেনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। আর তারেক সাঈদের সঙ্গে গত ৭এপ্রিল নূর হোসেনের পরিচয় করিয়ে দেন আরিফ। তবে তারেক সাঈদ কতো টাকা পেয়েছেনতা নিশ্চিত করতে পারেননি আরিফ ও রানা। আরিফ বলেছেন, ৭ এপ্রিল স্যারেরসঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর নূর হোসেনই স্যারকে ম্যানেজ করেছেন। এরজন্য কতোটাকার দেনদরবার হয়েছে তা নূর হোসেন বা স্যারই বলতে পারবেন। আমাদের কাছেস্যারও কিছু প্রকাশ করেননি।

অপহরণের পর থেকে তারেক ও আরিফেরমধ্যেই মোট ২৩ দফা কথোপকথন হয়। ওই সময়ের মধ্যে ৱ্যাব সদর দফতরের কোনোসিনিয়র কর্মকর্তার ফোনকল রিসিভ করেননি আরিফ।

তদন্তকারীরা জানান, ৭এপ্রিল নূর হোসেনের সঙ্গে তারেক সাঈদের পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর থেকে এইহত্যা মিশন শুরু হয়। তারা দেখেছেন মোবাইলফোনে নূর হোসেনের সঙ্গে নিয়মিতকথা হতো আরিফ ও রানার। এর বাইরে নূর হোসেনের বাসায় এবং অফিসেও অবাধেযাতায়াত ছিলো তাদের। বিশেষ করে মেজর আরিফ ও নূর হোসেনের সখ্য পারিবারিকপর্যায়েও ছিলো। তারা একে অপরের বাসায় বহুবার গেছেন। নূর হোসেনের কাছ থেকেটাকা পাওয়ার পর মেজর আরিফ দ্রুত নজরুলের অবস্থান ও তাকে চেনাতে তাগাদা দেননূর হোসেনকে।

তদন্তকারীরা জানান, ৱ্যাব সদর দফতরকে আড়ালে রেখেকাজটি খুব দ্রুত শেষ করার জন্য আরিফ মাঝে মাঝেই নজরুলের সঠিক অবস্থানজানানোর জন্য নূর হোসেনকে চাপ দিতেন। এ কারণে নূর হোসেন এবং তার লোকজনঢাকায় এসে নজরুলের অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য চেষ্টা করতেন। গত ১১ এপ্রিলমেজর আরিফ মোবাইলফোনে নূর হোসেনকে ২/১ দিনের মধ্যেই কাজ শেষ করার জন্যনজরুলের বাসা চিনিয়ে দিতে বলেন এবং সেই সাথে তিনি নিজেই এ অপারেশন করবেনবলে জানান। দেরি হয়ে গেলে এ কাজে বাধা আসবে বলে তিনি নূর হোসেনকে অবহিতকরেন।

তদন্তকারীরা জানান, গত ১৮ এপ্রিল নজরুল বাড়িতে আছে এমন তথ্যপেয়ে মেজর আরিফ তাকে হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে নজরুলের বাড়ির আশপাশে দুপুরথেকে অবস্থান নেন। নজরুল বাড়ি থেকে বের হয়ে ঢাকার দিকে রওয়ানা হলেই মাঝপথথেকে তাকে অপহরণ করবেন। রাত ১২টা পর্যন্ত বাসার সামনে অবস্থানের পরওনজরুলের কোনো সাড়া-শব্দ না পাওয়ার পর নূর হোসেন আরিফকে অপেক্ষা না করেচলে যেতে বলেছিলেন। পরদিন সকাল থেকে পুনরায় মেজর আরিফ নজরুলের বাসার সামনেঅবস্থান নিয়েছিলেন। একইভাবে সারাদিন অপেক্ষা করে রাতে তিনি নূর হোসেনকেআশাহত হওয়ার বিষয়টি অবহিত করেন। নূর হোসেন এ সময় আরিফকে জানান, নজরুল বাড়িথেকে চুপিসারে চলে গেছেন।

তদন্তকারীরা বলছেন, আরিফকে ঘটনার পরদিনভোর রাতে এবং তারেককে ২৯ এপ্রিল সকালে তলব করেছিলোৱ্যাব সদর দফতর। সেখানেপ্রথমদিকে তারা অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের সাথে তাদের সম্পৃক্ততার বিষয়টিঅস্বীকার করলেও কিছু তথ্যপ্রমাণাদি হাজিরের পর একপর্যায়ে তারা স্বীকারকরেন। চারদিকে অপহরণের বিষয়টি নিয়ে হৈচৈ ও খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে যাওয়ায়তারেক মেজর আরিফকে ফোন করে অপহূতদের দ্রুত ক্লিয়ারকরার নির্দেশ দেন।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২৭ এপ্রিল সকাল থেকেই দফায় দফায় মোবাইলে কথোপকথনহতে থাকে তারেক, রানা ও আরিফের মধ্যে। প্রতিটি মুহূর্তের চিত্র তারা একেঅপরকে ফোনে অবহিত করতে থাকেন। ওই দিন আরিফের সাথে তারেকের সর্বমোট ২৩ বারকথা হয়। ওই দিন নারায়ণগঞ্জ আদালতে নজরুলের হাজিরা দেয়ার কথা আছে বলে তারাজানতে পারেন। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আরিফ আদালত প্রাঙ্গণের বাইরে নজরুলেরজন্য অবস্থান নেন। সকালে তিনি রানাকে জানান, নজরুল কোর্টের দ্বিতীয় তলায়আছেন। রানা যেন সিভিল টিম নিয়ে মুভ করেন। নজরুলের সাথেওই সময় প্রচুর লোকথাকায় কাজটা ভালো সমন্বয়ের মাধ্যমে করতে হবে। এ সময় আরিফ আরো বলেন, বিষয়টি সিও (লে. কর্নেল তারেক) জানেন। পরবর্তীতে আরিফ পুনরায় রানাকেতাড়াতাড়ি আসার তাগাদা দিয়ে বলেন, সিও বলেছেন কোর্টের আশপাশে অপহরণ না করেসামনে অন্য কোথাও করতে। পরবর্তীতে রানা অপহরণে ব্যবহূত গাড়ির নম্বর প্লেটবদলানোর জন্য আরিফকে বলেন। আরিফ কোর্টে নজরুলের অবস্থান পুনর্নিশ্চিত করারজন্য নূর হোসেনকে জিজ্ঞাসা করলে কোর্টে নজরুল নিশ্চিত আছেন বলে জানান।

তদন্তকারীদেরআরিফ বলেছেন, তিনি পুনরায় রানাকে আসার জন্য তাগাদা দেন এবং বলেন, সিওকে সববলা হয়েছে। অভিযানটি জটিল বলে রানার জরুরি সাহায্য দরকার। দুপুরে আরিফনজরুলকে দেখতে পেয়ে আবার নূর হোসেনের সাথে যোগাযোগ করেন। তখন নূরহোসেন জানান, নজরুলের পরনে সাদা পাঞ্জাবি। আরিফ তখন নূর হোসেনের সাথেপরামর্শ করে ঠিক করেন, গাড়িতে ওঠার পর যারা নজরুলের সাথে থাকবেন তাদেরসবাইকেই তিনি অপহরণ করবেন। এ সময় রানা টহল কমান্ডারের সঙ্গে কথা বলে তাদেরশিবু মার্কেটের একটু পেছনে থাকতে বলেন। একই সাথে আটজনের আরেকটি দলপ্রস্তুত করার জন্য আদেশ দেন। এর একটু পরই তিনি শিবু মার্কেটে অবস্থানরতটহল পার্টিকে সাবধানে কাজ করার জন্য ও ধাক্কাধাক্কি না করার জন্য উপদেশ দেনএবং তিনিও আসছেন বলে জানান। নতুন দলটিকে পাঠানোর জন্য ক্যাম্পে কোনোগাড়ি নেই জানানো হলে রানা ওদের ৱ্যাব পিকআপে করেই চাষাঢ়া মোড়ে পাঠাতেনির্দেশ দেন।পরবর্তীতে দুপুরে রানা পুনরায় শিবু মার্কেটের দলটিকেস্টেডিয়ামের কাছে ময়লার ডিবির কাছে লিঙ্ক রোডে চেকপোস্ট বসাতে বলেন এবংআদেশ দিলে গাড়ি থামানোর কাজ শুরু হবে বলে জানান। নজরুলের গাড়ি কোর্ট থেকেবের হয়ে লিঙ্ক রোড ধরে ঢাকার দিকে রওয়ানা হলে রানা লিঙ্ক রোডেরচেকপোস্ট পার্টিকে জানান, দুটি প্রাইভেট কার আসছে, একটি কালো আর তারপেছনে শাদা কার। ঢাকার দিকে যাচ্ছে এবং ৩১ সিরিয়ালের গাড়ি। চেকপোস্টে যেনগাড়ি দুটোকেই থামানো হয়। নজরুলের গাড়ির পেছনের গাড়িতে এ্যাডভোকেট চন্দনসরকার ও তার চালক বিষয়টি দেখে ফেললে তাদেরও জোরপূর্বক অন্য গাড়িতে তুলেনেয়া হয়। এ সময় রানাও টিম নিয়ে ঘটনাস্থলে ছিলেন। অপহরণের পর সাতজনকে নিয়েমেজর আরিফ দুটি মাইক্রোবাসে করে নরসিংদীর দিকে চলে যান। এ সময় আরিফ লে.কমান্ডার রানাকে নজরুল ও চন্দন সরকারের গাড়ি দুটি দ্রুত অন্য চালক দ্বারাটঙ্গীর দিকে নিয়ে যেতে বলেন। ঘটনার পরপরই নূর হোসেনকে আরিফ নিশ্চিত করেন, তার সঙ্গে অপহরণকৃত সবাই আছেন। দুপুরের দিকে নারায়ণগঞ্জ থেকে নরসিংদীযাওয়ার পর পুনরায় মাঝরাতের দিকে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া থানার ফেরিঘাটে ফিরেআসেন। সেখান থেকে নৌপথে তারা কাঁচপুরে যান। সেখান থেকে লাশগুলো নৌকায়তুলে ইটের বস্তা বেঁধে শীতলক্ষ্যা নদীতে নিয়ে ফেলে দেয়া হয়।