এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজ-মাদরাসায় নজরদারিতে আসছে ‘ডিজিটাল-জাল’

 

স্টাফ রিপোর্টার: একাডেমিক দুর্নীতি রোধে দেশের এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজ-মাদরাসায় নজরদারিতে ‘ডিজিটাল-জাল’ বিস্তার করছে সরকার। কোন শিক্ষক কেমন পড়াচ্ছেন বা কোন প্রতিষ্ঠান ছাত্রছাত্রীদের প্রতি কেমন যত্ন নিচ্ছেন তা পর্যবেক্ষণেই এ নজরদারি। শিক্ষার্থীরা কেন কোচিং-প্রাইভেটে ঝুঁকছে তাও বের হয়ে আসবে এর মাধ্যমে। একই সাথে প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানাগারে কেমন কাজ হয় কিংবা ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মতো সহশিক্ষা কার্যক্রম আদৌ চর্চা হয় কিনা তাও বের হয়ে আসবে এর মাধ্যমে। শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিতে প্রতিষ্ঠানপ্রধান বা ব্যবস্থাপনা কমিটির ভূমিকা, অভিভাবকের সাথে প্রতিষ্ঠানের সম্পর্কসহ মোট ১১৪টি বিষয়ে দৃষ্টি দেয়া হবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, অনলাইনে পরিচালিত হবে এ কার্যক্রম। নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে ও নির্ধারিত ফরমে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানপ্রধানকে মন্ত্রণালয়ের কাঙ্ক্ষিত তথ্য দৈনিক ‘আপলোড’ করতে হবে। এ ছাড়া একটি প্রতিষ্ঠান বছরে একবার পার্শ্ববর্তী প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করবে। এ নজরদারির নাম দেয়া হয়েছে ‘পিয়ার ইন্সপেকশন’ (সমজাতীয় পরিদর্শন)। প্রাথমিকভাবে এমপিও সুবিধাপ্রাপ্ত প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সাড়ে ৫ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী এ নজরদারির আওতায় আসবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওই সংস্থার পরিচালক অধ্যাপক মফিজউদ্দিন আহমদ ভূঁইয়া বলেন, ‘স্বমূল্যায়ন’ ও ‘সমজাতীয় পরিদর্শন’- এই দুই পদ্ধতির আড়ালে মূলত আমরা দৈনিক ভিত্তিতে দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করব। এর মাধ্যমে স্কুলগুলোর একাডেমিক ও আর্থিক চিত্র বিশেষ করে অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য বেরিয়ে আসবে। তিনি বলেন, সারা দেশে আমাদের ৩০ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। বর্তমান পদ্ধতিতে বছরে দেড় হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন সম্ভব হয় না। এ প্রক্রিয়ায় আমরা একটি প্রতিষ্ঠানে ৫ বছর পরও গিয়ে থাকি। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর একাডেমিক ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা আমাদের নজরদারির বাইরে থেকে যাচ্ছে। তবে প্রস্তাবিত ডিজিটাল পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা গেলে এসব প্রতিষ্ঠানই বছর বছর পরিদর্শন ও নিরীক্ষা করা সম্ভব হবে। এতে করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একাডেমিক, প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষেত্রে শৃংখলা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষে এ কার্যক্রমটি পরিচালনা করবে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর (ডিআইএ)। নতুন এ পদ্ধতি প্রবর্তনের লক্ষ্যে প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ পর্যায়ে আছে। এ পদ্ধতি প্রবর্তনে ওয়েবসাইট নির্মাণ, সফটওয়্যার তৈরি, সার্ভার ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি ক্রয়সহ মোট ১০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। আজ আনুষ্ঠানিকভাবে এ কার্যক্রমের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হবে। এ লক্ষ্যে রাজধানীর নায়েম (জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি) মিলনায়তনে দিনব্যাপী কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে।

