করের টাকায় সরকারি ব্যাংকের দুর্নীতির দায় মেটানো অনৈতিক

 

স্টাফ রিপোর্টার: জনগণের করের টাকায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের দুর্নীতির দায় মেটানো অনৈতিক। এই অনৈতিক কাজটাই সরকার বছরের পর বছর করে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়ই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে একের পর এক দুর্নীতি হচ্ছে। ফলে এসব ব্যাংকে বাড়ছে মূলধন ঘাটতি। আর ঘাটতি মেটাতে সরকার আর্থিক খাতের সংস্থার উদ্যোগ না নিয়ে প্রতি বছরই মূলধন জোগান দিয়ে যাচ্ছে। সংস্কার ছাড়া যা কখনোই কার্যকর হবে না।

জানা গেছে, আবারও জনগণের করের টাকা যাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে। আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটেও এসব ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পূরণে ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যার পুরোটাই জনগণের করের টাকা। যদিও বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী এ বিষয়ে কিছুই বলেননি। তবে বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ব্যাংকখাতে জালিয়াতি হয়, চুরিচামারি হয় সব খানেই, সব দেশেই, আমাদের দেশেও হয়েছিলো। কমানোর চেষ্টা করছি। তবে সেটা খুব বেশি নয়। রাষ্ট্রায়ত্ত দুই তিনটি ব্যাংকে কিছু সমস্যা রয়েছে। এ সমস্যা সমাধানে সরকার সচেষ্ট রয়েছে। তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে মূলধন দেয়া হচ্ছে সরকারের সেবা দেয়ার জন্য।

‘মূলধন পুনর্গঠনে বিনিয়োগ’ নামে এ সরকারের আমলে সরকারি ব্যাংকগুলোকে মোট ১৪ হাজার কোটিরও বেশি টাকা দেয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষের করের টাকা রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে দিয়ে দিচ্ছে সরকার। সাধারণ মানুষের ওপর করের বোঝা বাড়িয়ে বাড়তি রাজস্ব আদায়ের পরিকল্পনাও নেয়া হয়েছে বাজেটে। আর এই রাজস্বের একটি অংশই দিয়ে দিচ্ছে সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন জোগানে। মূলধন জোগান দেয়ার সরকারি সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছেন ব্যাংকিং খাতের সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেছেন, দুর্নীতির মাধ্যমে লুট হয়ে যাওয়া অর্থ উদ্ধারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে সরকার এখন উল্টো রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর দুর্নীতিকে জায়েজ করার চেষ্টা করছে। এ ব্যাংকগুলোকে পুনঃঅর্থায়ন করা হলে দুর্নীতিকেই প্রশ্রয় দেয়া হবে। আর্থিক খাতের সংস্কার ছাড়া আবারও মূলধন জোগান দেয়া হলে দুর্নীতির মাত্রা আরো বেড়ে যাবে। শুধু তাই নয়, সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি মেটানোর জন্য যে প্রতি বছরই হাজার হাজার কোটি টাকা দেয়া হচ্ছে সেটি কার টাকা তা বিবেচনায় আনার প্রয়োজন রয়েছে। এ অর্থ জনগণের, জনগণ যে কর দেন তার অর্থ। দুর্নীতির মাধ্যমে লুটপাট হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা না করে জনগণের করের অর্থ দেয়া কোনোভাবে কাম্য হতে পারে না।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জনগণের করের টাকায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের জালিয়াতির দায় মোটানোর সরকারি সিদ্ধান্ত মোটেও যৌক্তিক নয়। দুর্নীতির কারণে সরকারি ব্যাংকগুলোতে মূলধন ঘাটতিসহ নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। এ ঘাটতি জনগণের করের টাকা দিয়ে পূরণ করা উচিত নয়। এটা অনৈতিক। মূলধন ঘাটতি পূরণে এসব ব্যাংককে খেলাপি ঋণ আদায়ের ওপর জোর দিতে হবে। তা না করে সরকার যেটা করতে যাচ্ছে তা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। তিনি আরো বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে পরিচালক নিয়োগ দেয় সরকার। তাদের সহযোগিতায় এসব ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনা ঘটে থাকে। তিনি বলেন, সরকার যদি এসব ব্যাংকে দক্ষ, সৎ ও নিষ্ঠাবান পরিচালক নিয়োগ দেয় তাহলে এত সহজে জালিয়াতিগুলো হতে পারত না। আর ঘাটতি পূরণে এত টাকাও দিতে হতো না।

একই বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সরকারি দলের লোকদের চাপসহ নানা কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো গুণগত মান যাচাই না করেই ঋণ দিচ্ছে। পরে যা আর আদায় হচ্ছে না। এতে তাদের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের পরিমাণ বেড়ে মূলধনে ঘাটতির সৃষ্টি হচ্ছে। এসব ব্যাংকের মালিক যেহেতু সরকার, তাই সরকার জনগণের অর্থ দিয়ে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী মূলধন জোগান দিয়ে থাকে। ফলে ব্যাংকগুলোও নিজেদের সংশোধনের প্রয়োজন অনুভব করে না। তার মতে, এসব ব্যাংকের উচিত দেখেশুনে ভালো উদ্যোক্তাকে ঋণ দেয়া নিশ্চিত করা এবং মুনাফা বাড়ানোর মাধ্যমে মূলধনের ঘাটতি মেটানোর সক্ষমতা গড়ে তোলা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, জনগণের ব্যাংক হিসাব থেকে অতিরিক্ত হারে শুল্ক কেটে নেয়া হবে, আবার সেই টাকা দেয়া হবে সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন জোগানে। এটা একটা অনৈতিক কাজ। ব্যাংক খাতের সংস্কার নিয়ে অর্থমন্ত্রী কিছু না বলার সমালোচনা করে তিনি আরো বলেন, মূলধন জোগানের নামে ব্যাংকগুলোকে টাকা দেয়া জনস্বার্থবিরোধী। প্রতি বছর এমন উদ্যোগ চলতে পারে না। এদিকে, আমাদের দেশে রাজনৈতিক অর্থনীতির বিকাশ হচ্ছে না বলেই ব্যাংকগুলোর দুর্নীতিও কমছে না। এবং সরকারও এ বিষয়ে কিছুই বলছে না।

বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে সিপিডি ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, শুধু প্রশাসন দিয়ে বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এতে জনপ্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে না। এভাবেই আমাদের দেশে রাজনৈতিক অর্থনীতির বিকাশ হচ্ছে না। এ কারণেই মনে হচ্ছে অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় একটিবারের জন্যও শেয়ারবাজার কিংবা ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারি নিয়ে কথা বললেন না। কারণ এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে সরকারের বড় বড় ব্যক্তিরা।

একের পর এক আর্থিক কেলেঙ্কারি ও ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণের কারণে বড় ধরনের মূলধন ঘাটতিতে আছে সরকারি ব্যাংকগুলো। এসব ব্যাংক টিকিয়ে রাখতে হচ্ছে এখন বাজেট বরাদ্দ দিয়ে। প্রতি বছরের বাজেটেই ব্যাংকগুলোকে টাকা দেয়ার জন্য আলাদা বরাদ্দ রাখেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ব্যাংকগুলোকে অর্থ মন্ত্রণালয় টাকা দেয়ার সময় প্রতিবারই বলে দিচ্ছে যে খেলাপি ঋণ আদায়ে তাদের মনোযোগী হতে হবে। বাস্তবে খেলাপি ঋণ আরো বাড়ছে। মার্চ শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৩ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। যা বিতরণ হওয়া ঋণের ১০ দশমিক ৫৩ শতাংশ। কেবল তিন মাসেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১ হাজার ২৩৭ কোটি টাকা। ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ঋণের নামে সাধারণ মানুষের আমানতের টাকা আত্মসাতের কারণে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোয় মূলধনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। চলমান অনিয়ম-দুর্নীতির পাশাপাশি অগ্রণী ব্যাংকে মুন গ্রুপ কেলেঙ্কারি, রূপালী ব্যাংকে গোল্ড আনোয়ারসহ আরো কেলেঙ্কারি হয়েছে নতুন করে। এর আগে সোনালী ব্যাংকে হল-মার্ক কেলেঙ্কারি, জনতা ব্যাংকে বিসমিল্লাহ গ্রুপ জালিয়াতি ও বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর নেতৃত্বে পুরো বেসিক ব্যাংকেই বড় ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে। এসব জালিয়াতির মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ হয়েছে সরকারি ব্যাংকগুলো থেকেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিক শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের আট ব্যাংকের মধ্যে ৭টিই ঘাটতিতে রয়েছে। ঘাটতির তালিকার শীর্ষে রয়েছে সোনালী, বেসিক ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি)। এ তালিকায় থাকা অন্য পাঁচ সরকারি ব্যাংক হলো জনতা, অগ্রণী ও রূপালী, বিশেষায়িত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, সোনালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া বেসিক ব্যাংকে ২ হাজার ৯৬১ কোটি, রূপালী ব্যাংকে ৬৩৭ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকে ৪৪২ কোটি, জনতা ব্যাংকে ৭০ কোটি, বিকেবি ৭ হাজার ২৫২ কোটি এবং রাকাবের মূলধন ঘাটতি এখন ৭৭৮ কোটি টাকা। মার্চ শেষে ব্যাংকগুলোর মোট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা।