এবার পাবনায় আশ্রমের সেবককে কুপিয়ে হত্যা

 

স্টাফ রিপোর্টার: নাটোরে মুদি দোকানি সুনীল গোমেজ, ঝিনাইদহে পুরোহিত আনন্দ গোপাল, চট্টগ্রামে এসপির স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যার রেশ কাটতে না কাটতেই এবার পাবনায় একই কায়দায় খুন হলেন শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র আশ্রমের সেবক নিত্যরঞ্জন পাণ্ডে (৬২)। প্রতিদিনের মতোই গতকাল শুক্রবার ভোরে আশ্রম থেকে হাঁটতে বের হয়েছিলেন নিত্যরঞ্জন। কিছু দূর যাওয়ার পরই পাবনা মানসিক হাসপাতালের মূল গেটের রাস্তায় দুর্বৃত্তরা ঘাড়ে-মাথায় এলোপাতাড়ি কুপিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে ফেলে রেখে যায় নিথর দেহ। দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক বেছে বেছে হত্যার (টার্গেট কিলিং) ঘটনার প্রেক্ষাপটে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দেশজুড়ে জঙ্গি দমনে সাত দিনের ‘সাঁড়াশি অভিযান’ শুরুর দিন সকালেই খুন হলেন নিত্যরঞ্জন পাণ্ডে।

নিত্যরঞ্জনের বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার সদর থানার আড়োয়াকংসু গ্রামে। তিনি দুই ছেলে ও এক মেয়ের জনক। তার বড় ছেলে নন্দ দুলাল পাণ্ডে গোপালগঞ্জে এক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে চাকরিরত। তার বাবার নাম রসিক লাল পাণ্ডে। নিত্যরঞ্জন প্রায় ৪০ বছর ধরে ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র সত্সঙ্গ আশ্রমের সেবায়েত হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।

হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ও ঘাতকদের গ্রেফতার দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ এবং পূজা উদ্যাপন পরিষদ। অন্যথায় দেশব্যাপী কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি জানিয়েছে তারা। ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনার অভিজিত্ চট্টোপাধ্যয় গতকাল দুপুরে সত্সঙ্গ আশ্রমে এসে নিহতের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় তিনি নিহতের শাশুড়ি ও নাতিকে সমবেদনা জানান। তিনি যে কোনো প্রয়োজনে তাদের সাথে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। প্রায় ২০ মিনিট অবস্থানকালে তিনি সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্নের জবাব দেননি।

আশ্রম কর্তৃপক্ষ জানান, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নিত্যরঞ্জন প্রতিদিনের মতো গতকালও প্রাতর্ভ্রমণে বের হন। পরে আশ্রমের সেবক হরিপদ মজুমদার হাঁটতে বের হয়ে পাবনা মানসিক হাসপাতালের মূল গেটের রাস্তায় তার মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে পাবনা সদর থানায় নিয়ে আসে। এ ঘটনার পর থেকে আশ্রম এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। হত্যাকাণ্ডের খবর ছড়িয়ে পড়লে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ, পূজা উদ্যাপন পরিষদ, জেলা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ পাবনা সদর থানায় ভিড় জমান। জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি রেজাউল রহিম লাল সকালে থানায় এসে তার লাশের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ঘাতকদের দ্রুত আটকের দাবি জানান।

দুপুরে ময়নাতদন্ত শেষে বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুল মুক্তমঞ্চে এক প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। প্রতিবাদ সমাবেশে নেতৃবৃন্দ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঘাতকদের গ্রেফতার দাবিতে আল্টিমেটাম দেন। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ পাবনার সাধারণ সম্পাদক বিনয় জ্যোতি কুণ্ডু, পূজা উদ্যাপন পরিষদ পাবনার যুগ্মসাধারণ সম্পাদক বাদল চন্দ্র ঘোষ, সত্সঙ্গ আশ্রমের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক যুগল কিশোর ঘোষ প্রমুখ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। স্থানীয় লোকজন বলেন, নিহত নিত্যরঞ্জনের কোনো শত্রু ছিল বলে কেউ কখনো শোনেননি। তিনি রাস্তা দিয়ে চলাচল করার সময়ও একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে কথাবার্তা বলতেন না। তিনি তার নাতি (মেয়ের পুত্র) হৃদয় বাগচীকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। এ বিষয়ে পাবনার রাধানগর মজুমদার একাডেমি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র হূদয় বাগচী কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, আমি ক্লাস ফোরে পড়ার সময় দাদু আমাকে এখানে নিয়ে আসেন। তিনি আমাকে তার কাছে কাছে রাখতেন, পড়াশোনা করাতেন। এখন আমি কার কাছে পড়াশোনা করব! পাবনা শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র সত্সঙ্গ আশ্রমের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক যুগল কিশোর ঘোষ সাংবাদিকদের জানান, এই আশ্রমের সঙ্গে বাংলাদেশ এবং ভারতে কোটি কোটি মানুষ জড়িত। এই প্রতিষ্ঠানকে হেনস্তা করতেই সেবায়েতকে হত্যা করা হয়েছে। প্রতিবাদ সভা শেষে নিত্যরঞ্জনের লাশ হিমাইতপুর সত্সঙ্গ আশ্রমে নেয়া হলে সেখানে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। এ সময় আশ্রমের শতাধিক সদস্য কান্নায় ভেঙে পড়েন। এরপর তার আত্মার শান্তি কামনায় বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়। প্রার্থনা শেষে তার লাশ গোপালগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হয়।

পাবনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল হাসান জানান, হত্যার কারণ ও হত্যাকারী সম্পর্কে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গতকাল রাত পৌনে নয়টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত মামলা হয়নি বলে তিনি জানান। পাবনা (সদর সার্কেলের) সহকারী পুলিশ সুপার শেখ সেলিম বলেন, নিত্যরঞ্জনকে ঘাড়ে ও মাথায় এমনভাবে কোপানো হয়েছে যে, মনে হয় খুনিরা তার শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে চেয়েছিলো। জঙ্গিরা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে এখনই কোনো মন্তব্য করা যাবে না। এদিকে ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন পাবনা পুলিশ সুপার আলমগীর কবিরসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। পুলিশ সুপার বলেন, ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার লিটন কুমার দাস, সহকারী পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) শেখ সেলিম খান, সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল হাসানসহ অপর দুই এসআইকে নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে ৱ্যাব-১২-এর সিও অ্যাডিশনাল ডিআইজি শাহাবুদ্দিন খান ঘটনাস্থল ও আশ্রম পরিদর্শনে এসে আশ্রম কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেন। তিনি বলেন, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। যারাই এর সাথে জড়িত থাকুক, ধরা পড়বেই।