ডিআইএ সূত্র জানায়, ‘স্বমূল্যায়ন’ ও ‘সমজাতীয় পরিদর্শন’- এই দুই পদ্ধতি পরিদর্শনের জন্য সরকার ১৪টি বিষয়ের ফরম তৈরি করেছে। এতে মোট ১১৪ ধরনের প্রশ্ন আছে। এসব তথ্য সংগ্রহ, পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করে পরবর্তী সময়ে মন্ত্রণালয় করণীয় নির্ধারণ করবে। বিশেষ করে অনিয়ম-দুর্নীতি বেরিয়ে এলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ডিআইএ চিহ্নিত প্রতিষ্ঠানে তদন্ত করবে।

নজরদারির ১৪টি বিষয় হচ্ছে : প্রাতিষ্ঠানিক, শিক্ষকের পেশাদারিত্ব-শ্রেণী পাঠদান, প্রতিষ্ঠানপ্রধানের একাডেমিক কার্যক্রম মূল্যায়ন, শিক্ষার্থীর কৃতিত্ব মূল্যায়ন, ক্লাস রুটিন পর্যালোচনা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সমাবেশ, শ্রেণিকক্ষ পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ, শিক্ষার্থীর আসন ব্যবস্থা, মিলনায়তন, পাঠাগার, বিজ্ঞানাগার, কম্পিউটার ল্যাব, ল্যাঙ্গুয়েজ ল্যাব, সহশিক্ষা কার্যক্রম ও অভিভাবক-শিক্ষক সম্পর্ক। ডিআইএ পরিচালক অধ্যাপক ভূঁইয়া বলেন, আমাদের পরিকল্পনা হচ্ছে, ‘স্বমূল্যায়ন’ ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট কিছু তথ্য দৈনিক ওয়েবসাইটে আপলোড করতে হবে। আর পিয়ার-রিভিউ হবে বছরে একবার। নিু মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও দাখিল মাদ্রাসা বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২০ জানুয়ারির মধ্যে পরিদর্শন করতে হবে। এরপর ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সে তথ্য অনলাইনে আপলোড করতে হবে। আর কলেজ পর্যায়ের পরিদর্শন ১ জুলাই শেষে ২০ জুলাইয়ের মধ্যে শেষ করে তা ১০ কার্যদিবসের মধ্যে অনলাইনে আপলোড করতে হবে। এ তথ্য শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা সচিব, সংশ্লিষ্ট অধিদফতরের মহাপরিচালক, বোর্ড চেয়ারম্যান, ডিআইএ’র দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা দেখতে পাবেন।

নতুন এ ডিজিটাল-নজরদারি কার্যক্রমের ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে কাজ করছেন ডিআইএ’র উপপরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকার। এ বিষয়ে তিনি সোমবার সকালে যুগান্তরকে বলেন, মূলত শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার এ পদক্ষেপ নিয়েছে। পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়ন সম্ভব হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সার্বিক কার্যক্রম ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত, শিক্ষণ ও শিখন (টিচিং-লার্নিং) পদ্ধতির উন্নয়ন হবে। আমরা জানতে পারব, কোথায় কোন বিষয়ের শিক্ষক ক্লাসে ঠিকমতো পাঠদান করছেন না। এর ফলে শিক্ষার্থীরা কোচিং-প্রাইভেটে ঝুঁকছে। এ পদ্ধতির কারণে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার সঙ্গেও শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যুক্ত হবে। আর এর মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সব ধরনের দুর্নীতি থেকে মুক্ত এবং আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত করা সম্ভব হবে। ১৪টি বিষয়ের ফরম পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এতে মোট ১১৪ বিষয়ে তথ্য চাওয়া হবে। এর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়ের ফরমে শিক্ষকের পোশাক পরিচ্ছদ শিক্ষকসুলভ কিনা, শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ কেমন আনন্দঘন, মোট ক্লাসের সংখ্যা, শিক্ষার্থী উপস্থিতি, অনুপস্থিতি, বিলম্বে উপস্থিতি, শ্রেণিভিত্তিক ক্লাসের সংখ্যা, দুর্বল শিক্ষার্থীর জন্য ক্লাসের সংখ্যা, সিলেবাস অনুসারে পাঠদানের অগ্রগতি, এসিআরে শিক্ষকের প্রাপ্ত নম্বর ইত্যাদি রয়েছে। শিক্ষকের পেশাদারিত্ব-শ্রেণি পাঠদান বিষয়ে এক একজন শিক্ষকের মোট ১২টি তথ্য নেয়া হবে। এগুলো হচ্ছে- শিক্ষকের প্রশিক্ষণ, তার শিক্ষণ পদ্ধতি কতটা অংশগ্রহণমূলক, প্রশ্নোত্তরভিত্তিক বা মাল্টিমিডিয়ায় লেকচার দেন কিনা, পাঠদান পরিকল্পনা অনুসরণ, পূর্বপাঠের পুনঃআলোচনা, শ্রেণিকক্ষে ব্যবহৃত শিক্ষা উপকরণের নাম, শ্রেণিকক্ষে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পাঠদান করেন কিনা, পাঠদান পূর্বপ্রস্তুতি নেয়া হয় কিনা, শিক্ষার্থীর সঙ্গে সম্পর্ক, শ্রেণিকক্ষে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য গৃহীত ব্যবস্থা, শিক্ষক ডায়েরি প্রতিপালন করেন কিনা, শিক্ষার্থীর ডায়েরি যাচাই করেন কিনা ইত্যাদি।

