কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর

ঢাকা অফিস: জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ গতরাত ১০টা ১ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে সর্বোচ্চ আদালত কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ করে দেন। এরপরই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। সন্ধ্যায় পরিবারের সদস্যরা কাদের মোল্লার সাথে শেষ দেখা করেন। সংবাদমাধ্যমের বদৌলতে সাথে সাথেই এ খবর ছড়িয়ে পড়ে দেশ বিদেশ।

মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ঘাট হয়ে অ্যাম্বুলেন্স ফরিদপুরের সদরপুরে জামায়াত নেতার বাড়িতে যাবে বলে কারাফটকে কর্তব্যরত খিলগাঁও থানার ওসি শেখ সিরাজুল ইসলাম জানিয়েছেন। রাত ১০টা ১ মিনিটে এ যুদ্ধাপরাধীকে ফাঁসিতে ঝোলানোর প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা পর রাত ১১টা ১৪ মিনিটে কারা ফটক দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স বের হয়।

গতরাত ৮টায় একজন ম্যাজিস্ট্রেট, ঢাকার সিভিল সার্জন কারাগারে প্রবেশ করেন। রাত ৯টা ২৮ মিনিটে জেল সুপার ফরমান আলী একটি টিম নিয়ে কেন্দ্রীয় কারাগারে ফেরেন। তিনি বলেন, জেলকোড অনুযায়ী জেল সুপারের নির্দেশে ফাঁসি কার্যকর হয়। এর আগে থেকেই ছয়জন জল্লাদকে প্রস্তুত রাখা হয়। এদের নেতৃত্বে রয়েছে সিনিয়র জল্লাদ শাহজাহান ভূঁইয়া। ফাঁসি কার্যকর করাকে কেন্দ্র করে সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে। ঢাকা মেহেরপুরসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় জামায়াত-শিবিরের সাথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষেরও খবর পাওয়া গেছে। কেন্দ্রীয় কারাগারের চারপাশের রাস্তাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। একমাত্র মিডিয়াকর্মী ও কর্তৃপক্ষ ছাড়া অন্য কাউকেই প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। এছাড়া আশপাশের প্রতিষ্ঠানের লোকদের সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে কর্মস্থল ত্যাগ করতে বলা হয়েছে।

এদিকে রাত ৮টার দিকে কাদের মোল্লার আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকসহ পাঁচ আইনজীবী দেখা করার জন্য আবেদন জানালে কারাকর্তৃপক্ষ তা ফেরত দেয়। কারাকর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তার সাজা কার্যকর করার সব প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়েছে। এখন আর তার সাথে দেখা করতে দেয়া যাবে না। এর আগে মঙ্গলবার কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে কারা কর্তৃপক্ষ। সরকারের পক্ষ থেকেও জানানো হয়, এদিন রাত ১২টা এক মিনিটে কাদের মোল্লার সাজা কার্যকর করা হবে। বিষয়টি জানতে পেয়ে ওইদিন সন্ধ্যায় কাদের মোল্লার আইনজীবীরা সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের বাসায় গিয়ে মৃত্যুদণ্ডের রায় পুনর্বিচেনার জন্য রিভিউ আবেদন ও সাজা কার্যকর স্থগিত রাখার আবেদন জানান। এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি ওই দিন রাত ১০টা ২০ মিনিটে সাজার কার্যকারিতার ওপর স্থগিতাদেশ প্রদান করলে ফাঁসি কার্যকরের বিষয়টি নাটকীয় মোড় নেয়। এরপর বুধবার সকাল থেকে রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি হয়। দু দিনের শুনানি নিয়ে বৃহস্পতিবার আপিল বিভাগ কাদের মোল্লার রিভিউয়ের আবেদন খারিজ করে দেন। এর ফলে সাজা কার্যকরের প্রক্রিয়া আবারও সচল হয়। খারিজ আদেশের পর রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, কাদের মোল্লার রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন আপিল বিভাগ সর্বসম্মতভাবে খারিজ করে দেয়ায় তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে আর কোনো আইনগত বাধা নেই। চেম্বার জজের আদেশে যে প্রক্রিয়া বন্ধ হয়েছিলো, তা এখন চালু হলো।

