উল্লাপাড়ায় ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ২ আহত ৩০ : তিনজন বরখাস্ত

স্টাফ রিপোর্টার: সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া স্টেশনে দু ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে দুজন নিহত ও ৩০ জন আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার রাত সাড়ে ৩টার দিকে একতা এক্সপ্রেস ও লালমনি এক্সপ্রেসের মধ্যে এ সংঘর্ষ হয়। এতে একতা এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন লালমনি এক্সপ্রেসের বগির উপর উঠে যায়। এ সময় উভয় ট্রেনের অধিকাংশ যাত্রী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন। দুর্ঘটনার পর থেকে উত্তর বঙ্গের সাথে ঢাকার রেল যোগাযোগ বন্ধ ছিলো। দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে তিনজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ঘটনার তদন্তে গঠন করা হয়েছে আলাদা ৪টি কমিটি। ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা লালমনিরহাটগামী আন্তঃনগর লালমনি এক্সপ্রেস গতকাল রোববার ভোর রাতে নির্ধারিত যাত্রাবিরতিতে উল্লাপাড়া রেলওয়ে স্টেশনের ১নং লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলো। এ সময় দিনাজপুর থেকে ঢাকাগামী আন্তঃনগর একতা এক্সপ্রেস ২ নম্বর লাইন দিয়ে স্টেশন অতিক্রমের কথা থাকলেও ভুল সিগন্যালের কারণে ১ নম্বর লাইনেই ঢুকে পড়ে। উল্লাপাড়ায় একতা এক্সপ্রেসের স্টপেজ না থাকায় এর গতিবেগ ছিলো অপেক্ষাকৃত বেশি। আকস্মিকভাবে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লালমনি এক্সপ্রেস চোখে পড়ার সাথে সাথে একতার চালক ইমার্জেন্সি ব্রেক কষেও গাড়ি থামাতে ব্যর্থ হন। পরিণতিতে একতা এক্সপ্রেস ১ নম্বর লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা লালমনি এক্সপ্রেসের উপর দৃশ্যত ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে সংঘর্ষ হয় মুখোমুখি। এ সময় একতা ও লালমনি এক্সপ্রেসের যাত্রীরা ছিলেন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। উল্লাপাড়ায় যাত্রাবিরতির ফলে লালমনি এক্সপ্রেসের বেশ কিছু যাত্রী প্ল্যাটফর্মে নেমে হাঁটাহাঁটি করছিলেন। কেউ ব্যস্ত ছিলেন চা পানে। এদেরই একজন কামাল হোসেন। তার গন্তব্য রংপুর। তিনি বলেন, কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি লালমনি এক্সপ্রেসের ওপর অপর একটি ট্রেন উঠছে। সাথে বিকট শব্দ। ঘুমন্ত যাত্রীদের আর্তনাদ। কয়েক মুহূর্ত পর তিনি বুঝতে পারেন দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে। এর একটি লালমনি এক্সপ্রেস অন্যটি একতা এক্সপ্রেস। দুটি যন্ত্রদানবের সংঘর্ষ এবং যাত্রীদের চিৎকারে প্ল্যাটফর্ম কেঁপে ওঠে। আশপাশের মানুষ শব্দ শুনে দৌঁড়ে এসে উদ্ধার অভিযানে নামেন। এ দুর্ঘটনায় একটি ট্রেনের ইঞ্জিনসহ চারটি বগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একটি ট্রেনের ইঞ্জিন এবং চারটি বগি লাইনের বাইরে চলে এসেছে।