প্রতিষ্ঠানপ্রধানের একাডেমিক কার্যক্রম মূল্যায়নে ১৭টি বিষয় রয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- প্রতিষ্ঠানপ্রধানের কক্ষে জাতির জনকের প্রতিকৃতি আছে কিনা, জাতীয় দিবস উদ্যাপন, তিনি শ্রেণি পাঠদান পর্যবেক্ষণ করেন কিনা, প্রতিদিন কতজন শিক্ষকের পাঠদান পর্যবেক্ষণ করা হয়, শিক্ষণ-শিখন নিয়ে শিক্ষক সভা হয় কিনা, অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক পরীক্ষার আগে কতটি শিক্ষকসভা হয়েছে, দুর্বল শিক্ষার্থী শ্রেণিভিত্তিক কতজন আছেন, শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে প্রমিত ভাষা ব্যবহার করেন কিনা, যথাসময়ে কতজন শিক্ষক-কর্মচারী উপস্থিত হন, শিক্ষার্থীর পারফরম্যান্স রিপোর্ট অভিভাবককে দেয়া হয় কিনা, অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার ফলাফল পরিচালনা কমিটির সভায় উপস্থাপন ও কমিটির পরামর্শমতো পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হয় কিনা, শিক্ষার্থী ক্লাসে না এলে তা অভিভাবককে এসএমএস বা মোবাইলফোনে জানানো হয় কিনা ইত্যাদি। শিক্ষার্থীর কৃতিত্ব মূল্যায়ন বিষয়ে মোট ১১টি তথ্য বের করা হবে। এগুলো হচ্ছে- বিগত মাসে শিক্ষণ দিবস, উপস্থিতি, টিউটোরিয়াল পরীক্ষা প্রাপ্ত নম্বর, পাঠ গ্রহণে মনোযোগ, সহপাঠীদের প্রতি মনোভাব, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক দিকে পারদর্শিতা ইত্যাদি। বিজ্ঞানাগার বিষয়ে জানাতে হবে ১৬টি তথ্য। এগুলো হচ্ছে- বিদ্যালয়ের ল্যাব সংখ্যা, প্রদর্শক ও শিক্ষক আছেন কিনা, আয়তন, শিক্ষার্থী সংখ্যা, আসবাবপত্র, সপ্তাহে ব্যবহারিক ক্লাস সংখ্যা, এসব ক্লাসে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থী সংখ্যা, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও রাসায়নিক দ্রব্যাদি আছে কিনা ও তার তালিকা। কম্পিউটার ল্যাব ও ল্যাঙ্গুয়েজ ল্যাবের বিষয়েও ডজনখানেক তথ্য দিতে হবে। জানাতে হবে সহশিক্ষা কার্যক্রম বিষয়ে ৭টি ও অভিভাবক-শিক্ষক সম্পর্ক বিষয়ে ৮টি তথ্য।