এটিএম কার্ড জালিয়াতির হোতা জার্মান নাগরিক থমাস পিটার ও আবু জাফরের স্বীকারোক্তিতে ফাঁসছেন কয়েকজন মেহেরপুর পাটকেলপোতার ছেলে ইন্সপেক্টর ফিরোজের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে সরব আলোচনা

 

স্টাফ রিপোর্টার: এটিএম কার্ড জালিয়াতির হোতা জার্মান নাগরিক থমাস পিটারকে ব্ল্যাকমেইল করতেন গুলশান থানার সাবেক ইন্সপেক্টর (তদন্ত) ফিরোজ কবির। তার নিয়ন্ত্রণেই ছিলো ১৫টি পস (পয়েন্ট অব সেল) মেশিন। তিনি পিটারের কাছ থেকে অন্তত ৩০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। আর গুলশানের খান এয়ার ট্রাভেলসের পরিচালক তৌহিদ খান ছিলেন পিটারের প্রধান সহযোগী। তার অফিসে বসেই স্কিমিং ডিভাইসের সাহায্যে এটিএম বুথের কার্ড ক্লোন করতেন পিটার। তৌহিদ খানের আরেক সহযোগী আবু জাফর নিজেও এই কাজে জড়িয়ে পড়েন।
আদালতে ১৬৪ ধারায় থমাস পিটার ও আবু জাফরের দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসব তথ্য বেরিয়ে আসে। জবানবন্দির বরাত দিয়ে গতকাল ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকার প্রতিবেদনের শিরোনামেই উঠে আসে ইন্সপেক্টর ফিরোজ কবিরের নাম। তিনি মেহেরপুর জেলা সদরের পিরোজপুরের পাটকেলপোতার ছেলে হওয়ায় এলাকায় উঠে বিরূপ সমালোচনার ঝড়। স্থানীয়রা এ তথ্য দিয়ে বলেছে, ইন্সপেক্টর ফিরোজ কবিরের নাম পত্রিকায় দেখে প্রথমে চমকালেও হতবাক হইনি, কেননা চাকরির পর তার সম্পদ সম্পত্তি গড়ার ধরণ বহুদিন ধরেই প্রশ্নবিদ্ধ।

আদালত সূত্রের বরাত দিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, থমাস পিটার তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, বিদেশি তিন বন্ধু (অ্যান্ড্রে, রোমিও ও আরেক বিদেশি) ছাড়াও গুলশান থানার সাবেক ইন্সপেক্টর (তদন্ত) ফিরোজ কবিরের সাথে তার ভালো সম্পর্ক ছিলো। তিনি বাসায় আসা-যাওয়া করতেন। খান এয়ার ট্রাভেলসের পরিচালক তৌহিদ খানের সাথেও ছিলো তার ভালো সম্পর্ক। এই সূত্রেই ফিরোজ কবিরের সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তৌহিদ খানই ফিরোজ কবিরকে জানিয়ে দেন জনশক্তি রফতানি সংক্রান্ত তার (পিটারের) সনদটি জাল। একপর্যায়ে পিটার স্কিমিং ডিভাইসের সাহায্যে এটিএম বুথের কার্ড জালিয়াতির বিষয়টি তৌহিদ খানকে বলে দেন। এরপরই মূলত তারা দুজন পিটারকে ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করেন। ধরা পড়ার ভয়ে তারা যা বলতেন তাতেই রাজি হতেন পিটার। এ বিষয়ে পিটার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, প্রথমে আমাদের মধ্যে সিদ্ধান্ত ছিলো বিদেশি ক্রেডিট কার্ড জাল করার। এরপর ফিরোজ কবির নিজেই নামিদামি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পস (পয়েন্ট অব সেল) মেশিন আমার কাছে নিয়ে আসতেন। এ বিষয়ে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নামও বলেন। খান এয়ার ট্রাভেলসের পরিচালক তৌহিদ খান সম্পর্কে পিটার বলেন, তিনি নিজেও একটি পস মেশিন পরিচালনা করতেন। এ কাজে তৌহিদ খানের সাথে আরও লোকজন সম্পৃক্ত ছিলো। তৌহিদ খানের গুলশানের অফিসে বসেই পস মেশিনে ব্যবহৃত এটিএম কার্ডে পাসওয়ার্ড যুক্ত করা হতো। ক্লোন করা পাসওয়ার্ড এটিএম কার্ডে যুক্ত করার দক্ষতা ছিলো তার। এজন্য এভাবে নতুন কার্ড বানানোর জন্য তৌহিদ আমার ওপর চাপ সৃষ্টি করতেন। ফিরোজ কবির ও তৌহিদ খান এভাবে জালিয়াতি করা এটিএম কার্ড ব্যবহার করে আমার কাছ থেকে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা নিয়ে গেছেন।

