এবার কোনপথে এগুবে বিএনপি

স্টাফ রিপোর্টার: জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় কারাবন্দি বেগম খালেদা জিয়ার দ্রুত মুক্তির প্রত্যাশায় বিএনপি এতোদিন নিরুত্তাপ আন্দোলন চালালেও সোমবার আপিল বিভাগ হাইকোর্টের দেয়া জামিন ৮ মে পর্যন্ত স্থগিত করায় তাদের সে স্বপ্ন এখন ফিকে হতে চলেছে। এ ছাড়াও দলটিকে ঢাকায় বড় কোনো জনসভা করতেও সরকার নানা কৌশলে বাধা দিচ্ছে। শান্ত্মিপূর্ণ কর্মসূচি থেকেও দলের সক্রিয় নেতাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এ অবস্থায় বিএনপি আগের অবস্থানে থেকে নিরম্নত্তাপ কর্মসূচি চালিয়ে যাবে, নাকি নতুন করে কঠোর আন্দোলনের ডাক দেবে- তা এখন সর্বস্ত্মরে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরাও আগামীদিনের আন্দোলন পরিকল্পনার ছক জানতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন।

অন্যদিকে খালেদা জিয়ার জামিন প্রক্রিয়া প্রলম্বিত হওয়ার ইস্যুতে বিএনপির কর্মসূচি দেখে ‘ব্যবস্থা’ নেয়ার টার্গেট নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আরও গভীরভাবে সরকারবিরোধী এ দলটিকে পর্যবেক্ষণে রেখেছে। আইনগত প্রক্রিয়ায় দলীয় চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে সহসা জামিনে মুক্ত করতে না পেরে ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা যে কোনো ধরনের বড় কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারে এমন আশঙ্কায় প্রশাসনও সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে আমদানি-রপ্তানি ও শিল্পকারখানাসহ সর্বস্তরের ব্যবসা-বাণিজ্যে।

তবে যাদের নিয়ে এতো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও সতর্কতা, সে দলের নীতি-নির্ধারকদের কাছ থেকে আগামীদিনের উত্তপ্ত কর্মসূচির কোনো বার্তা পাওয়া যায়নি। বিএনপির প্রথমসারির একজন নেতা জানান, জামিনে চেয়ারপারসনের সহসা মুক্তি পাওয়া নিয়ে তাদের প্রত্যাশা পুরোপুরি ভঙ্গ হয়েছে। এ নিয়ে তারা প্রচণ্ড হতাশ হলেও শিগগিরই কোনো কঠোর আন্দোলন কর্মসূচির ডাক দেয়ার পরিকল্পনা নেই। তবে নানা অপকৌশলে বিএনপিকে কোনঠাসা রেখে ক্ষমতাসীনরা ফের ফাঁকা মাঠে গোল দেয়ার চেষ্টা করলে কৌশলে তার জবাব দেয়া হবে বলে জানান দলের ওই প্রভাবশালী নেতা।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন অভিযোগ করেন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে জেলে নিয়ে সরকার বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে বিএনপিকে দুর্বল ও বিনষ্ট করার চেষ্টা করেছে। সরকার আশা করেছিলো এতে বিএনপির ঐক্য ক্ষতি ও বিনষ্ট হবে। অথচ বেগম জিয়া কারাবন্দি হওয়ার পর তা বরং হিতেবিপরীত হয়েছে। বিএনপির ঐক্য আরো শক্তিশালী হয়েছে।

দলের নীতি-নির্ধারকদের একাধিক সূত্র জানায়, খালেদা জিয়াকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে সরকার যে নীলনকশা তৈরি করেছে তা বাস্তবায়নে হাইকোর্টের দেয়া জামিন আপিল বিভাগ স্থগিত করতে পারে এমন আশঙ্কা তারা আগে থেকেই করেছিলেন। তাই এ বিষয়টি মাথায় রেখে বিএনপি আগেভাগেই নতুন পরিকল্পনার ছক এটেছে। সে অনুযায়ীই দল সামনে এগোবে বলে সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে।

সূত্র জানায়, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও আগামী নির্বাচন-এই দুই এজেন্ডায় নতুন কৌশলে এগোবে বিএনপি। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছুতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি নানা উদ্যোগ নেয়া হবে। পাশাপাশি সরকারের ওপর জনমত ও আন্তর্জাতিক মহলের কার্যকর চাপ তৈরিতে বৃহত্তর প্লাটফরম গড়ে তোলা হচ্ছে। কূটনৈতিক মহলের পাশাপাশি তৎপরতা চালানো হচ্ছে ব্যবসায়ী, পেশাজীবী ও সুশীল সমাজে। এ সব কার্যক্রম সুনির্দিষ্ট সাংগঠনিক কাঠামোর ভেতর দিয়েই পরিচালিত হবে। খালেদা জিয়ার মুক্তিতে বিলম্বের সূত্র ধরেই নতুন এ কৌশল নিয়েছে বলে জানান নেতারা।

জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপগুলো দৃশ্যমান করে আন্দোলন ও আলোচনার পথে চলবে বিএনপি। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপগুলোর আয়োজন ও বাস্তবায়নের প্রস্তুতি নেয়া হবে। জোটসহ দেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী ও সুশীল সমাজের মনোভাব এবং পরামর্শকে প্রাধান্য দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি সে পদক্ষেপগুলো দৃশ্যমান করা হবে। এ ব্যাপারে নীতিগত অবস্থানে পৌঁছুতে ও কর্মপদ্ধতি নির্ধারণে শিগগিরই দলের সিনিয়র নেতারা বৈঠকে বসবেন। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস-চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও যুগ্ম-মহাসচিবদের অংশগ্রহণে সে বৈঠকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সার্বিক নির্দেশনা দেবেন। এছাড়া সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন আদায়ের দীর্ঘমেয়াদি কর্মপন্থা নির্ধারণে আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন আদায়ের বিশেষ একটি উদ্যোগের ভেতর দিয়ে শিগগিরই কয়েকটি দেশ সফর করবে বিএনপির উচ্চপর্যায়ের এক বা একাধিক প্রতিনিধি দল।

বিএনপি দলীয় আইনজীবীরা জানান, কেবল খালেদা জিয়ার মুক্তিই নয়, দলের কারাবন্দি নেতাকর্মীদের মুক্তিতে আইনি লড়াই জোরদার করার তাগিদ দিয়েছেন শীর্ষ নেতারা। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের যথাসম্ভব আইনি জটিলতা ও কারামুক্ত রাখতে চেষ্টা চালাবে তারা। পাশাপাশি দলের সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাগুলোর দিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখা হবে।

দলের দায়িত্বশীল কয়েকটি সূত্র জানায়, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে কর্মসূচিকেন্দ্রিক একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক প্লাটফরম তৈরির জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। দেশে ও দেশের বাইরে চলছে সে প্রক্রিয়া। এছাড়াও দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলেও জোর তৎপরতা শুরু করেছে বিএনপি। তারই অংশহিসেবে খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানোর পর কূটনীতিকদের ডেকে আনুষ্ঠানিক ব্রিফ করছে বিএনপি। বিএনপির কূটনীতিক উইংয়ে দায়িত্বপালনকারী একজন সিনিয়র নেতা জানান, বিএনপির নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের ব্যাপারে এখনো কূটনীতিকদের অবস্থান পরিষ্কার নয়। তবে সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে তারা উপলব্ধি করতে পারছেন দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। কয়েকজন কূটনীতিক নানা ফোরাম ও ব্রিফিংয়ে তেমন ইঙ্গিত দিয়েছেন। কূটনীতিকদের এমন উপলব্ধিকে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি আদায়ে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসেবে বিবেচনা করছে বিএনপি।

অন্যদিকে দেশে জনমত আরও জোরদার করতে অনানুষ্ঠানিকভাবে সাংগঠনিক সফর শুরু করবেন বিএনপি নেতারা। পাশাপাশি বিএনপি সমর্থক পেশাজীবী নেতারাও সাংগঠনিক সফরে বের হবেন। দলটির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, আগামী দিনে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় আরও বেশি সতর্ক এবং সহনশীল হবে বিএনপি। সরকারি উস্কানি বা দলের তরুণ নেতাদের অতিউৎসাহে নৈরাজ্যের সম্ভাবনা তৈরি হয় এমন কোনো কর্মসূচিতেও যাবে না তারা। আগামী আরও অন্তত ৩ মাস অর্থাৎ জুনের শেষভাগ পর্যন্ত কোনো কঠোর কর্মসূচিতে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে এরপরও বিএনপিকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে সরকার নতুন কোনো অপকৌশলের আশ্রয় নিলে তারা আর বসে থাকবে না বলে জানান নেতারা।

এদিকে চলমান পরিস্থিতি, আগামী নির্বাচনের পরিবেশ এবং দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক নুরুল আমিন বেপারী বলেন, ‘দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যত সুখকর হবে বলে মনে হচ্ছে না। দিন যতোই যাচ্ছে, পরিস্থিতি ততই পরিকল্পিতভাবে খারাপ দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ভিন্নমত ও বিরোধী শক্তি দমনে যা যা করণীয় তার সবই করা হচ্ছে। বিচার বিভাগ কাগজে-কলমে স্বাধীন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিচার বিভাগ তার স্বাধীন রায় প্রদান করতে গিয়ে যে ধকল সয়েছে তাতে তাদেরও রায় দেয়ার আগে ভাবতে হচ্ছে। পরিস্থিতি কারো জন্যই ইতিবাচক নয়। এ পরিস্থিতিতে সরকারের শুভ বুদ্ধির উদয় না হলে গণতন্ত্র, মত প্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, জনগণের নিরাপত্তাসহ সব ক্ষেত্রেই হুমকি সৃষ্টি হবে।’

এ পরিস্থিতিতে বিরোধীরা কি করতে পারে-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিরোধী রাজনৈতিক দল ও জোটের উচিত তাদের সামর্থ্যকে আগে বোঝার চেষ্টা করা। এবং শক্তিকে যথাযথোভাবে সঠিক স্থানেই কাজে লাগানো। অতীতে আমরা দেখেছি, বিরোধী শক্তি তাদের ক্ষমতাকে এমন স্থানে ব্যয় করেছে যেখানে তা ক্ষয়ের কথা ছিলৌ না। আবার এমন সময়ে আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিয়েছে যখন সর্বশক্তি দিয়ে মাঠে নামার প্রয়োজন ছিলো। ফলে নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে ভালোভাবে ওয়াকিবহাল হয়ে তা যথাযথোভাবে প্রয়োগ করতে না পারলে পরিস্থিতি তাদের জন্য আরও খারাপ হবে। আর পারলে হয়তো বা এ পরিস্থিতির মধ্যেও নিজেরা একটু অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে নিতে পারবে। আর অতীতের মতো নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের ভুল ও কেন্দ্রীয় নেতাদের গাঁ বাঁচিয়ে চলার প্রবণতা তাদের জন্য আরো ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির জন্ম দেবে।’