একের পর এক পার পেয়ে যাচ্ছে চিহ্নিত মাদকব্যবসায়ীরা :তদন্তে গড়িমশি

 

স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গা জেলার ভারত সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে প্রতিদিনই উদ্ধার করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের মাদক।এসব মাদক অবৈধপথে ভারত থেকে পাচার করে আনা। সীমান্তরক্ষীবর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যদের নিয়মিত অভিযানে উদ্ধার হচ্ছে এসব ভারতীয় মালামাল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আটক হচ্ছে পাচারকারী দলের সদস্যরা। জব্দ হচ্ছে তাদের ব্যবহৃত যানবাহন।

এলাকার সচেনমহলের অনেকেই বলেছেন, বিগত বছরগুলোর তুলনায় চুয়াডাঙ্গা সীমান্তে বিজিবির হাতে চোরাকারবারী আটকের সংখ্যা বেড়েছে। একই সাথে বেড়েছে যানবাহন, অর্থাত চোরাই মোটরসাইকেল, মাইক্রোবাস ইত্যাদি জব্দের তালিকা। চোরাচালান হয়ে আসা পণ্য জমা হয়েছে কাস্টমসে। সংশ্লিষ্ট থানায় দায়ের করা হয়েছে অভিযোগ।অবাক হলেও সত্যি, উদ্ধারকৃত মাদক বা চোরাচালান পণ্যের মামলাগুলোর বর্তমান অবস্থা অনেকটা ডিপফ্রিজে থাকা সামগ্রির মতো, নেই মনিটরিং, সরকার পক্ষের বা তদন্তকারি কর্মকর্তার জোর পদক্ষেপ। আর আটককৃত মোটরসাইকেল অথবা মাইক্রোবাসের কোনোটি দখলে চলে যাওয়ার চূড়ান্ত অপেক্ষায় সেই অজ্ঞাতে থাকা মালিকের হাতে আবার কোনোটি জমা দিতে হয়েছে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার হেফাজতে। সংশ্লিষ্টসূত্র ও কাগজপত্র ঘেটে দেখা গেছে এর সবই হয়েছে আদালতের নির্দেশে, যা থানা থেকে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর হয়েছে।

চুয়াডাঙ্গা এবং মেহেরপুর ও ঝিনাইদহ জেলার একাংশে চোরাচালানবিরোধী অভিযানের সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রে মালামাল উদ্ধারকালে পাচারকারী পালিয়ে গেছে, অথবা মালিকবিহীন অবস্থায় উদ্ধার। এ ধরনের ঘটনাই বেশি ঘটে বলে দাবি চুয়াডাঙ্গা বিজিবির।চুয়াডাঙ্গাস্থ বিজিবি ৬ ব্যাটালিয়ন সদস্যরা চলতি বছরের ২০ এপ্রিল পর্যন্ত (৪ মাসে) ১৮ কোটি ৯০ লাখ টাকার মালামাল উদ্ধার করেছেন। উদ্ধারকৃত মালামালের শীর্ষে রয়েছে মারণনেশা ফেনসিডিল, মদ, টেলিভিশনের খুচরো যন্ত্রাংশ শাড়ি-কাপড়,ইমিটেশন জুয়েলারি, মোটর পার্টসসহ বিভিন্ন পণ্য। আটক করা হয়েছে ৬০ জন চোরাচালানীকে।

বিজিবিসূত্রে জানা গেছে, আটককৃত সবাই ধরা পড়েছেন হাতেনাতে।নিয়মানুযায়ী বিজিবির পক্ষ থেকে মালিকবিহীন পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা মালামালের বিবরণসহ সাধারণ ডায়েরি এবং আসামিসহ আটক পণ্যের ক্ষেত্রে নিয়মিত মামলা দায়ের করা হয়েছে। দুটি ক্ষেত্রেই আটককৃত যানবাহন সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার হেফাজতে দেয়ার আদেশ হয়েছে মাননীয় আদালত কর্তৃক।

সাধারণ মানুষ এ বিষয়টিকে দেখছেন ভিন্নভাবে। কারণ বিজিবির অভিযানে হাজার হাজার বোতল ফেনসিডিল, মদসহ যেসব যানবাহন ধরা পড়ে ওই সময়ে মাদকবহনকারী গাড়িগুলো থাকে নাম পরিচয়বিহীন। তাহলে আদালতে কে বা কারা গাড়ির মালিক দাবি করে আবেদন করছেন?আর আবেদনকালে এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাই বা কী করছেন?আইনানুযায়ী মাদক বা ভারতীয় মালামালসহ ধরা পড়া গাড়ির মালিকানা যিনি দাবি করবেন তিনিই ওই মামলার আসামি হিসেবে গণ্য হওয়ার কথা। কিন্তু এর কোনোটিই হচ্ছে না। প্রায় প্রতিটিই মামলারই চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল হয়েছে আদালতের কাছে। এ সকল প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে অভিন্ন বক্তব্য। নথিপত্রে প্রমাণ মিলেছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট থানার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা চূড়ান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, ঘটনার সত্যতা মেলেনি, মামলার লিখিত অভিযোগের সাথে আসামির জড়িত থাকার প্রমাণ মেলেনি, অথবা এ ধরনের ঘটনা ঘটেইনিএসব কথাবার্তা। আর এর সুযোগ নিয়েই আইনের ফাঁকফোকড় গলে পার পেয়ে যাচ্ছে প্রকৃত অপরাধী।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি আদালতকে ভুল বুঝিয়ে পার পেয়ে যাওয়া ছাড়া এর কিছু নয়। এ ব্যাপারে চুয়াডাঙ্গা পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাড. আলমগীর হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এসব ঘটনার সাথে একমত পোষণ করে জানান, কিছু অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা মাদকব্যবসায়ী অথবা চোরাকারবারীদের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করে আদালতে অসত্য তথ্য উপস্থাপন করেন। এসব ক্ষেত্রে আমরাও (সরকারি কৌশুলী) বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়। তবে মাদক মামলাগুলো সরকারের পক্ষ থেকে সবসময়ই অধিক নজরদারিতে রাখা হয়। আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর তা শুনানির জন্য নির্ধারিত দিন ধার্য থাকে। ওই দিন সরকারের পক্ষ থেকে নারাজি পিটিশন দিয়ে পুনঃতদন্তের আবেদন জানানো হয়। চুয়াডাঙ্গার সকল মামলা জিরো টলারেন্স দেখানো হয় বলে দাবি করেছেন এ সরকার পক্ষের আইনজীবী।

চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর আদালত কর্তৃক চূড়ান্ত কার্যক্রমের নির্দেশ এসেছে এমন কয়েকটি মামলার বিবরণ- জীবননগর থানার মামলা নং ১৬, তাং ২৮-০৭-২০১৩/ দামুড়হুদা থানার মামলা নং ৫, তাং ০৮-১২-২০১৩/ জীবননগর থানার মামলা নং-১৬, তাং ২২-০৫-২০১৩/ জীবননগর থানার মামলা নং ০২, তাং-০২-০৭-২০১৩/ চুয়াডাঙ্গা থানার মামল নং ২৪, তাং ২৫-০৬-২০১৩/ দামুড়হুদা থানার মামলা নং ১২, তাং ১৭-০৯-২০১৩। এ ৬টি মামলায় আসামির সংখ্যা ১৩। এজাহারে লিখিত বক্তব্যে দেখা গেছে মামলার আসামিদের মধ্যে মাদকসহ ধরা পড়েছেন ৫ জন বাকিরা রয়েছেন পলাতক। যেসব স্থান থেকে আসামিদেরকে আটক করা হয়েছে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই এলাকাগুলোর মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে উল্লেখিত ব্যক্তিরা। পুলিশের খাতায়ও রয়েছে এদের অনেকের নাম। ধরা পড়ে জেল খেটেছেনও কয়েকদফা। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে চিহ্নিত এসব মাদকব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ কীভাবে একতরফা অসত্য প্রমাণ হয়েছে?তাও আবার পুলিশের তদন্তে!

সচেতনমহল বলছেন, মাদক বন্ধ হলে, কমবে সব ধরনের অপরাধ। মাত্র কয়েকজন অসাধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যের অপতৎপরতা এদেরকে বিচারের মুখোমুখি করার পরিবর্তে সুযোগ করে দিচ্ছে মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়ানোর। একইসাথে দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে আবারও নেমে পড়া মাদকব্যবসায়। ৬ বিজিবি পরিচালকের বক্তব্য- বিজিবি কর্তৃক আটককৃত চোরাকারবারী, উদ্ধারকৃত মালামাল ও যানবাহন নিয়মানুযায়ী জমা দেয়া হয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কাছে। তবে মাদকের ক্ষেত্রে এসব কিছুই জমা থাকে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারে। মালিকবিহীন অবস্থায় কোনো অবৈধ পণ্য বা মাদক উদ্ধার করা হলে সংশ্লিষ্ট থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়। আর আসামিসহ ধরা হলে থানায় হস্তান্তর করা হয় নিয়মিত মামলাসহ এমনটিই জানালেন চুয়াডাঙ্গা ৬ বিজিবি পরিচালক লে. কর্নেল এসএম মনিরুজ্জামান। মামলার তদারকির বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যদের দায়িত্ব দেশের সীমান্ত পাহারা দেয়া, সীমান্ত দিয়ে অবৈধ যেকোনো ধরনের অনুপ্রবেশ ঠেকানো। এক কথায় বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যে যে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন তার সবকিছুই করে থাকেন বিজিবি জওয়ানরা।