এদিকে রিভিউ খারিজ আদেশের পর কাদের মোল্লার আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক ও খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজের মধ্য দিয়ে তিনি ন্যায়বিচার পাননি। খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আমরা আশা করি এবং বিশ্বাস করি, দেশে যেখানে আইনের শাসন কায়েম আছে, সেখানে এ ধরনের রায় দিয়ে কাদের মোল্লার ওপর ন্যায়বিচার করা হয়নি। তিনি ন্যায়বিচার পাননি। সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে আমাদের আর কিছু বলার নেই। যতোক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ রায় না পাব এবং রায় না পেয়ে কারা কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নেবে না, এটাই সাধারণ নিয়ম, সাধারণ আইন। আবদুর রাজ্জাক বলেন, কাদের মোল্লা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। একজন সাক্ষীর ওপর নির্ভর করে (যে সাক্ষী তিন জায়গায় তিন ধরনের কথা বলেছেন) মৃত্যুদণ্ড প্রদান আইনের শাসনের পরিপন্থি। আমরা মনে করি, রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি পাওয়ার পর সরকার যা কিছু করতে চায়, আইন ও কারাবিধি মেনেই তা করবে। কাদের মোল্লার ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়ে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, ক্ষমা প্রার্থনার কথা তিনি ডিনাই (প্রত্যাখ্যান) করেননি। আমরা আজকে আদালতে বলেছি, ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রাণভিক্ষার জন্য তার হাতে সময় আছে। আগেও বলেছি, প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি-না এ বিষয়ে ২১ ও ২২ ডিসেম্বর আমাদের সাথে বসে তিনি চূড়ান্তভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন। সেই সময় এখনও আছে বলে আমরা মনে করছি। জেল কোডে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য সাত দিনের বিধান আছে- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে আবদুর রাজ্জাক বলেন, আইনে ১৫ দিনের বিধান আছে। সুপ্রিমকোর্ট আমাদের বলেননি, আমরা কেন নতুন আইন দেখাচ্ছি। নতুন আইন এলে পুরাতন আইন বাতিল হয়ে যায়। তখন নতুন আইনই বাস্তবায়ন হয়, পুরাতন হতে পারে না। এদিকে বিকলেই সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার কার্যালয় থেকে রিভিউ আবেদন খারিজের আদেশ কারা কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

রিভিউ আবেদন খারিজ হওয়ার খবর পাওয়া পরে বিকেলে সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আইন উপদেষ্টা ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের নেতৃত্বে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও কর্মকর্তারা একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেন। এ বৈঠকে সরকারের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমসহ অন্যান্য আইন কর্মকর্তারাও যোগ দেন। বৈঠকে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করাসহ নানা আইনগত বিষয় ও দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় বলে সূত্র জানায়। এদিকে জানতে চাওয়া হলে বৃহস্পতিবার বিকেলে কারামহাপরিদর্শকের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত সচিব মাইন উদ্দিন খন্দকার বলেন, সরকারের নির্দেশ এলেই কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করা হবে। আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছি। আপিল বিভাগের রায়ের কপি আমরা হাতে পেয়েছি।

কঠোর নিরাপত্তাবলয়: এদিকে রিভিউ আবেদন খারিজ হওয়ার পর বিকেল থেকেই কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে নাজিমউদ্দিন রোডসহ আশপাশ এলাকায় কঠোর নিরাপত্তাবলয় গড়ে তোলা হয়। কারাগারের চারদিকে থাকা সব উঁচু ভবনের ছাদে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। ভবনের বাসিন্দাদের রাত ৮টার মধ্যে বাসস্থানে চলে আসতে এলাকায় মাইকিং করেছে পুলিশ। পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা রাস্তায় টহল দিচ্ছে।
শেষ দেখা: সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় পরিবারের সদস্যরা শেষবারের মতো কাদের মোল্লার সাথে কারাগারে দেখা করেন। স্বজনদের মধ্যে স্ত্রী সানোয়ারা জাহান, ছেলে হাসান জামিল, হাসান মওদুদ, মেয়ে আনাতুল্লাহ পারভিনসহ ১০ জন। সিনিয়র জেলসুপার ফরমান আলীর রুমের সামনে একটি কক্ষে কাদের মোল্লার সাথে তারা কথা বলেন।

