একাধিক অস্ত্রধারী গ্যাং বেপরোয়া : চাঁদার দাবিতে হুমকির মুখে ইটভাটাগুলো বন্ধের উপক্রম

কুমারী ইটভাটায় খুন : বদরগঞ্জের ইটভাটা মালিকের ছেলে অপহৃত : কার্পাসডাঙ্গায় একের পর এক হামলা : আতঙ্ক 

 

স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গা ইটভাটা গুলোতে সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজি, চাঁদার টাকা না পেয়ে খুন, অপহরণ ও বোমা হামলা আতঙ্কিত করে তুলেছে। নিরাপত্তাহীনতায় বেশ কয়েকটি ভাটা মালিক সাময়িক বন্ধ ও দিনে চালু রেখে রাতে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চরম আতঙ্ক ছড়ালেও চাঁদাবাজচক্রের তেমন কাউকে পুলিশ ধরতে পারেনি।

আলমডাঙ্গার কুমারীর ভাটাশ্রমিক সুজন খুন হন গত বুধবার রাতে। এর আগে দামুড়হুদার কার্পাসডাঙ্গা ও কানাইডাঙ্গা ইটভাটায় সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে এক শ্রমিককে জবাই করতে যায়। বোমার আঘাতে একজন আহত হয়। এ ছাড়া চুয়াডাঙ্গার  ভুলটিয়ার একতা ব্রিকসের মালিকের ছেলে সোহেল রানাকে (২৪) অপহরণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তাকে ২০ দিনেও উদ্ধার করা যায়নি। তার ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কী ঘটেছে তাও নিশ্চিত হতে পারছেন না পরিবারের সদস্যরা। একের পর এক ইটভাটায় হামলা জেলাবাসীকে তটস্থ করে তুলেছে।

দামুড়হুদা উপজেলার কার্পাসডাঙ্গার এমআর ব্রিকস ও কানাইডাঙ্গার বোস ব্রিকস নামের দুটি ইটভাটায় দাবি করা চাঁদার টাকা না পেয়ে গত রোববার রাতে বোমা হামলা চালায় দুবৃর্ত্তরা। এতে এমআর ব্রিকসের শ্রমিক খোদা বকস এবং বোস ব্রিকসের শ্রমিক কালু মিয়া, আবদুর রাজ্জাক, হাবিবুর রহমান, আকবর আলী, হাসান আলী, আবু বকর সিদ্দিক ও রুবেল হোসেন আহত হন। তাদেরকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল ও দামুড়হুদা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিত্সা দেয়া হয়। এমআর ব্রিকসের মালিক মতিয়ার রহমানের কাছে এক লাখ এবং বোস ব্রিকসের মালিক বিশ্বনাথ বোসের কাছে ২ লাখ টাকা চাঁদা না পেয়ে ওই বোমা হামলা চালানো হয় বলে সংশ্লিষ্ট মালিকেরা জানান। পরদিন সোমবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে সদর উপজেলার ঝোড়াঘাটায় অবস্থিত এসবিএম ব্রিকস নামে ইটভাটায় দুবৃর্ত্তরা শ্রমিকদের জিম্মি করে চাঁদা দাবি করে।

