এসএসসিতে গণিতে ভরাডুবি তিন কারণে

 

স্টাফ রিপোর্টার: তিন কারণে এবারের এসএসসিতে গণিতে ভরাডুবি ঘটেছে। এগুলো হচ্ছে- গণিতের শিক্ষক সংকট, বিদ্যমান শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব এবং বিলম্বে নতুন পদ্ধতি প্রবর্তন বা তা অনুশীলনে সময়ের অভাব। শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সঙ্গে আলাপে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

এবারের এসএসসি পরীক্ষায় গণিত এবং উচ্চতর গণিত বিষয়ে প্রথমবারের মতো সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়। যারা এবার এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়, তারা ২০১৩ সালে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। ২০১৪ সালে দশম শ্রেণী শেষ করে এ বছর ফেব্রুয়ারিতে এসে পরীক্ষায় বসে। বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষক ও প্রধানরা জানিয়েছেন, ২০১৩ সালে হুট করে গণিতে সৃজনশীল পদ্ধতি প্রবর্তনের ঘোষণা করা হয়। কিন্তু আগে থেকে শিক্ষকদের এ বিষয়ে ন্যূনতম কোনো ধারণা পর্যন্ত দেয়া হয়নি। বছরের (২০১৩) মাঝামাঝি যখন এ পদ্ধতি বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয়া হয়, তখনও একজন শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। এ অবস্থায় নতুন পদ্ধতি প্রবর্তনের ঘোষণা দেয়া হলেও দেশের বেশিরভাগ স্কুলই প্রথম বা দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার প্রশ্ন আগের মতোই গতানুগতিক পদ্ধতিতে করেছিলো। শহরাঞ্চলের বাইরে বেশিরভাগ স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্নও করা হয়েছিলো সনাতনী পদ্ধতিতে। সেই হিসেবে গোটা নবম শ্রেণিই শিক্ষার্থীদের কেটেছে সৃজনশীলের সাথে সংযোগ ছাড়া। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকাসহ শহরাঞ্চলের কিছু স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষায় যদিও সৃজনশীল পদ্ধতিতে গণিতের প্রশ্ন করা হয়, কিন্তু ওইসব স্কুলে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ফেল করেছিল। এ নিয়ে অভিভাবকরা আন্দোলন পর্যন্ত করেন। সেই হিসেবে এসএসসির প্রোগ্রাম ২৫ মাসের হলেও শিক্ষার্থীরা নতুন এই পদ্ধতির গণিত অনুশীলনের সময় পেয়েছে মাত্র ১৩ মাস বা দশম শ্রেণীর সময়টা।

অভিভাবক সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নীপা সুলতানা বলেন, ২০১২ সালে প্রথম গণিতে সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর ঘোষণা আসে। আমরা তখন এর বিরোধিতা করেছিলাম। আমরা তখন শিক্ষামন্ত্রীকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম। কিন্তু ২০১৩ সালে এসে কোনোরকম পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই এটা চালু করে দেয়া হয়। এ কারণে ওইবার ঢাকার অতি সুবিধাপ্রাপ্ত স্কুলের অনেক শিক্ষার্থী পর্যন্ত ফেল করেছিলো। এদিকে অবিভাক সমন্বয় পরিষদের চুয়াডাঙ্গা সদস্য সচিব প্রাক্তন শিক্ষক আব্দুল মুত্তালিব চুয়াডাঙ্গার দুটি বিদ্যালয়ের সুপ্ত রেশারেশির বিষটি টেনে বলেছেন, চুয়াডাঙ্গার বিদ্যালয় দুটিতিতে শিক্ষক সংকট কাটিয়ে তোলা হলেও তাদের অবমূল্যায়নের কারণে বদলি নিয়ে চলে গেছে। এখন চুয়াডাঙ্গা শহরের সরকারি দুটি বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকটের অজুহাত দেখানো হচ্ছে। যারা রয়েছেন তাদের বিদ্যালয়ে পাঠদানের চেয়ে বাড়িতে প্রাইভেট পড়ানোতেই অধিক আগ্রহী। তা ছাড়া বিদ্যালয়ে কৌশলে কোচিং খোলার পায়তারার অপ্রকাশিত প্রভাবও শিক্ষার্থীদের ওপর প্রভাব ফেলেছে।

