ওএমএস’র পরিধি বাড়লেও আতবে অনাগ্রহ : কমছে না চালের দাম

স্টাফ রিপোর্টার: খোলাবাজারে (ওএমএস) চাল-আটা বিক্রির পরিধি কয়েক ধাপে বাড়ানো হলেও বাজারে চালের দাম এখনো তেমন কমেনি। বিশেষ করে মোটা চালের অগ্নিমূল্যের উত্তাপ অনেকটা আগের মতোই রয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের নীতি-নির্ধারকরা এ বাস্তবতা মেনে নিলেও গত ১৬ অক্টোবর নতুন করে আরও ৪০৯ উপজেলা এবং ২৪ পৌরসভায় ওএমএস চালু করেছে।  বাজার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, গুদামে মজুদকৃত আতপ চাল এখন সরকারের গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে। তাই দ্রুত তা বিতরণের জন্য নতুন নতুন এলাকায় খোলাবাজারে চাল-আটা বিক্রির কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। চালের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই বলেও অভিযোগ করেন তারা।

এদিকে বেসরকারি পর্যায়ের আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা খাদ্যশস্য ব্যবসায়ী এবং চালকল মালিকরা অতিরিক্ত ধান-চাল মজুদ রেখে বাজার পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তুলছে কি-না তা নিশ্চিত হতে তাদের মজুদের পাক্ষিক প্রতিবেদন সংগ্রহে খাদ্য অধিদপ্তর যে উদ্যোগ নিয়েছিল তা-ও পুরোপুরি ভেস্তে গেছে। যা গত ১৭ অক্টোবর খাদ্য অধিদপ্তর থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল এবং রংপুরের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক বরাবরে পাঠানো চিঠিতেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এতে বলা হয়, বেসরকারি পর্যায়ের আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা খাদ্যশস্য ব্যবসায়ী এবং চালকল মালিকদের যে সংকলিত মজুদ প্রতিবেদন পাঠানো হচ্ছে তাতে খাদ্যশস্য ব্যবসার খণ্ডিত চিত্র প্রতিফলিত হচ্ছে। এখনও বেশিরভাগ ব্যবসায়ী লাইসেন্সের আওতাবহির্ভূত রয়েছেন এবং তারা পাক্ষিক প্রতিবেদন দিচ্ছেন না। আবার যারা লাইসেন্স নিয়েছেন, তারাও যে সঠিক তথ্য সংবলিত প্রতিবেদন দিচ্ছেন তার কোনো নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে সব খাদ্যশস্য ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নিয়মিতভাবে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য সংবলিত পাক্ষিক প্রতিবেদন প্রেরণ নিশ্চিত করার জন্য জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকদের চারটি কৌশল অবলম্বনের নির্দেশ দেয়া হয়।