আলমডাঙ্গা কুমারীর ইটভাটায় কুষ্টিয়া মিরপুর এলাকার একটি গ্যাং হানা দিয়ে খুন করেছে বলে পুলিশ প্রাথমিকভাবে তথ্য পেলেও চুয়াডাঙ্গা, দামুড়হুদা এলাকায় রয়েছে একাধিক গ্যাং। এরা প্রায় রাতেই কোনো না কোনো এলাকায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। আতঙ্ক সৃষ্টির আড়ালে চাঁদা আদায়। একাধিকসূত্র বলেছে, অপহরণ ও চাঁদাবাজ চক্রের প্রধান আলমডাঙ্গা খাসকররা গ্রামের বিশ্বজিৎ মাঝে কিছুদিন বাংলাদেশ-ভারত যাওয়া আসা করলেও সম্প্রতি সে এলাকায় ফিরেছে। সাথে নিয়েছে হাকিমপুর, তিয়রবিলা, চরপাড়া, হরিণাকুণ্ডুর ফতেপুর, রিশখালী, পান্তাপাড়া ও দর্শনার বেশ কয়েকজনকে। দর্শনার আলীম পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেলে তিয়রবিলা গ্রামের মজনু নতুন গ্যং গ্রুপ গঠন করে বলে পুলিশ তথ্য পেয়েছে। এ গ্যাঙের মূল কাজ এখন আতঙ্ক সৃষ্টি করে অপহরণ ও চাঁদাবাজি করা। মজনুর গ্যং গ্রুপ দামুড়হুদা, দর্শনা, উথলী, জীবননগর এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে। পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়া আলীমের ভাই হালিম, চাঁদপুরের ফয়সাল, উথলীর ঝন্টুসহ বেশ কয়েকজনকে পুলিশ গ্রেফতারের জন্য ফাঁদ পাতলেও দীর্ঘদিন ধরেই এরা রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
আলমডাঙ্গা কুমারীর ইটভাটা শ্রমিককে গুলি করে খুন হওয়ার ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে উপজেলার ১৫/১৬টি ইটভাটার শ্রমিকরা। ইতোমধ্যে আতঙ্কে কয়েকটি ইটভাটা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। ভরা মরসুমে এভাবে ইটভাটা বন্ধ হলে ইট ব্যবসায় ধস নামার আশঙ্কা করছেন ভাটা মালিকরা। ভালাইপুর এলাকার ইটভাটাগুলোর মালিকেরা ভাটা রাতে বন্ধ রেখে দিনে চালু রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দাবিকৃত চাঁদার টাকা না পেয়ে আলমডাঙ্গার কুমারী গ্রামের এনআরবি ইটভাটার শ্রমিককে গুলি করে নৃশংস খুন, অপর এক শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হওয়াসহ ৫/৬ জন দরিদ্র শ্রমিককে পিটিয়ে জখম করার ঘটনায় উপজেলার সমস্ত ইটভাটার শ্রমিকদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়েছে।

এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর থেকে বেশ কয়েকটি ইটভাটার শ্রমিকরা কাজ গতকাল বন্ধ করে দিয়েছে। তারমধ্যে কুমারীর এনআরবি, বণ্ডবিলের ঠাণ্ডু মিয়ার ইটভাটা, এএমবি ভালাইপুর এলাকার এসবিএম, এনএসবিএম, ডন, কেডিবিসহ বেশ কয়েকটি ইটভাটা ইতোমধ্যে সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বাকি ইটভাটাগুলোর মালিক ও শ্রমিকেরা আতঙ্কের মধ্যদিয়ে কোনো রকমভাবে চালু রেখেছেন। চালু কয়েকজন ইটভাটা মালিকের সাথে কথা হলে তারা জানান, সাহসী কয়েকজন শ্রমিক দিয়ে কোনোভাবে ভাটা চালু রেখেছি। কদিন পারবো তা জানি না। শ্রমিকরা কাজ করতে না চাইলে তো জোর করে কাজ করানো যায় না। প্রস্রাব করার কথা বলেও অনেকে পালাচ্ছে। ইটভাটা মালিক বাবু মুন্সী বলেছেন, কয়েকজন শ্রমিক রাতে কাজ করে, তাদেরকে আমরা নিজেরা ৬ জন মিলে রাতে পাহারা দিয়ে রাখছি। ব্যবসার এখনই মরসুম। এখন ভাটা বন্ধ রাখতে হলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। ধার-দেনায় বিপদে পড়তে হবে।

এদিকে, জঘন্য ওই হত্যাকাণ্ডের পর এখনও পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। এ বিষয়ে তদন্তের অগ্রগতি প্রসঙ্গে আলমডাঙ্গা থানার ইনচার্জ রফিকুল ইসলাম বলেছেন, পার্শ্ববর্তী মিরপুর উপজেলার একটি চরমপন্থি দল এ ঘটনা ঘটিয়েছে। এলাকার একটি গ্রুপও এর সাথে জড়িত থাকার  বিষয়ে পুলিশ মোটামুটি নিশ্চিত বলে পুলিশের ধারণা। পুলিশের অন্য আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, বেলগাছি গ্রামের জেলমুক্ত ২ চিহ্নিত সন্ত্রাসীর নেতৃত্বে এলাকার সন্ত্রাসীরাই এ জঘন্য ঘটনা ঘটিয়েছে।