দু থানায় মামলা: ‘মিরপুরের কসাই’খ্যাত আবদুল কাদের মোল্লা একাত্তরে ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে মোস্তফা নামের এক ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগে ২০০৭ সালের ১৭ ডিসেম্বর কাদের মোল্লাসহ কয়েকজন জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে কেরানীগঞ্জ থানায় মামলা হয়। এছাড়া ২০০৮ সালে পল্লবী থানায় আরও একটি মামলা হয় কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে। এ দুটি মামলাতেই ২০১০ সালের ১৩ জুলাই তাকে গ্রেফতার করা হয়। তারপর থেকেই কারাবাস শুরু। গ্রেফতারের পরপরই তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ অভিযোগের তদন্ত ও অনুসন্ধান শুরু করে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত টিম। গত ৫ ফেব্রুয়ারি তার বিচার শেষে ট্রাইব্যুনাল তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেন। তার বিরুদ্ধে আনীত ৬টি অভিযোগের মধ্যে ৫টি প্রমাণিত হয়েছে বলে ট্রাইব্যুনালের রায়ে উল্লেখ করা হয়। এরপর তার মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে শাহবাগে শুরু হয় দুর্বার আন্দোলন। কিন্তু আইন অনুযায়ী সরকারের কোনো আপিল করার সুযোগ না থাকায় বাধ্য হয়ে আইনে পরিবর্তন আনা হয়। এরপর তার সাজা বাড়াতে আপিল করে সরকার। পাশাপাশি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ থেকে খালাস চেয়ে আপিল করেন কাদের মোল্লা। উভয় আপিলের শুনানি শেষে গত ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। ৫ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি প্রকাশিত হয়। এ রায়টি ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হলে ট্রাইব্যুনাল ৮ ডিসেম্বর কাদের মোল্লার মৃত্যুপরোয়ানা জারি করেন।

ট্রাইব্যুনালের বিচার: গত বছরের ২৮ মে ট্রাইব্যুনাল-২ কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি ঘটনায় তার বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। ৫ ফেব্রুয়ারি তার বিচার শেষে ট্রাইব্যুনাল তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেন। তার বিরুদ্ধে আনীত ৬টি অভিযোগের মধ্যে ৫টি প্রমাণিত হয়েছে বলে ট্রাইব্যুনালের রায়ে উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে এক, দু ও তিন নম্বর অভিযোগে ১৫ বছর করে কারাদণ্ড এবং ৫ ও ৬ নম্বর অভিযোগে যাবজ্জীবন করে কারাদণ্ড দেয়া হয়। এছাড়া ৪ নম্বর অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হয়।
ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন ও আইন সংশোধন: ৬ অভিযোগের মধ্যে ৫টি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গত ৫ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। বেঞ্চের অপর দু সদস্য ছিলেন বিচারপতি মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম। ট্রাইব্যুনালের রায়ে কাদের মোল্লার ফাঁসি না হওয়ায় সারাদেশে আন্দোলন শুরু হয়। তার ফাঁসির দাবি ওঠে। ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে গড়ে ওঠে গণজাগরণ মঞ্চ। কিন্তু যে আইনে বিচার হচ্ছে সেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন-১৯৭৩ অনুযায়ী একবার সাজা হলে তার বিরুদ্ধে সরকারপক্ষের আপিলের কোনো সুযোগ ছিলো না। এর ফলে কাদের মোল্লার সাজা বাড়াতে আইনি বাধা ছিলো। এ অবস্থায় জনরোষের মুখে সরকার ১৭ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের আপিল-সংক্রান্ত ধারা সংশোধন করে আইন পাস করে। সংশোধনীতে সাজা বাড়ানোর জন্য সরকারপক্ষের আপিলের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। ৬ অভিযোগের মধ্যে ৫টিতে দেয়া সাজাকে অপর্যাপ্ত দাবি করে কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড চেয়ে ৩ মার্চ আপিল করে সরকারপক্ষ। ৪ মার্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে খালাস চেয়ে আপিল করেন কাদের মোল্লা। এরপর আপিল বিভাগে এ আপিলের শুনানি শুরু হয়।