জানা গেছে, ৮টি শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে গতবছরের তুলনায় গণিতে সবচেয়ে বেশি ফল বিপর্যয় ঘটেছে সিলেট বোর্ডে। এরপরই দিনাজপুর বোর্ডের অবস্থান। সিলেট বোর্ডে গতবছর মোট পাস করেছিল ৯৬.৮৮ ভাগ। এবার সেখানে পাস করেছে ৮৪.৮৬ ভাগ। অর্থ্যাৎ প্রায় ১২ ভাগ শিক্ষার্থী কম পাস করেছে। দিনাজপুরে গতবছর পাস করে ৯৬.৪৮ ভাগ। এবার সেখানে নেমে দাঁড়িয়েছে ৮৭.৭৪ ভাগ। এখানে প্রায় সাড়ে ৮ ভাগ কম। গণিতে ফল বিপর্যয়ের ব্যাপারে সিলেট শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আবদুল মান্নান খান সোমবার বিকালে মোবাইল ফোনে বলেন, কয়েকটি কারণে এই ঘটনা ঘটেছে। প্রশিক্ষিত শিক্ষকের খুবই অভাব রয়েছে। সব জায়গায় দক্ষ শিক্ষক নেই। গণিতের শিক্ষকেরও সংকট রয়েছে। আবার যেসব শিক্ষক প্রশিক্ষণ পেয়েছেন তাদের অনেকে তা যেমন আয়ত্ত করতে পারেননি, তেমনি শিক্ষার্থীদের অনেকেও বিষয়টি বুঝতে পারেনি। তবে তার ধারণা এটা প্রথমবার হওয়ায় এমন ঘটেছে। তিনি আরও বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠানে পদ আছে, কিন্তু আমরা লোকের অভাবে সেখানে নিয়োগ দিতে পারছি না। সিলেট হাওর-বাঁওড় ও চা বাগানের এলাকা। তাই নিয়োগ পেলেও পরে অনেকেই ছেড়ে চলে আসেন। প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করেছেন দিনাজপুর বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলাউদ্দিন মিয়া। তিনি বলেন, সৃজনশীল পদ্ধতি আমাদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি বাস্তবায়ন করছে মাধ্যমিক শিক্ষাখাত উন্নয়ন প্রোগ্রামর (সেসিপ) মাধ্যমে। সেসিপের নথিপত্রে দেখা গেছে, গণিত বিষয়ের সাধারণ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় সেপ্টেম্বর-নভেম্বর মাসে। আর মাস্টার ট্রেইনার প্রশিক্ষণ দেয়া হয় জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসে। সেই হিসাবে দেখা যাচ্ছে, যেসব শিক্ষক বছরের শেষের দিকে প্রশিক্ষণ পেয়ে বিষয়টির সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন, তারা নবম শ্রেণিতে আর পাঠদানে তা কাজে লাগাতে পারেননি।

সেসিপের আরেক নথিতে দেখা যাচ্ছে, গণিত এবং উচ্চতর গণিত বিষয়ে মোট ৬৯৫ জনকে মাস্টার ট্রেইনার এবং ২৬ হাজার ৪৫৭ জনকে সাধারণ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। তবে এই প্রশিক্ষণ তথ্যের সঙ্গে একমত নন দেশের সাধারণ শিক্ষকরা। তারা বলছেন, দেশে বর্তমানে প্রায় ১৯ হাজার মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল রয়েছে। ব্যানবেইসের (বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো) তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক স্কুলেই গণিতের শিক্ষক নেই। অন্য বিষয়ের শিক্ষকরা কোনো রকমে জোড়াতালি দিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে নিচ্ছেন। সুতরাং গণিতের শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়ার তথ্য কাগজ-কলমের চিত্র বৈ কিছু নয়। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সেসিপের যুগ্ম প্রোগ্রাম ডিরেক্টর (অতিরিক্ত সচিব) রতন রায় সোমবার দুপুরে নিজ দফতরে যুগান্তরকে বলেন, কতটি প্রতিষ্ঠানে গণিতের শিক্ষক নেই, তা আমরা বলতে পারব না। তবে এটা ঠিক যে, সব স্কুলে গণিতের শিক্ষক নেই। হয়তো কেউ পদার্থ বা রসায়ন বিষয়ে পাস করা গ্র্যাজুয়েট। বিএসসি পাস হিসেবে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়। তখন এই গ্র্যাজুয়েটই বিজ্ঞানের বিষয়ের পাশাপাশি গণিতও পড়িয়ে থাকেন। তিনি বলেন, আসলে এই সমস্যাটা স্কুলের নয়, নিয়োগ বিধিমালারই। বিধিতে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগের সুযোগ নেই। তাতে বিএসসি শিক্ষকের কথা বলা আছে। ফলে অন্য বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগ পেয়ে যায়। আর এভাবে যখনই কেউ নিয়োগ পেয়ে যান তখন ইচ্ছা আর প্রয়োজন থাকলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান গণিতের শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারে না। কেননা, নিয়োগ বিধিমালা বা জনবল কাঠামো অনুযায়ী ১৩ জনের বেশি শিক্ষকের এমপিও (বেতনভাতা) সরকার দেবে না। তবে যেসব স্কুল নিজ অর্থে বেতন দিতে পারে, সেসব স্কুল এ পদে নিয়োগ দেয়, যদিও এ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেশে হাতেগোনা।