চাঁদা না পেয়ে দুবৃর্ত্তরা ১০ জানুয়ারি রাতে সদর উপজেলার ভুলটিয়ার একতা ব্রিকসের মালিকের ছেলে সোহেল রানাকে (২৪) অপহরণ করে। এ ঘটনায় সোহেলের ফুফাতো ভাই মো. রুবেল বাদী হয়ে ১৩ জানুয়ারি সদর থানায় অপহরণ মামলা করেন। এজাহারে বলা হয়েছে, দশমাইল বাজার থেকে মুঠোফোনে কৌশলে ডেকে সোহেল রানাকে অপহরণ করা হয়েছে। অপহরণকারীরা ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছে। মুক্তিপণের টাকা না দিলে তাকে খুন করা হবে বলে হুমকি দেয়া হচ্ছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সদর থানার এসআই সেকেন্দার আলী জানান, সোহেল রানাকে উদ্ধারে অভিযান চলছে। এ পর্যন্ত সন্দেহভাজন ৪ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশি হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোতালেব বলেন, জেলার প্রায় সব ভাটাতেই চাঁদা দাবি করা হচ্ছে। চাঁদা না দিলে বোমা হামলা করা হচ্ছে। প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হচ্ছে। চাঁদা না দেয়ার কারণে অপহৃত ভাটার মালিকের ছেলেকে ২০ দিনেও উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। পুলিশ সুপার মো. রশীদুল হাসান জানান,  ইটভাটায় চাঁদাবাজি, বোমা হামলা, শ্রমিককে খুন ও ভাটার মালিককে অপহরণের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের ধরতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, গত বুধবার রাতে আলমডাঙ্গা শহরের নিকটবর্তী কুমারী গ্রামের গাং পাড়ায় অবস্থিত মুসা হকের এনআরবি ইটভাটায় আনুমানিক দেড়টার দিকে একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী  শ্রমিকদের ওপর চড়াও হয়। কয়েকজন শ্রমিকের সাথে আলাপ করে জানা গেছে- ইটভাটায় উপস্থিত হয়েই তারা গালাগালি শুরু করে। এই হারামির বাচ্চারা নিষেধ করা সত্ত্বেও কেন ভাটায় আগুন দিয়েছিস। এর পরপরই গণহারে ভাটার সকল শ্রমিককে বেদম পেটাতে শুরু করে। এ সময় তারা পাবনা জেলার ঈশ্বরদী থানার শাহাপুর গ্রামের মৃত মালেক মৃধার ছেলে ইটভাটার ফায়ারম্যান সুজন মৃধা (৩৫), তার চাচাতো ভাই একই গ্রামের মইজ উদ্দীনের ছেলে রবিউল ইসলাম (৩২), সুজনের এক চাচা একই গ্রামের মৃত রহমত আলির ছেলে আব্দুর রাজ্জাক (৪৫), শাহাপুরের মজের মণ্ডলের ছেলে রবি (৩৫), কুমারী গ্রামের সোহরব হোসেনের ছেলে গোলাপ আলি, দর্শনা পরানপুরের দলুর ছেলে ভাটার ট্রাক্টর ড্রাইভার আব্দুল লতিফ, মিরপুর উপজেলার পাগলা মালিহাদের সিদ্দিককে (৫৫) বেদম পিটিয়ে আহত করে। লাঠিপেটার এক পর্যায়ে কয়েকজন শ্রমিক বলে উঠেন-চাঁদা দেবে মালিক। আমরা গরিব মানুষ। কাজ না করলে খাবো কী? এ কথা শোনার সাথে সাথে এক সন্ত্রাসী প্রথমে ট্রাক্টর ড্রাইভার আব্দুল লতিফকে গুলি করে। মাথার একপাশে সে গুলি খেয়ে দৌড়ে পালিয়ে যেতে উদ্যত হলে আরেকটি গুলি করা হয়। সেটি তার হাতে লাগে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়। এরপরও তিনি পালিয়ে গ্রামের এক বাড়িতে আশ্রয় নেন। লতিফকে গুলি করার সময় পাশে হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন সুজন মৃধা। এরপর সুজন মৃধাকেও গুলি করা হয়। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু ঘটে।