আপিল শুনানি ও গুরুত্বপূর্ণ দুটি আইনগত প্রশ্ন: কাদের মোল্লার মামলায় করা আপিলের ওপর শুনানি ১ এপ্রিল শুরু হয়। দীর্ঘ ৩৯ কার্যদিবস দু পক্ষের আপিলের ওপর শুনানি গ্রহণ করেন আপিল বিভাগ। আপিল শুনানিকালে দুটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। তা হলো, যে আইনে বিচার হচ্ছে সেই আইনে ট্রাইব্যুনাল থেকে দণ্ড ঘোষণার পর ওই আইনে আনা সংশোধনী কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি-না এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর অধীনে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ক্ষেত্রে ‘কাস্টমারি ইন্টারন্যাশনাল ল’ (প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন) প্রযোজ্য হবে কি-না।

আসামিপক্ষ দাবি করেন, আপিলের সমান সুযোগ রেখে ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩ সালের আইনের যে সংশোধনী আনা হয়েছে তা কাদের মোল্লার মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। কারণ কাদের মোল্লার বিচার আইন সংশোধনের আগেই শেষ হয়েছে। এছাড়া ‘কাস্টমারি ইন্টারন্যাশনাল ল’ এ বিচারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে বলেও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা দাবি করেন।
এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে আইনগত পরামর্শদানের জন্য ২০ জুন সুপ্রিমকোর্টের ৭ জন বিজ্ঞ ও প্রবীণ আইনজীবীকে এ মামলায় অ্যামিকাস কিউরি (আদালতকে আইনগত পরামর্শদানকারী) হিসেবে নিয়োগ দেন আপিল বিভাগ। তাদের মধ্যে এ সংশোধনী আবদুল কাদের মোল্লার মামলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে বলে মতামত দেন ৫ জন। তারা হচ্ছেন- ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম, ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি ও ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ। অন্য দুই এমিকাস কিউরি সিনিয়র আইনজীবী টিএইচ খান ও সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এএফ হাসান আরিফ মনে করেন, এটি প্রযোজ্য হবে না। তাদের মতে, কাদের মোল্লার বিচার শেষ হওয়ার পর এ সংশোধনী আনা হয়েছে। এছাড়া ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, মাহমুদুল ইসলাম, এএফ হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি মনে করেন, সর্বোচ্চ আদালত হিসেবে আপিল বিভাগের অন্তর্নিহিত ক্ষমতা রয়েছে যে কোনো মামলার সাজা বাড়ানো বা কমানোর। এতে কেউ আপিল না করলেও কাউকে অপরাধ অনুযায়ী কম সাজা দেয়া হয়েছে নাকি বেশি সাজা দেয়া হয়েছে- সুপ্রিমকোর্ট তার অন্তর্নিহিত ক্ষমতাবলে খতিয়ে দেখতে পারেন। অন্যদিকে ‘কাস্টমারি ইন্টারন্যাশনাল ল’ (প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন)-এর আওতায় এ মামলা পড়বে বলে ৩ জন, পড়বে না বলে দুজন এবং অন্য দু’জন ভিন্ন ধরনের মতামত দিয়েছেন। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ও ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদের মতে, এ ট্রাইব্যুনালের ক্ষেত্রে প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন প্রযোজ্য নয়।

অন্যদিকে ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, মাহমুদুল ইসলাম ও এএফ হাসান আরিফের মতে, প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন প্রযোজ্য হবে। আর ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসির মতে, প্রযোজ্য হবে যদি তা দেশীয় আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। দেশীয় আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে এটি প্রযোজ্য হবে না। টিএইচ খানের মতেও প্রযোজ্য হবে। তবে তিনি মনে করেন, যে ক্ষেত্রে দেশীয় আইনের সাথে আন্তর্জাতিক আইনকে সাংঘর্ষিক বলে মনে হবে, সে ক্ষেত্রে দেশীয় আইন প্রাধান্য পাবে।

