কাশ্মির সেনাঘাঁটিতে জঙ্গি হামলা : ১৭ ভারতীয় সেনা নিহত

 

মাথাভাঙ্গা মনিটর: ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের উরির সেনা ঘাঁটিতে জঙ্গি হামলায় ১৭ জন সেনাসদস্য নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন। সেনা ঘাঁটিতে থাকা তাবুতে আগুন ধরে বেশিরভাগ সৈন্য নিহত হয়েছেন। গতকাল রোববার ভোরে এই হামলা চালানো হয়। নিরাপত্তা বাহিনীর পাল্টা হামলায় চার জঙ্গিও নিহত হয়েছে। হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেছে ভারত। হামলায় পাকিস্তানের সাথে নিয়ন্ত্রণ রেখা বন্ধ হয়ে গেছে। সম্প্রতি বছরগুলোর মধ্যে এই হামলাকে সবচেয়ে বড় ধরনের হামলা বলে মনে করা হচ্ছে। ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীসহ বিরোধী রাজনীতিকরা এই হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং গতকাল জরুরি বৈঠক করেছেন। তিনি তার যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া সফর বাতিল করেছেন। কাশ্মিরের মুখ্যমন্ত্রী এই হামলাকে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা বলে অভিহিত করেছেন।

হামলা হয় যেভাবে: রাজধানী শ্রীনগর থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে উরির সেনা ঘাটিতে বন্দুক ও গ্রেনেড নিয়ে হামলা চালায় জঙ্গিরা। তারা নিরাপত্তা বেড়াজাল ভেদ করেই সেনা ঘাঁটিতে প্রবেশ করে। ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে এই হামলা চালানো হয়। সে সময় আক্রান্ত সৈন্যরা তাঁবুতে ঘুমাচ্ছিলেন এবং গ্রেনেড আক্রমণে তাদের তাঁবুতে আগুন ধরে গেলে তারা নিহত হন। আক্রমণে অন্তত ৩০ জন সৈন্য আহত হয়েছেন। ঘুম থাকার কারণে প্রথম দিকে সেনাবাহিনী কিছু বুঝে উঠতে পারেনি। প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে সেনাবাহিনীও পাল্টা হামলা চালায়। দুপক্ষের মধ্যে প্রায় ছয় ঘণ্টা গুলির লড়াই চলে। সকাল দশটার দিকে সেনাবাহিনী জানায়, পাল্টাপাল্টি হামলায় ১৭ সেনা সদস্য ও  চার জঙ্গি নিহত হয়। সেনাবাহিনী সূত্রে জানা গেছে, সেনাবাহিনীর দ্বাদশ ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারের কাছে সীমান্ত লাগোয়া ওই সেনাঘাঁটিতে আত্মঘাতী হামলা ঘটানোই ছিলো জঙ্গিদের উদ্দেশ্য। কিন্তু সেনাবাহিনীর তত্পরতায় সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এদের মধ্য কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। হামলার খবর পাওয়া মাত্রই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং তার যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া সফর বাতিল করে দেন। যোগাযোগ করেন কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্যপালের সাথে। রাজনাথ সিং টুইট করেন, হামলার ঘটনা নিয়ে জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীর সাথে কথা হয়েছে। তারা পুরো বিষয়টি আমাকে জানিয়েছেন। গোটা পরিস্থিতি নিয়ে একটি জরুরি বৈঠকও করেন। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল, গোয়েন্দা ব্যুরো প্রধান দ্বিনেশ্বর শর্মা, ভারতের মিলিটারি অপারেশনের ডিরেক্টর জেনারেল (ডিজিএমও) লে. জেনারেল রণবীর সিং, প্রতিরক্ষা সচিব জি মোহন কুমার, সিআরপিএফ এর মহাপরিচালক দুর্গা প্রসাদ এবং স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।

সেনাবাহিনী সূত্রে জানা গেছে, আরো এক জঙ্গি লুকিয়ে থাকার আশঙ্কা করা হচ্ছে। পুরো এলাকায় চিরুনি তল্লাশি চালাচ্ছে সেনাবাহিনী। শনিবারেই কাশ্মীরে বিএসএফ’র আইজি বিকাশ চন্দ্র জানিয়েছিলেন, গত দু মাসে নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে জঙ্গিদের ৩০ জনের একটি দল কাশ্মীরে ঢুকে পড়েছে। তারা বিভিন্ন এলাকায় আত্মগোপন করে রয়েছে। তিনি আরো জানান, বুরহান ওয়ানির মৃত্যুর পর যেভাবে কাশ্মীর অশান্ত হয়ে উঠেছিলো, সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই জঙ্গিরা কাশ্মীরে ঢুকে পড়ে। গত ১০ ও ১১ সেপ্টেম্বর পুঞ্চে পুলিশের সাথে জঙ্গিদের গুলির লড়াইয়ে এক কনস্টেবল নিহত হন, আহত হন এক সাব-ইন্সপেক্টর। অন্যদিকে নওগাঁওয়ে সেনার সাথে লড়াইয়ে ৭ জঙ্গি নিহত হয়। এর আগে ২০০২ সালে শ্রীনগর থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে কালুচকে সেনাবাহিনীর কোয়ার্টারে জঙ্গি হামলায় ৩০ জন নিহত হন। যাদের মধ্যে সেনা সদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্যরা ছিলেন।