দুর্ঘটনার খবর পেয়ে দমকল বাহিনীর উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ ও বগুড়া থেকে আসা ৪টি ইউনিটের কর্মীরাও একই সাথে উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নেন। দুর্ঘটনায় নিহতরা হলেন লালমনিরহাটের আদিতমারী রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন মাস্টার মজিবুর রহমান (৫৫) ও নাটোরের আলতাফ হোসেন (৩৬)। আহতদের মধ্যে লালমনি এক্সপ্রেসের পরিচালক (গার্ড) স্বপন কুমার, দিনাজপুরের চিরিরবন্দরের বন্দর উপজেলার জহুরুল ইসলাম, লালমনিরহাটের মঞ্জুরুল ইসলাম, সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার সাতলাঠি গ্রামের মেহদি হাসান ও লালমনিরহাটের নিহত মজিবর রহমানের ছেলে সিয়ামের অবস্থা আশঙ্কাজনক। দমকল বাহিনীর সদস্য আহতদের উদ্ধার করে বগুড়া, সিরাজগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল, উল্লাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ২০ শয্যা বিশিষ্ট উল্লাপাড়া হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ও ক্লিনিকে পাঠিয়ে দেন। উল্লাপাড়ায় সংঘটিত ট্রেন দুর্ঘটনার পর আলাদা ৪টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। রেল বিভাগের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আমজাদ হোসেনকে প্রধান করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটিকে আগামী চার কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের জেনারেল ম্যানেজার মো. আবদুল আউয়াল ভুঁইয়া জানান, দুর্ঘটনা তদন্তের জন্য রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের চিফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট মিয়া জাহানকে প্রধান করে চার সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে রিপোর্ট দিতে বলা হয়। পশ্চিমাঞ্চল রেল বিভাগের ডিভিশনাল ট্রাফিক অথরিটি মো. শফিকুর রহমানকে প্রধান করে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট আরেকটি তদন্ত কমিটি করা হয়। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এ কমিটিকে রিপোর্ট দিতে হবে। এছাড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক কেএম আলী আজমকে প্রধান করে গঠিত কমিটি জেলা প্রশাসনের কাছে রিপোর্ট জমা দেবে। এদিকে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে উল্লাপাড়া রেলওয়ে স্টেশনের সহকারী স্টেশন মাস্টার নুর কুতুব উদ্দিন, একতা এক্সপ্রেস ট্রেনের চালক (লোকো মাস্টার) বঙ্কিম চন্দ্র এবং ট্রেনের সহকারী চালক আবদুস সাফীকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।

রেল মন্ত্রণালয়ের সচিব আবুল কালাম আজাদ, পশ্চিমাঞ্চল রেলের জেনারেল ম্যানেজার মো. আবদুল আউয়াল ভুঁইয়াসহ রেলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক বিল্লাল হোসেন, পুলিশ সুপার এসএম এমরান হোসেনসহ স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও উদ্ধার কাজ তদারক করেছেন। এরই মধ্যে ঈশ্বরদী থেকে রিলিফ ট্রেন দুর্ঘটনাস্থলে এসে উদ্ধার কাজ শুরু করেছে। দুপুরে দু নম্বর লাইনটি পরিষ্কার হলে নীলসাগর এক্সপ্রেস ঢাকার উদ্দেশে উল্লাপাড়া স্টেশন অতিক্রমের মধ্য দিয়ে ঢাকার সাথে এ অঞ্চলের রেল যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত হয়। এ বিষয়ে রেল মন্ত্রণালয়ের সচিব আবুল কালাম আজাদ ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, যে ভয়াবহ দুর্ঘটনা হয়েছে আল্লাহর অশেষ রহমতে মাত্র দুজন নিহত হয়েছেন। এ ধরনের ট্রেন দুর্ঘটনায় শত শত মানুষের মৃত্যু হয়। সৃষ্টিকর্তার রহমতে এখানে তেমন হয়নি। রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চল জোনের জেনারেল ম্যানেজার আবদুল আউয়াল ভুঁইয়া জানান, দুর্ঘটনার পরপরই প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। দ্রুত উদ্ধার কাজ সম্পন্ন করার পর ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হচ্ছে। দুর্ঘটনার জন্য যে বা যারা দায়ী বলে প্রমাণিত হবে তার বা তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।