কবিরাজের অপচিকিৎসায় আরো এক স্কুলছাত্রের মৃত্যু

 

 

হাসপাতালে না নিয়ে কথিত ওঁঝার কাছে নেয়ায় মারা গেলো সর্পদংশিত রোগী

 

স্টাফ রিপোর্টার: বাড়ির কাছে হাসপাতাল থাকলেও কথিত ওঁঝার ভণ্ডামি আর অপচিকিৎসায় মারা গেলো চুয়াডাঙ্গা শহরতলী জাফরপুর স্টেডিয়ামপাড়ার মেধাবী স্কুলছাত্র মোশারফ আলী (১২)। গতপরশু রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় তার হাতের আঙুলে দংশন করে সাপে। হাসপাতালে না নিয়ে তাকে নেয়া হয় বেলগাছির মহিবুল্লার নিকট। রাতে অপচিকিৎসা দিয়ে বাড়ি ফিরিয়ে নিতে বলা হয়। সকাল ১০টার দিকে আবারও মোশারফকে নেয়া হয় মহিবুল্লার নিকট। তিনি তখনও হাসপাতালে না পাঠিয়ে কালনাগিনিতে দংশন করেছে বলে ঝাঁড়ফুঁকে মত্ত থাকেন। শেষ পর্যন্ত বেলা ১১টার দিকে হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক বলেন, অনেক দেরি হয়ে গেছে। হাসপাতালে নেয়ার আগেই কিশোর মোশারফ মারা গেছে।

আর কতোজন ওঁঝা-কবিরাজের অপচিকিৎসায় মৃত্যুর পর তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে? কতোটা প্রাণহানির পর গ্রামবাংলার মানুষ সচেতন হবে? এসব প্রশ্নের জবাব মিলছে না। সর্পদংশিত রোগীর হাসপাতালে সুচিকিৎসা থাকলেও অনেকেই অন্ধের মতো ওঁঝা-কবিরাজের দালালদের প্ররোচণায় তাদের আস্তানায় গিয়ে অনিবার্য করে তুলছে মৃত্যু। গতকাল জাফরপুর স্টেডিয়ামপাড়ার শুকুর আলীর ছেলে সীমান্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণির ছাত্র মোশারফ মারা গেলে বেলগাছির কবিরাজ মহিবুল্লার বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠেন অনেকে। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে না নিয়ে মহিবুল্লার নিকট নিকট নিতে যারা প্ররোচিত করেছিলো তাদের বিরুদ্ধেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন কেউ কেউ।

জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের জাফরপুর স্টেডিয়ামপাড়ার শুকুর আলীর দু ছেলে দু মেয়ে। ৪ সন্তানের মধ্যে মোশারফ ছিলো দ্বিতীয়। সে শুধু নামাজিই ছিলো না, বিদ্যালয়ে মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরীক্ষায় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতো। গতপরশু রাতে পড়তে না বসার কারণে তার মা তাকে বকাঝকাও করে। ভাত খেতে দেবো না বলেও শাসায়। মোশারফ ঠিক আছে কাল থেকে ভাত খাবো না বলে ঘুমিয়ে পড়ে। রাত আনুমানিক ৩টার দিকে বিষের যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে মোশারফ। তার বাম হাতের আঙুলে সর্পদংশনের দাগ পাওয়া যায়। হাসপাতালে না নিয়ে নেয়া হয় বেলগাছির মহিবুল্লার নিকট। তিনি রাতে হাতে কাটাছেঁড়া করেন। গাছ গাছাড়ির দাওয়ায়ও দেন। বিষ নেমে গেছে বলে জানিয়ে রোগী বাড়ি ফিরিয়ে নিতে বলেন। সুস্থ হয়ে ওঠার বদলে মোশারফ ক্রমেই ঝিমিয়ে পড়তে থাকে। তাকে সকাল ১০টার দিকে কেউ কেউ হাসপাতালে নিতে বলে। হাসপাতালের উদ্দেশে নেয়া হলেও পথিমধ্যে কয়েকজনের প্ররোচণায় ফের নেয়া হয় মহিবুল্লার নিকট। তিনি তখন কালনাগিনিতে দংশন করেছে বলে মনগড়া গল্প শুনিয়ে ঝাঁড়ফুঁকের পাশাপাশি গাছড়ার দাওয়ায় দিয়ে আল্লাহকে ডাকতে বলেন। রোগী নিস্তেজ হয়ে পড়লে কয়েকজন খানেকটা জোর করেই নেন চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে। কর্তব্যরত চিকিৎসক মোশারফকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। লাশ নেয়া হয় বাড়িতে। কান্নায় ভেঙে পড়েন মাতা-পিতাসহ আত্মীয়স্বজন। শোকের মধ্যেও কেউ কেউ তাদের অসচেতনতাকে দায়ী করে কটাক্ষ করে বলেন, বাড়ির কাছে হাসপাতাল থাকতেও কেন তোমরা ওকে নিলে কবিরাজের নিকট।

উল্লেখ্য, সর্পদংশিত রোগীর সুচিকিৎসা দিতে দ্রুত বাঁধন দিয়ে হাসপাতালে নিতে হয়। কোন সাপে দংশন করেছে তা জানার দরকার নেই। হাসপাতালের চিকিৎসকরাই পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়ে রোগী সুস্থ করে তোলেন। দংশন করা সাপে বিষ প্রয়োগ করলে এন্টিস্নেক ভেনম দেয়া হয়, অন্যথায় তা দেয়া হয় না। আর ওঁঝা-কবিরাজের নিকট নেয়া হলে বিষপ্রয়োগ করা কোনো রোগীই বাঁচে না। দংশিত সাপে বিষ প্রয়োগ না করা রোগীরা এমনিতেই সুস্থ হয়, আর তার কৃতিত্ব নেয় ওঁঝা-কবিরাজের দল। সুযোগ বুঝে হাতিয়ে নেয় টাকা। এরাই সোনাতন পদ্ধতির পুস্তক উঁচিয়ে সর্পদংশিত রোগীকে সুস্থ করার শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে রোগী ডেকে অপচিকিৎসায় মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। এদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া দরকার বলেও অভিমত অনেকের।