হামলাকারীরা উচ্চ প্রশিক্ষিত: কাশ্মীরের ভারত-পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণরেখার কাছেই এ আক্রমণ ঘটে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং টুইটারে এক বার্তায় জানিয়েছেন, হামলাকারীরা যে উচ্চ প্রশিক্ষিত ছিলো এবং তাদের সাথে বিশেষ ধরনের যন্ত্রপাতি ছিলো – তার সুনির্দিষ্ট আভাস পাওয়া গেছে।

পাকিস্তানকে দায়ী করেছে ভারত: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং এক টুইটার বার্তায় পাকিস্তানকে একটি সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র বলে আখ্যায়িত করে বলেন, তিনি ক্ষুব্ধ যে তারা (পাকিস্তান) এখনো সন্ত্রাসবাদকে অব্যাহত এবং প্রত্যক্ষ সমর্থন দিয়ে চলেছে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হংসরাজ আহির হামলার জন্য সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করেছেন। তিনি জানান, ঈদের দিন হামলার চেষ্টা চালিয়েছিলো তারা। কিন্তু না পেরে সুযোগ বুঝে আজকে হামলা চালিয়েছে পাকিস্তানি জঙ্গিরা। এই ধরনের হামলা ভারত বরদাস্ত করবে না বলেও তিনি হুঁশিয়ারি দেন তিনি। তবে পাকিস্তান সরকারের একজন মুখপাত্র বিবিসির কাছে এ ঘটনায় তাদের জড়িত থাকার ভারতীয় দাবি সরাসরি অস্বীকার করেছেন। ডিজিএমও রনবীর সিং জানিয়েছেন, উরিতে হামলা চালিয়েছে জয়শ-ই-মহম্মদ (জেইএম)। হামলার স্থল থেকে যেসব জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়েছে তাতে পাকিস্তানের নাম বা প্রতীক খোদাই করা। তিনি জানান, পাকিস্তানকে বিষয়টি জানানো হয়েছে এবং গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। তিনি আরো জানান, জঙ্গিরা সবাই বিদেশি। তারা জেইএম এর সদস্য। জঙ্গিদের কাছে প্রচুর অস্ত্রসশস্ত্র ছিলো। নিহত জঙ্গিদের কাছ থেকে চারটি একে-৪৭ রাইফেল ও চারটি আন্ডার ব্যারেল গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়েছে। রনবীর সিং বলেন, প্রত্যেকটি হামলার যোগ্য জবাব দেয়া হবে। এজন্য সেনাবাহিনী তৈরি হচ্ছে। হামলার পরিস্থিতি সরেজমিন খতিয়ে দেখতে গতকালই কাশ্মীর গেছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর। ভেনিজুয়েলায় ন্যাম সম্মেলনেও ভারত পাকিস্তানের নাম উল্লেখ না করে বলেছেন, প্রতিবেশি একটি রাষ্ট্র সন্ত্রাসকে মদদ দিচ্ছে।

হামলার বিরুদ্ধে সরব সরকার ও বিরোধীরা: ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি জঙ্গি হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, জঙ্গি ও তাদের মদদদাতাদের অশুভ চক্রান্ত ভারত নস্যাত্ করে দেবে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডার রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বলেন, এই হামলা করে ভারতকে পরাস্ত করা যাবে না। পাকিস্তানের নাম উল্লেখ না করে বলেন, ভারতে হামলার পেছনে যারা আছে তাদের কঠিন জবাব দেওয়া হবে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী টুইটারে এক বার্তায় এই হামলার তীব্র নিন্দা করেছেন। তিনি বলেছেন, হামলাকারীরা রেহাই পাবে না। তাদের কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে। কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি বলেছেন, জম্মু কাশ্মীরে সহিংসতা উস্কে দিতে এবং এই অঞ্চলে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করতেই এই হামলা চালানো হয়েছে। তিনি বলেছেন, ভারত ও পাকিস্তানের শত্রুতার শিকার হচ্ছে কাশ্মীরের জনগন। তাদেরকে জীবন দিয়ে চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে।

কংগ্রেসের নেতা এবং সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং এই ধরনের হামলা ঠেকাতে পাকিস্তানকে কড়া বার্তা দেয়া উচিত। অতীতে পাকিস্তানকে বিশ্বাস করে আমরা বড় ধরনের ভুল করেছি। শাড়ি, শাল, বিরিয়ানি আর মিষ্টি পাঠিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরির কূটনীতি এখন বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। প্রবীন কংগ্রেস নেতা ও কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী গুলাম নবী আজাদ বীরত্বের সঙ্গে হামলা মোকাবেলা করায় সেনাবাহিনীর প্রশংসা করেছেন। গোয়ার মুখ্যমন্ত্রী লক্ষীনাকান্ত পারেসকরওয়াজ বলেছেন, পাকিস্তানের বিষয়ে ভারত সরকারকে আরো কড়া মনোভাব গ্রহণ করতে হবে। সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, সন্ত্রাসের মাধ্যমে নয়, রাজনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত।

উল্লেখ্য, ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে গত প্রায় দু-মাস ধরে সহিংস বিক্ষোভ চলছে এবং এতে ৮০ জনেরও বেশি সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছে। সম্প্রতি কাশ্মীরের প্রধান শহর শ্রীনগরে ছররা গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া এক স্কুল ছাত্রের মৃতদেহ পাওয়া যাওয়ার পর পুরো রাজ্যজুড়ে জারি করা হয়েছে কঠোর সান্ধ্য আইন। সেখানে লোকজনের চলাফেরা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর এ যাবতকালের সবচেয়ে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। কাশ্মীরে সম্প্রতি এক বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাকে গুলি করে হত্যার পর সেখানে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে ফের ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়।