বাংলাদেশি গ্রাহকদের টাকা তুলে নেয়ার বিষয়টি তার ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো বলেও স্বীকার করেন পিটার। এছাড়া এখানকার গ্রাহকদের টাকা তুলে নেয়ার বিষয়টি তার জানা ছিলো না। এছাড়া তার কাছে এটিএম বুথে ব্যবহারের উপযোগী অন্তত শতাধিক অবৈধ কার্ড ছিলো। সেগুলো তিনি গুলশানের লেকে ফেলে দিয়েছেন। এজন্য পিটার ভুল স্বীকার করে ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজে আর নিজেকে জড়াবেন না বলেও অঙ্গীকার করেন।

এ বিষয়ে পিটার জবানবন্দিতে আরও বলেন, যেসব বাংলাদেশি ব্যাংক গ্রাহক আমার প্রতারণার ধারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি। আমি বাংলাদেশি রোজিনাকে (মেরিনা) বিয়ে করেছি। আমার দুটি সন্তান (একটি রোজিনার আগের সংসারের) রয়েছে। আমি পরবর্তী জীবন স্বাভাবিক এবং নিরাপদভাবে বাংলাদেশেই কাটাতে চাই। চলমান এই বিষয়টি আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তির পর সব ধরনের অপকর্ম থেকে নিজেকে মুক্ত রাখব। এ জন্য ডিবির শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সহযোগিতা চাই।

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে স্কিমিং ডিভাইস ও কার্ড জালিয়াতি বন্ধে বাংলাদেশ ব্যাংককেও কিছু পরামর্শ দেন তিনি। এ বিষয়ে পিটার বলেন, আমার ধারণা ফরিদ নাবির, তৌহিদ খান, ফিরোজ কবির এবং বিভিন্ন ব্যাংকের কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির সাথে জড়িত। গোয়েন্দা সংস্থার জিজ্ঞাসবাদে আমি বলেছি, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধরকরা প্রতারণার সাথে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যেন আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। না হলে এক সময় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়বে।

এদিকে পিটারের দেয়া স্বীকারোক্তি অনুযায়ী গুলশান থেকে গ্রেফতার করা হয় আবু জাফরকে। তিনি খান এয়ার ট্রাভেলসের মালিকানাধীন একটি ওয়েব পত্রিকার সংবাদকর্মী। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পস মেশিন আনা-নেয়ার কাজে তিনিই ছিলেন তৌহিদ খানের বিশ্বস্ত বন্ধু। গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে এটিএম কার্ড জালিয়াতির বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দেন আবু জাফর। পরে তাকে আদালতে হাজির করা হলে ৯ মার্চ তিনিও স্বীকারোক্তিমূলক জবাবনবন্দি দেন।

আবু জাফর জবানবন্দিতে বলেন, তিনি ২০১৫ সালের মার্চে খান এয়ার ট্রাভেলসে চাকরি নেন। সেখানে যাওয়া-আসার সময় তিনি প্রায়ই দেখতেন খান এয়ার ট্রাভেলসের পরিচালক তৌহিদ খান এবং তার বিদেশি পার্টনার পিটার পাশাপাশি রুমে বসেন। পিটারের সাথে অফিসের অন্য সবার কথা বলা নিষেধ ছিলো। তারা সেখানে কি করতেন তা জানতেন না আবু জাফর। তিনি তৌহিদ খানের মালিকানাধীন অনলাইন নিউজ পেপার নিউজ মেইল থেকে তার অপর একটি প্রতিষ্ঠান খান এয়ার ট্রাভেলস সেন্টারে যোগদান করেন। সেখানে যাওয়ার কিছু দিন পর তাকে প্রতিষ্ঠানটির মালিক জানান, ব্যবসায়িক লেনদেনের দেশি-বিদেশি কিছু টাকা আটকে আছে। সেগুলো তুলতে হবে।