চূড়ান্ত রায়ে ফাঁসি: ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতামতের ভিত্তিতে আবদুল কাদের মোল্লাকে এক সংক্ষিপ্ত আদেশে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন। তার বিরুদ্ধে আনীত সরকারপক্ষের ষষ্ঠ অভিযোগ একাত্তরে মিরপুরের হযরত আলী, তার স্ত্রী, দু মেয়ে ও দু বছরের ছেলেকে হত্যা এবং ১১ বছরের মেয়েকে ধর্ষণের সাথে সংশ্লিষ্টতার ঘটনায় তাকে এ দণ্ড দেয়া হয়। প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ৫ বিচারপতির বেঞ্চ এ রায় দেন। বেঞ্চের অপর সদস্যরা ছিলেন- বিচারপতি এসকে সিনহা, বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি এএইচএম শাসুদ্দিন চৌধুরী। ৫ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি প্রকাশিত হয়। রায়ের কপি থেকে দেখা যায় মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে রায় প্রদানকারী ৪ জন বিচারপতি হচ্ছেন- প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি এসকে সিনহা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী। এছাড়া বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পক্ষে রায় প্রদান করেছেন। মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে দেয়া রায়ে বলা হয়েছে, মৃত্যুদণ্ডই কাদের মোল্লার একমাত্র যথার্থ শাস্তি। তার অপরাধগুলো এতোই পৈশাচিক যে, মৃত্যুদণ্ড ছাড়া কোনো সাজাই তার জন্য পর্যাপ্ত নয়। একমাত্র মৃত্যুদণ্ডই তার প্রাপ্য। তার অপরাধের ফলাফল পুরো জাতিকে অনন্তকাল বয়ে বেড়াতে হবে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বাংলাদেশের বাইরেও তার অপরাধগুলো নির্লজ্জ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আর বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা তার রায়ে, কাদের মোল্লাকে ১, ২, ৩ ও ৫ নম্বর অভিযোগ থেকে খালাস দিয়েছেন। এসব অভিযোগ সংঘটনের ক্ষেত্রে কাদের মোল্লার উপস্থিতি, উৎসাহ প্রদান বা সম্পৃক্ততার কোনো সন্দেহাতীত প্রমাণ রাষ্ট্রপক্ষ হাজির করতে পারেনি বলে তার রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া যে ৬ নম্বর অভিযোগে কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে, সেই অভিযোগের ব্যাপারে ওয়াহহাব মিঞা তার রায়ে বলেছেন, এক্ষেত্রে ৩ নম্বর সাক্ষী মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে তদন্তের সময় যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে দেখা যায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাতে তাদের বাসায় যে বিভৎস ঘটনা ঘটেছিলো তার সাথে কাদের মোল্লা জড়িত ছিলেন না এবং সুনির্দিষ্টভাবে সে বলেছে যে বিহারি ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ওই অপরাধ সংঘটিত করেছে। তদন্ত কর্মকর্তার কাছে ৩ নম্বর সাক্ষী যে বক্তব্য দিয়েছেন তা বিবেচনায় নেয়া হয়নি। ৮ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের রায়ের কপি ট্রাইব্যুনালে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ওই দিনেই ট্রাইব্যুনাল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মৃত্যুপরোয়ানা জারি করেন।

সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণ শুরু: বর্তমান সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিলো যুদ্ধাপরাধের বিচার করা। আর সেই লক্ষ্যে এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধ বিচারে ২০১০ সালে প্রাইবুনাল গঠন করে। শুরু হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এই ট্রাইব্যুনাল এরই মধ্যে ৭ জনের বিচার শেষ করেছেন। ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায়ে ২১ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। ৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়, যা প্রত্যাখ্যান করে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান নেয় হাজার হাজার মানুষ। তৃতীয় রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসি দেয়া হয় ২৮ ফেব্রুয়ারি। আর এ রায়ের পর দলটির ঘাঁটি বলে পরিচিত এলাকাগুলোতে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি হিসাবেই পুলিশসহ নিহত হয় ৭০ জনেরও বেশি মানুষ। সেই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় রাজনীতি সহিংস রূপ নেয়। ৯ মে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকেও মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর ১৫ জুলাই জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমকে ৯০ বছরের জেল এবং ১৭ জুলাই জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়। আর বিএনপি নেতা সাকা চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়া হয় ১ অক্টোবর। ট্রাইব্যুনাল থেকে ঘোষিত ৭টি রায়ের মধ্যে ৬টির বিরুদ্ধে এরই মধ্যে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে আপিল দায়ের করা হয়েছে। পলাতক থাকায় আবুল কালাম আযাদ এখনও আপিল করেননি। দায়েরকৃত ৬ আপিলের মধ্যে সর্বপ্রথম শুনানি শেষে রায় দেয়া হয় কাদের মোল্লার। বর্তমানে জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে ঘোষিত রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলের শুনানি চলছে।

কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনা ছয় অভিযোগ: একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ মোট ছয়টি অভিযোগ আনা হয়। ট্রাইব্যুনালে এসব অভিযোগের বিচার শেষে ৫টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়। প্রমাণিত হওয়া ৫টি অভিযোগের মধ্যে এক, দুই ও তিন নম্বর অভিযোগে কাদের মোল্লাকে ১৫ বছর করে এবং পাঁচ ও ছয় নম্বর অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। চার নম্বর অভিযোগ থেকে খালাস দেন ট্রাইব্যুনাল। পরে আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে ৬ নম্বর অভিযোগে কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। এছাড়া খালাস পাওয়া চার নম্বর অভিযোগে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন এবং অন্যসব অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেয়া সাজা বহাল রাখেন। তার বিরুদ্ধে আনীত ছয়টি অভিযোগ হচ্ছে-

প্রথম অভিযোগ: মিরপুর বাংলা কলেজের ছাত্র পল্লব হত্যার সাথে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ। দ্বিতীয় অভিযোগ: কাদের মোল্লা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে একাত্তরের ২৭ মার্চ মিরপুরের বাসায় গিয়ে কবি মেহেরুননিসা, তার মা এবং দু ভাইকে হত্যা করার অভিযোগ। তৃতীয় অভিযোগ: সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেবকে মিরপুরের জল্লাদখানা পাম্পহাউসে নিয়ে কাদের মোল্লা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে জবাই করে হত্যার অভিযোগ। চতুর্থ অভিযোগ: একাত্তরের ২৫ নভেম্বর সকাল সাড়ে ৭টা থেকে ১১টা পর্যন্ত কাদের মোল্লা ও ৬০-৭০ জন রাজাকারের বিরুদ্ধে কেরানীগঞ্জ থানার ভাওয়াল খানবাড়ি ও ঘাটার চর (শহীদনগর) এলাকায় শতাধিক নিরস্ত্র গ্রামবাসী ও দুজন নিরস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করার অভিযোগ। পঞ্চম অভিযোগ: একাত্তরের ২৪ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাদের একটি হেলিকপ্টার মিরপুরের আলোকদী (আলুব্দী) গ্রামের পশ্চিম দিকে নামে। কাদের মোল্লা অর্ধশত অবাঙালি, রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাসদস্য নিয়ে গ্রামের পূর্বদিক থেকে ঢোকেন এবং এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকেন। ওই ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ৩৪৪ জনের বেশি মারা যান। ষষ্ঠ অভিযোগ: একাত্তরের ২৬ মার্চ মিরপুরের ১২ নম্বর সেক্টরের ৫ নম্বর কালাপানি লেনের হযরত আলী, তার স্ত্রী, দু মেয়ে ও দু বছরের ছেলেকে হত্যা এবং তার ১১ বছরের মেয়েকে ধর্ষণের সাথে কাদের মোল্লার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ।