একুশে পদকপ্রাপ্ত বাউলশিল্পী খোদা বকস শাহ’র স্মরণোৎসব আজ

রহমান মুকুল: আজ ১৪ জানুয়ারি একুশে পদকপ্রাপ্ত উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান মরমি বাউলশিল্পী খোদা বকস শাহ’র ৩০তম স্মরণোৎসব নানা কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মরহুমের মাজার প্রাঙ্গণে বিকেলে জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার প্রধান অতিথি হিসেবে স্মরণোৎসবের শুভ সূচনা করবেন। বাংলা একাডেমির সহকারী পরিচালক ড. সাইমুন জাকারিয়ার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত স্মরণোৎসবে বিশেষ অতিথি থাকবেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইয়াহ ইয়া খান ও আলমডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার লিটন আলী।
স্মরণোৎসবের অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আজ বিকেল ৪টায় সাধুগুরুর আগমন, সাড়ে ৪টায় আসন গ্রহণ; ৫টায় অধিবাস শুরু, সাড়ে ৫টায় সাধক কবি খোদা বকস শাহ নিকেতনে ইতিহাস কার্যাবলী, বিধিবিধান জ্ঞাত, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় জ্ঞান রতœাকর ফকির লালন সাঁইজির জীবলীলা স্মরণ, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় গুরুকর্ম, রাত ৮টায় সমবেত কণ্ঠে গুরুদৈন্য, সাড়ে ৮টায় জলসেবা, রাত ৯টায় দৈন্যগান, রাত সাড়ে ১০টায় খোদা বকস শাহ’র গীতজ্ঞান সুধা, রাত সাড়ে ১১টায় চর্যাগীতির পূণর্জাগরণ, রাত দেড়টায় দুদ্দু শাহ, পাঞ্জু শাহ, বেহাল শাহ, শ্রীনাথ গোঁসাইসহ অন্যান্য মহতের গান পরিবেশন, রাত ২টায় অধিবাস সেবা। পরদিন ১৫ জানুয়ারি ভোরে গোষ্ঠলীলা, সকাল সাড়ে ৮টায় বাল্যসেবা, সকাল ৯টায় বাউল সঙ্গীত শুরু, দুপুর ২টায় পূর্ণসেবা।
লালন ঘরানার অকৃত্রিম গায়ক-সাধক খোদা বকস শাহ ১৯২৮ সালের বাংলা ৩০ চৈত্র চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার নিভৃত পল্লি জাহাপুরে জন্মগ্রহণ করেন। সঙ্গীত অন্তপ্রাণ এ মহৎ নিষ্ঠাবান মানুষটি অপরিসীম দরদ ও প্রচেষ্টায় বাংলা সঙ্গীতের মূলধারাকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করে তোলার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছেন। বাউলসম্রাট লালন শাহ’র ‘সহজ মানুষ’ খুঁজতে খুঁজতে একদিন নিজেই হয়ে উঠলেন আলাভোলা সেই কাক্সিক্ষত সহজ মানুষ। প্রখ্যাত নজরুল ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বিশারদ সুধীন দাস যথার্থ বলেছেন, ‘প্রথম দর্শনে-আলাপে তাকে মহর্ষি ব্যক্তিত্ব বলে মনে হয়েছিলো। এক পবিত্র অধ্যাত্মভাবে সেদিন তিনি আমাকে অভিভূত করেছিলেন। ‘এ প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত লালন গবেষক তৃপ্তি ব্রক্ষ্ম’র অভিমতটিও প্রনিধানযোগ্য। তিনি বলেন, খোদা বকস শাহ ছিলেন উদাসী ভাবুক প্রকৃতির। তাকে দেখে মনে হতো তিনি উর্দ্ধ জগতের মানুষ। শুধু কী মানুষ? গায়ক হিসেবেও তিনি ছিলেন আসাধরণ। তার কণ্ঠে লালনের গান শুনে মনে হােত ওটাই প্রকৃত লালন সঙ্গীত। এছাড়া সমগ্র ভাব সঙ্গীতেরও উস্তাদ শিল্পী ছিলেন তিনি। একতারার রিনিঝিনি এবং বায়ার গুরুগম্ভীর বোল সহসা অভিভূত করতো দর্শক-শ্রোতাদের। অপূর্ব গায়কী শৈলী মুহূর্তেই সম্মোহিত করে দিতো সঙ্গীত পিপাসু তৃষ্ণার্ত অন্তর। প্রত্যন্ত পল্লির একজন সাধক ফকিরের গান যে এতো অপরূপ সৌন্দর্য গঠিত হয়ে মানুষের হৃদয় জয় করতে পারে; তার উদাহরণ কেবল খোদা বকস শাহ নিজে। শুধু বিরল গায়ক হিসেবেই নন, অজস্র ভাবসঙ্গীতেরও স্রষ্টা। একাধারে সাধনার বলে সত্যিকার মানুষ হয়ে ওঠার এমন দৃষ্টান্ত সহজে মিলে না। শিল্প আর শিল্পীর এমন সমন্বয় ঘটাতে পারে কজন!
জাতি তার এ যোগ্য সন্তানের অসীম অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমি কর্তৃক ফেলো পদ ও ১৯৯১ সালে তাকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করে। ১৯৮৩ সালে তিনি শিল্পকলা একাডেমিতে লালন সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৯০ সালের ১৪ জানুয়ারি এই মহান সাধক পুরুষ মৃত্যুবরণ করেন।
শুধু দেশে নয়, দেশের সীমা অতিক্রম করে তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। জীবদ্দশায় এমন কী মৃত্যুর পরও সিদ্ধহস্ত এই সাধকের সঙ্গ লাভ ও বাউল তত্ত্ব অন্নেষণে বিভিন্ন সময়ে তার পূর্ণ কুটিরে ছুটে এসেছিলেন বিদগ্ধ লোক গবেষকগণ। আমেরিকা, জাপান, নরওয়েসহ বিভিন্ন দেশে লোক-সাহিত্য অনুরাগীরা আকৃষ্ট হয়েছেন মরমি এ সাধকের প্রতিভায়। যাদের মধ্যে বিশিষ্ট লালন গবেষক ড. ক্যারল সালম্যান, বিশিষ্ট লোক-গবেষক মাথাউকি অনিচি, মিস ভেরি প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া জাতিসঙ্ঘের ইউনেস্কো কর্তৃক লোক সাহিত্যকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণার পর থেকে বৃদ্ধি পায় খোদাবক্স শাহ’র বাস্তুভিটায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনের মনিষিদের আনাগোনা। কিন্তু পরিতাপের বিষয় মুখে মুখে মহান সাধকের স্মৃতি ও কর্মকে অম্লান রাখার প্রতিশ্রুতিগুলো শুধুই প্রতিশ্রুতি হিসেবে রয়ে গেছে।
খোদা বকস শাহ’র মাজারে একাধিকবার গেছেন নব্বই দশকের অন্যতম কবি আশরাফ রোকন। তিনি বলেন, সমাধি নির্মাণসহ গুণী এ সাধকের স্বহস্তে লিখিত পা-ুলিপি, ব্যবহৃত নানা আসবাবপত্র সামগ্রীসহ যাবতীয় স্মৃতি আজ ধ্বংসের সম্মুখীন। এ বিষয়ে প্রতিশ্রুতি নয়, জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন।
এই মহান ব্যক্তিত্বের বাস্তুভিটাসহ অসমাপ্ত সমাধিক্ষেত্রের বেহাল ও করুণ অবস্থা দেখতে অন্তর্জাতিক বিশিষ্টজনেরা আসলে বড়ই লজ্জায় পড়তে হয়। প্রকৃত গুণী ব্যক্তিকে সম্মান করতে না পারার কালিমা আমাদের আচ্ছন্ন করে। এই কালিমা মোচনের দাবি আজ উচ্চকিত হয়ে উঠেছে। উপরোক্ত মন্তব্য করেছেন শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্র বাংলাদেশের সভাপতি আতিকুর রহমান ফরায়েজী।