এ বিষয়ে আবু জাফর বলেন, কিছু দিন পর দেখতে পাই যে, অফিসে বেশ কিছু অপরিচিত লোক একটি ব্যাগ নিয়ে তৌহিদ খানের রুমে আসে। কখনও কখনও তারা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতো। তখন তৌহিদ খান আমাকে ফোনে আদেশ করলে আমি ব্যাগগুলো তার রুমে পৌঁছে দিতাম। একটি ব্যাগ খুলে একদিন একটি পস মেশিন দেখতে পাই। ওই মেশিন দিয়ে কি হতো তখন আমি জানতাম না। অপরিচিত লোকগুলো মেশিন দিয়ে আসতো। তাদের মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নাম আমার মনে আছে। এগুলো হচ্ছে- হোটেল রিভারভিউ, সিলভারসহ আরও একটি হোটেল। সংশ্লিষ্ট সব কাজে একজন পুলিশ অফিসারের উপস্থিতি টের পাওয়ায় খুব একটা সন্দেহ করিনি। ওই পুলিশ অফিসারকে আমি আগে চিনতাম না। একদিন কয়েকটি ক্রেডিট কার্ড ও পিন নাম্বার দিয়ে তৌহিদ খান আমাকে এটিএম বুথে গিয়ে টাকা আনতে বলে। কিন্তু কার্ডগুলোর ওপরে কোনো লোগো না থাকায় সেগুলোকে অস্বাভাবিক লাগে। এরপর আমি অপারগতা প্রকাশ করি। এতে তিনি ক্ষেপে যান এবং চাকরি থেকে বের করে দেয়ার হুমকি দেন।

পিটার একটি বাঙালি মেয়েকে নিয়ে অফিসে আসতেন। তার সাথে একদিন কথা বলায় তৌহিদ খান ও পিটার আমার ওপর প্রচণ্ড ক্ষেপে যান। একদিন কোম্পানির ব্যাংক হিসাবের ৭ লাখ টাকা জব্দ করায় তৌহিদ খান আমাকে ব্যাংকের অফিসারদের সাথে কথা বলতে বলেন। আমি তাদের অনুরোধ করলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ টাকাটা ছেড়ে দেন। ওই ৭ লাখ টাকা উঠিয়ে এনে তৌহিদ খানের হাতে দেয়ার পর তিনি আমাকে এবং আমার সাথে থাকা আরেকজনকে পাঁচ হাজার টাকা করে দেন। তৌহিদ খান আমাকে একদিন জানান যে, অফিসের পস মেশিন নেই। আমাকে একটি পস মেশিন জোগাড় করতে বলেন। আমি অনেক চেষ্টা করেও একটি পস মেশিন জোগাড় করতে না পারায় তিনি আবারও আমার ওপরে ক্ষেপে যান। এরপর আরেক দিন তৌহিদ খান আমাকে কিছু হিসাব নম্বর দিয়ে বলেন, ওই হিসাবের টাকা ব্যাংক জব্দ করেছে। সেগুলো ছাড়ানোর বিষয়ে ব্যাংকের সাথে কথা বলার নির্দেশ দেন। আমার সন্দেহ হলে আমি ব্যাংক অফিসারকে জব্দকৃত টাকার উৎসের বিষয়ে জানতে চাই। তিনি কোনো উত্তর দেননি। সাংবাদিক পরিচয়ে কিছু ব্যাংক কর্মকর্তার সাথে কথা বলার পর জানতে পেরেছিলাম যে, এগুলো প্রতারণার মাধ্যমে এসেছে। বিষয়টি বুঝতে পারার পর আমি তৌহিদ খানকে জানাই, ওইসব টাকার ব্যাপারে আমি কারও সাথে কথা বলতে পারবো না। কিছুদিন ভয়ে আমি অফিসে যাওয়া বন্ধ করে দিই।

শেষদিকে তৌহিদ খানের সাথে পিটারের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিলো না। একদিন তৌহিদ খানই পিটারের রহস্য ফাঁস করেন। তিনি বলেন, ভুয়া ম্যানপাওয়ারের ব্যবসার নাম করে ভুয়া পাসপোর্ট দিয়ে ঢুকে পিটার অবৈধ কাজ করে বেড়াচ্ছেন। একদিন গোপনে পিটারের রুমে প্রবেশ করি। টেবিলের ওপরে ক্লোন কার্ড দেখতে পেয়ে সেখান থেকে দুটি তুলে রাখি। তৌহিদ খানের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য ও অন্য সবকিছু নিয়ে আমি একটি ডকুমেন্ট তৈরি করি এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে দেয়ার চেষ্টা করি। প্রাণের ভয়ে শেষ পর্যন্ত তা আর করিনি। প্রতিদিন বিভিন্ন লোকের মাধ্যমে আমাকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিতেন তৌহিদ খান।