মাদকদ্রব্য বা অন্য চোরাচালান হয়ে আসা পণ্য উদ্ধারের পর অথবা, চোরাকারবারী আটকের ঘটনা ঘটলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়ে থাকে। বিজিবি সদস্যরাই বাদী হয়ে থানায় লিখিত অভিযোগ অথবা মামলা দায়ের করে থাকেন। তারপরও আইনের ফাঁকফোকড় গলে অপরাধীরা পার পেয়ে গেলে সেটি অবশ্যই দুঃখজনক। আর সে যদি হয় মাদকব্যবসায়ী তাহলে তো কথাই নেই! এসব মামলার বিষয়ে আরও নজরদারি বাড়ানো হবে বলে জানালেন বিজিবির এ কর্মকর্তা।পুলিশের সাথে বিজিবির পেশাগত কোনো বিরোধ নেই দাবি করে তিনি আরও বলেন, স্ব-স্ব অবস্থানে থেকে আমাদের ওপর অর্পিত দ্বায়িত্ব পালনে আরও সচেষ্ট হলে এ অনাকাঙ্খিত ঘটনাগুলো এড়ানো সম্ভব। তাছাড়া হাতেগোনা কয়েকজন অসৎ ব্যক্তির কার্যক্রম কখনই স্থায়ী হতে পারে না। সামাজিক সচেতনতা এখন অনেক বেড়েছে। সচেতন মানুষগুলোর সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সম্পৃক্ততা ও সহযোগিতা বাড়লে সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে মাদক মামলাগুলো এতো দ্রুত নিস্পত্তি হওয়ার কথা নয়।

পুলিশ সুপার যা বলেন: চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার রশীদুল হাসান দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে আসছেন। বিজিবির পাশাপাশি সীমান্ত এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে নিয়মিত চলছে মাদকবিরোধী অভিযান। সর্বনিম্ন৪ মাস থেকে ৯/১০ মাসে মাদক মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল এবং তা নিষ্পত্তি শুনানির দিন ধার্য হওয়া অন্তত ৬টি মামলার বিষয়ে তিনি জানান, জীবননগর থানার মামলা নং ১৬ তাং ২৮.০৭.১৩, একই থানার মামলা নং ১৬ তাং ২.০৭.১৩, মামলা নং ০২ তাং ২.০৭.১৩। দামুড়হুদা থানার মামলা নং ০৫ তাং ০৮.১২.১৩ একই থানার মামলা নং ১২ তাং ১৭.০৯.১৩ এবং চুয়াডাঙ্গা সদর থানার মামলা নং ২৪ তাং ২৫.০৬.১৩ সম্পর্কে তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ বিষয়টি তিনি নিজেই তদারকি করছেন বলে জানা গেছে। পুলিশ সুপার আরও জানিয়েছেন মাদক মামলায় হাতেনাতে আসামি ধরা পড়ার পর তাদের ব্যবহৃত যানবাহন ছেড়ে (যদি আসামির নিজ নামে হয়) দেয়ার বিষয়টি এখনও ঘটেনি। তবে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের বিষয়টি অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে। এক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তার গাফিলতি পাওয়া গেলে নেয়া হবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। জেলা পুলিশ প্রধানও অভিন্ন ভাষায় বলেছেন, পুলিশের সাথে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পেশাগত কোনো বিরোধ নেই। তবে বিজিবির পক্ষ থেকে যখন মামলা লেখা হয় তখন আরও সচেতন হলে প্রকৃত অপরাধিরা এতো সহজে পার পাবার কথা নয়। মাদক নির্মূল ইস্যুতে বিজিবিকে সব ধরণের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন পুলিশ সুপার রশীদুল হাসান।