কওমি সনদের স্বীকৃতি নিয়ে বিভক্তি : সন্দেহ

 

স্টাফ রিপোর্টার: সাম্প্রতিক সময়ে সরকার কওমি সনদের যে স্বীকৃতি দিয়েছে তা নিয়ে ধর্মীয় এ শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। একটি অংশ এ স্বীকৃতিতে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও অন্য পক্ষের মধ্যে এ নিয়ে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। একপক্ষ বলছে এর ফলে ভবিষ্যতে তাদের সরকারি-বেসরকারি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হলো। কিন্তু বিপরীত পক্ষের দাবি কওমি শিক্ষাকে তার প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে সরিয়ে আনার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রথম ধাপ এটি।

সরকারি স্বীকৃতির পর বেশ কিছু কওমি মাদরাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে এ শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন অংশের মধ্যকার এ বিভাজনের স্পষ্ট চিত্র ফুটে উঠেছে। স্বীকৃতির পর একটি অংশ (দাওরায়ে হাদিস বা মাস্টার্স পাস) বলছে এর ফলে তাদের দীর্ঘদিনের দাবি পূর্ণ হয়েছে। এখন তারা বিষয়টিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চান। এ জন্য প্রয়োজনে সিলেবাসে সংযোজন-বিয়োজনেও তাদের মধ্যে মতপার্থক্য কম। এ অংশটি মনে করে কোরআন-হাদিসের শিক্ষার পাশাপাশি সিলেবাসে সাধারণ শিক্ষার পাঠ্যক্রম যেটুকু আছে তাকে আরও সম্প্রসারিত করা যেতে পারে। তারা এটাও মনে করেন যে তাদের সিলেবাস গতানুগতিক সিলেবাসের মতো না করে অধিকতর বাস্তবমুখী করে তৈরি করা উচিত। যাতে দাওরায়ে হাদিস পাস করে একজন শিক্ষার্থী নিজেকে ধর্মীয় বিষয়ের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি চাকরি পরীক্ষার উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারেন।

তবে সরকারি স্বীকৃতিকে দীর্ঘমেয়াদি ষড়যন্ত্রের প্রথম ধাপ হিসেবে মনে করছে কওমি শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্টদের আরেকটি অংশ। তাদের মতে, তারা দ্বীনি শিক্ষাকে দশকের পর দশক ধরে চালিয়ে নিচ্ছেন কোনো ধরনের সরকারি স্বীকৃতি ছাড়াই। এতে তাদের কোনো সমস্যা হয়নি। তবে এ সময়ে এসে হঠাৎ করে এ স্বীকৃতি কেন। এ স্বীকৃতির পর সিলেবাসে পরিবর্তনের জন্য সরকার এখন মাদরাসা কর্তৃপক্ষকে চাপ দিতে পারবে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টদের এ অংশটি। এরা মনে করেন বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মসজিদ-মাদরাসা রয়েছে। এছাড়া যারা সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলমান তারাও ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো জানতে কওমি শিক্ষায় শিক্ষিতদের সান্নিধ্যে যেয়ে থাকেন। সমাজের মধ্যে বিরাজমান এসব চাহিদা পূরণ করতে এবং ইসলামকে মানুষের কাছে সুন্দরভাবে উপস্থাপনের জন্য কওমি শিক্ষা ব্যবস্থার জন্ম। এখন এ ধারায় শিক্ষিতরা যদি সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতদের মতো শুধু নিজেদের চাকরি-বাকরি আর নিজেদের ভালো থাকার মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেন তবে কওমি শিক্ষা ব্যবস্থা যে উদ্দেশ্যে তার যাত্রা শুরু করেছিলো সে লক্ষ্য অর্জনে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হবে।

এছাড়া গোপন তথ্য প্রকাশ করে বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ব্যতিক্রমধর্মী সংবাদ প্রতিষ্ঠান উইকিলিকসের প্রকাশিত তথ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু ই-মেইল নিয়েও অনেকে শঙ্কিত। উইকিলিকসের প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, সে সময়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত সে দেশের প্রেসিডেন্টকে লেখা এক ই-মেইলে বাংলাদেশের কওমি মাদরাসা ও তার প্রতি সাধারণ মানুষের উদার দৃষ্টিভঙ্গি এ দেশে মার্কিন স্বার্থ বিরোধিতার কারণ হতে পারে বলে জানায়। এ কারণে পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে কওমি শিক্ষার সিলেবাস ও শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার দাবি জানিয়ে এ শিক্ষার যাবতীয় খরচ পরিচালনার প্রস্তাব করা হয়। এখন কওমি কর্তৃপক্ষের অনেকেই এ বিষয়টিকে সামনে এনে দাবি করছেন সরকারের এ স্বীকৃতির বিষয়টি আন্তর্জাতিক সেই অপকৌশলের অংশ কিনা তা নিয়ে তারা সন্দিহান। এ কারণেও তারা সরকারি স্বীকৃতির পরও একে ভালোভাবে নিতে পারছে না। তবে এ দুটি মতের বিপরীতে ভিন্ন মতও আছে। কওমি মাদরাসার আরেকটি অংশ মনে করছে এ স্বীকৃতিটুকুই যথেষ্ট। এর আধুনিকায়ন বা সরকারি চাকরি কোনোটারই প্রয়োজন নেই। এ শিক্ষা ব্যবস্থা যেভাবে আছে সেভাবেই থাকুক বলে এ পক্ষের মত।