সংশিস্নষ্টরা জানান, চালের দর স্বাভাবিক হওয়ার আগে পাইকারি ও খুচরা বাজারে এর সরবরাহ স্বাভাবিক হতে হবে। পাশাপাশি সরকারি গুদামেও পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ থাকা জরুরি। অথচ এখনো সে ধরনের কোনো আলামত নেই। তাই বাজারে চালের দর যে সহসাই স্বাভাবিক হচ্ছে না এ ব্যাপারে ব্যবসায়ীরা অনেকটাই নিশ্চিত। এ পরিস্থিতিতে তারা সরকারের কৌশল বুঝে নিজেদের সুবিধামতো ব্যবসা চালাচ্ছে। মাঠ পর্যায়ের খাদ্য কর্মকর্তারাও বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ওএমএস কর্মসূচির মাধ্যমে আতপ চাল ও আটা দিয়ে চালের দর কোনোভাবে নিম্নমুখি করা সম্ভব নয়। এ বিষয়টি ঊর্ধ্বতনরা দফায় দফায় মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছেন। তবে সংশিস্নষ্টরা বিষয়টিতে গুরুত্ব দিচ্ছে না। বরং আতপ চাল বিক্রির চরম হতাশাজনক পরিস্থিতিতে এর পরিধি আরও বাড়ানো হয়েছে। যার নেতিবাচক প্রভাব বাজারে পড়ছে। যদিও খাদ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন অনেকেই এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তাদের দাবি, চালের বাজারের উত্তাপ কমাতেই নতুন করে ওএমএস’র পরিধি বাড়ানো হয়েছে। এর নেপথ্যে অন্য কোনো কারণ নেই। সেদ্ধ চালের মতো ততোটা চাহিদা না থাকলেও ওএমএস’র মাধ্যমে মাত্র ৩০ টাকায় আতপ চাল কিনতে পারায় নিম্নআয়ের মানুষ যথেষ্ট উপকৃত হচ্ছে। আর এ লক্ষ্যে সরকার এ কর্মসূচির আওতা বাড়িয়েছে। পর্যায়ক্রমে সারা দেশেই এর পরিধি বিস্তৃত করা হবে। এর প্রভাবে খোলাবাজারে চালের দাম যথেষ্ট কমেছে বলেও দাবি করেন তারা। তবে রাজধানীর বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা বাজারের চালের দর পর্যালোচনায় তাদের এ দাবির কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। বাজারে ভালো মানের মোটা চাল ৪৯ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চিকন চালের দাম গত মাসের শেষভাগে কিছুটা কমলেও অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের পর তা আবার আগের জায়গায় ফিরেছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, মোটা চালের দামে সবার নজর থাকায় ব্যবসায়ীরা এর দাম কিছুটা কমিয়ে সরু চাল নিয়ে চালবাজি করছে। এতে চাল বাজারের সার্বিক উন্নতি অধরাই রয়ে গেছে।সরেজমিন গত ১৫ অক্টোবর রাজধানীর বৃহত্তম চালের বাজার মোহম্মদপুর কৃষি মার্কেট, মিরপুর এক নম্বরের পাইকারি চাল বাজার, কারওয়ানবাজারসহ অন্যান্য বাজারগুলোতে ঘুরে দেখা যায়, পাইজাম, এলসি, গুটি ও নূরজাহান (ভারতীয়) চাল মানভেদে ৪৪ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি মানের চাল হিসেবে পরিচিত ২৮ ধানের চাল ও লতা বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৫০ থেকে ৫২ টাকায়। দুর্গা ও জোড়া কবুতর চালের দর ৫৫ থেকে ৫৭ টাকা। চিকন চাল হিসেবে পরিচিত মিনিকেটের দর ৬০ থেকে ৬৫ টাকা এবং নাজিরশাইল ৬৮ থেকে ৭০ টাকায় স্থির হয়ে আছে। এদিকে সর্বশেষ গত ১৬ অক্টোবর দেশের যে ৪০৯টি উপজেলা ও ২৪ পৌরসভায় ওএমএস চালু করা হয়েছে ওইসব এলাকাতেও চালের দর কোনোরকম হেরফের হয়নি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, আতপ চাল খেতে অনভ্যস্থ মানুষ ওএমএস এড়িয়ে চলছে। এমনকি নিম্নবিত্তরাও সেদিকে ততটা ভিড়ছে না। বরং চড়া দরে তারা বাজার থেকে মোটা চাল কিনে খাচ্ছে। এতে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিকভাবেই আগের মতো রয়েছে বলে মন্ত্মব্য করেন তারা।

প্রসঙ্গত, নতুন করে যেসব ওএমএস চালু করা হয়েছে এর মধ্যে ঢাকা জেলার ২৩টি উপজেলা রয়েছে। এছাড়াও ময়মনসিংহের ১২টি, টাঙ্গাইলের ১১টি, কিশোরগঞ্জে ৮টি, নেত্রকোনায় ৬টি, জামালপুরে ৬টি, শেরপুরে ৪টি, ফরিদপুরে ৮টি, রাজবাড়ীর ৪টি, শরীয়তপুরের ৬টি, মাদারীপুরের ৩টি ও গোপালগঞ্জের ৪টি উপজেলা ওএমএস’র আওতায় আনা হয়েছে। অন্যদিকে রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন জেলার ৬১টি উপজেলা, খুলনা বিভাগে ৫০টি উপজেলা, রংপুর বিভাগে ৫০টি উপজেলা, বরিশাল বিভাগে ৩৬টি উপজেলা, চট্টগ্রাম বিভাগে ৯২টি উপজেলা এবং সিলেট বিভাগে ২৫টি উপজেলায় নতুন করে ওএমএস কর্মসূচির আওতায় এনেছে খাদ্য অধিদফতর।

উল্লেখিত, পরিসংখ্যান চিত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সর্বোচ্চ ঢাকা বিভাগে ৯৫ উপজেলায় এবং চট্টগ্রাম বিভাগে ৯২ উপজেলায় নতুন করে ওএমএস’র পরিধি বাড়ানো হয়েছে। অথচ চট্টগ্রামের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী আতপ চাল খেলেও ঢাকায় এর ভোক্তাসংখ্যা একেবারেই নগণ্য। এ কারণে বিগত সময়ে ঢাকার যেসব এলাকায় ওএমএস চালু করা হয়েছে এর অধিকাংশ স্থানেই চাল বিক্রির পরিমাণ ছিল হতাশাজনক। ওএমএস ডিলারদের আশঙ্কা, নতুন করে ঢাকার যে উপজেলাগুলোতে ওএমএস’র মাধ্যমে আতপ চাল বিক্রির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সেখানেও বেচাবিক্রির একই দশা হবে।