বিষয়টি নিয়ে সাথে কথা হয় কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের (বেফাক) যুগ্ম মহাসচিব মওলানা মাহফুজুল হকের। তিনি বলেন, অনেক দিনের দাবির পর তারা তাদের শিক্ষা ব্যবস্থার স্বীকৃতি পেয়েছেন। তার চেয়ে বড় বিষয় তাদের প্রধান দাবি ছিলো সিলেবাসে হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বীকৃতি। সেটি তারা পেয়েছেন। দাওরায়ে হাদিস যেহেতু মাস্টার্সের সমমান পেয়েছে ফলে এর শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারি-বেসরকারি চাকরির ব্যবস্থা করা এখন সরকারের দায়িত্ব। সরকারি-বেসরকারি চাকরি পেলে তাদের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে। তারা কওমি শিক্ষার্থীদের দেশের সেবা করার জন্য সুযোগ করে দিতে রাষ্ট্রের কাছে আহ্বান জানাবেন। কওমি শিক্ষার্থীরা এমনিতেই দেশপ্রেমিক ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এখন তারা রাষ্ট্রের অন্যান্য ক্ষেত্রে অবদান রাখার সুযোগ পেলে তা দায়িত্বের সাথেই পালন করবেন।

অন্যদিকে এ স্বীকৃতির পর সরকারি-বেসরকারি চাকরি পাওয়ার বিষয়ে ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব ও হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ বলেন, তারা কখনোই সরকারি-বেসরকারি চাকরি চাননি, এটা প্রত্যাশাও করেন না। এটা তাদের নীতি ও আদর্শবিরোধী। কওমি শিক্ষার উদ্দেশ্য একমাত্র মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ, দ্বীনি খেদমত, আদর্শ মানুষ তৈরি, সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও ইসলামের প্রচার-প্রসারে কাজ করা। তারা তাদের সে উদ্দেশ্যের জন্যই কাজ করতে চান। তবে স্বীকৃতির পর একটি অংশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেও সিলেবাসে পরিবর্তনের বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন কওমি নেতারা। রাজধানীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কওমি মাদরাসা মোহাম্মদপুরের সাতমসজিদ এলাকার জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ার মুহাদ্দিস ও মাসিক রাহমানী পয়গাম পত্রিকার সম্পাদক মুহাম্মাদ মামুনুল হক  বলেন, এ স্বীকৃতি তাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিলো। তবে সেখানে তাদের কিছু শর্ত ছিলো। এসব শর্তের মধ্যে কওমি শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য গুরুত্বপূর্ণ। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে এর যাত্রা শুরু হয়েছিলো সেটি ধরে রাখতে হবে। তবে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে ও যুগের সাথে তাল মেলাতে যেসব পরিবর্তন আনা দরকার কওমি শিক্ষা ব্যবস্থা তা এনেছে এবং আনছে। এ ধারা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে। পঞ্চাশ বছর পূর্বে কওমি ব্যবস্থায় যে সিলেবাস ছিলো এখন তা নেই বললেই চলে। সব কিছুতেই পরিবর্তন এসেছে। সময়ের পরিবর্তনের কারণেই তা এসেছে। আগামী দিনেও বাস্তবতার প্রয়োজনে সব কিছুতে পরিবর্তন আসবে। তবে সরকার বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে পরিবর্তনের চেষ্টা হলে তা মেনে নেয়া হবে না।

স্বীকৃতির আগে-পরে কওমি কর্তৃপক্ষের একটি অংশের মধ্যে এ ইস্যুতে জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের বিষয়েও আলোচনা ছিলো। এদের একটি অংশ মনে করে এ শিক্ষাকে ধ্বংস করার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র বিদ্যমান। আর এ কারণে স্বীকৃতি নিলেও সরকারি কোনো অর্থ নিতে তাদের রয়েছে ঘোর আপত্তি। স্বীকৃতির পর বেফাক কর্তৃপক্ষ এক বৈঠকে বসে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় স্বীকৃতি দেয়ার জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানানো হবে। এর বিপরীতে সরকারের কাছ থেকে যে কোনো ধরনের আর্থিক সহায়তা নেয়া থেকে বিরত থাকা হবে।

এ প্রসাথে মওলানা মাহফুজুল হক বলেন, উইকিলিকসের মেইল থেকে তারা জানতে পেরেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কথা বলছে। এছাড়া দেশের ভেতরেও এ ধরনের বিভিন্ন গোষ্ঠী সক্রিয়। এসব কারণে তাদের অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হচ্ছে। তারা মনে করেন তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে আপস করা হবে আত্মহত্যার শামিল।

উইকিলিকস প্রসাথে মুফতি ফয়জুল্লাহ বলেন, শুধু উইকিলিকসই নয় অনেকেই এ ধরনের কাজ করছে। তবে কে কি বললো সেদিকে কান দিতে চান না। তারা তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পথে অবিচল থাকতে চান। সবার সাথে সুসম্পর্কের মাধ্যমেই সামনের পথ পাড়ি দিতে চান। তবে উদ্বেগ আতঙ্ক যাই থাক না কেন একটি বিষয়ে সবাই একমত যে কওমি শিক্ষার সিলেবাসে যেকোনো ধরনের সংযোজন বা বিয়োজন হতে হলে তা হতে হবে এ শিক্ষার নিজেস্ব কর্তাব্যক্তিদের হাতে। সরকার বা বাইরে থেকে কেউ কোনো কিছু চাপিয়ে দিলে তার বিরোধিতার বিষয়ে কারো মাঝে কোনো দ্বিমত নেই। গত সাড়ে পাঁচ বছর ধরে অনেক চেষ্টার পরেও তাই বাধ্য হয়ে সরকার সিলেবাসে কোন হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই। তবে অনেকেই একে সরকারের কৌশলগত অবস্থান বলে মনে করছেন।