ইসি গঠনে এখনই আইন করার পক্ষে আওয়ামী লীগ

 

স্টাফ রিপোর্টার: নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠন করতে এখনই একটি উপযুক্ত আইন প্রণয়ন বা অধ্যাদেশ জারি, রাষ্ট্রপতিকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে একক এখতিয়ার প্রদান, নির্বাচনে ই-ভোটিং চালুসহ চার দফা প্রস্তাব ও ১১ দফা সুপারিশ রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের কাছে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। গতকাল বুধবার বঙ্গভবনের দরবার হলে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের প্রতিনিধি দল রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশ নেয়। সেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির কাছে এসব প্রস্তাব দেন। বৈঠক চলে বিকেল ৪টা ৫ মিনিট থেকে বিকেল ৫টা ৩৫ মিনিট পর্যন্ত। সংলাপের পর রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন সাংবাদিকদের সামনে আলোচনার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। নতুন আইন প্রণয়ণ প্রসঙ্গে প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের লক্ষ্যে সম্ভব হলে এখনই একটি উপযুক্ত আইন প্রণয়ণ অথবা অধ্যাদেশ জারি করা যেতে পারে। সময় স্বল্পতার কারণে আগামী নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে তা সম্ভব না হলে পরবর্তী নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের সময় যাতে এর বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের নির্দেশনার আলোকে এখন থেকেই সে উদ্যোগ গ্রহণ করা যায়।’ সংবিধানের ১১৮ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন হবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে। এ বিষয়ে প্রণীত আইনের বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি তাদের নিয়োগ দেবেন। কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু ইসি গঠনের আইন এতোদিনেও না হওয়ায় গতবারের মত এবারও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নতুন কমিশন গঠনের এই উদ্যোগ নিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। এর আগে সংলাপে অংশ নেওয়া দলগুলোর মধ্যে সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি (জাপা)সহ কয়েকটি দল চলতি সংসদেই ইসি গঠনের বিল তোলার প্রস্তাব করেছে। অন্যদিকে বিএনপি ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ বর্তমান সংসদকে ‘জনপ্রতিনিধিত্বহীন’ আখ্যায়িত করে ওই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে।

প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি যা উপযুক্ত মনে করবেন, সেই প্রক্রিয়ায় তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দেবেন। রাষ্ট্রপতির উদ্যোগের প্রতি আওয়ামী লীগের সমর্থন থাকবে’। ‘সুষ্ঠু অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বর্তমানে বিরাজমান সকল বিধিবিধানের সঙ্গে জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার স্বার্থে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘ই-ভোটিং’ চালু করার প্রস্তাব দেয় আওয়ামী লীগ।

সব রাজনৈতিক দলের সহযোগিতায় শক্তিশালী ইসি গঠন সম্ভব:রাষ্ট্রপতি: এদিকে রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে পাঠানোর প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, রাষ্ট্রপতি আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দলকে বঙ্গভবনে স্বাগত জানিয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন সংক্রান্ত আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য তাদের ধন্যাবাদ জানান। রাষ্ট্রপতি বলেন, নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অবাধ নির্বাচনের জন্য সুষ্ঠু আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা খুবই জরুরি। সকল রাজনৈতিক দলের সহযোগিতায় একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন সম্ভব হবে বলে রাষ্ট্রপতি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে পাঠানোর প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরো জানানো হয়, নির্বাচন কমিশন গঠন সংক্রান্ত আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ জানানোয় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতিকে ধন্যবাদ জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিবেন। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি যেরূপ উপযুক্ত বিবেচনা করবেন সেই প্রক্রিয়ায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ প্রদান করবেন। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির উদ্যোগের প্রতি আওয়ামী লীগের সার্বিক সমর্থন থাকবে। তিনি নির্বাচনকে স্বচ্ছ করতে ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে ই-ভোটিং সিস্টেম চালুর প্রস্তাব করেন। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে স্থায়ী ভিত্তি প্রদানের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন গঠন সংক্রান্ত আইন প্রণয়ণেও তিনি দলের পক্ষ থেকে আগ্রহ ব্যক্ত করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভবিষ্যতে নির্বাচন নিয়ে কোন বিতর্ক হোক আওয়ামী লীগ তা চায় না। জনগণ যাকে চাইবে তারা নির্বাচিত হয়ে সরকার পরিচালনা করবে, সেটাই আওয়ামী লীগের প্রত্যাশা।

ফলপ্রসূ সংলাপ হয়েছে: ওবায়দুল কাদের: রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপ শেষে সন্ধ্যায় ধানমন্ডিস্থ আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে এখনই একটি আইন অথবা অধ্যাদেশ জারি ও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ই-ভোটিং প্রবর্তনসহ রাষ্ট্রপতিকে চার দফা প্রস্তাব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সংবিধান ও বিরাজমান সব আইনকানুনের ওপর শ্রদ্ধাশীল। রাষ্ট্রপতির সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সুগভীর প্রজ্ঞা ও সুবিবেচনার প্রতি আওয়ামী লীগের পরিপূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে রাষ্ট্রপতির গৃহীত যেকোনো ন্যায়সংগত উদ্যোগের প্রতি এই দলের পরিপূর্ণ সমর্থন থাকবে। এর আগে বৈঠক শেষে বঙ্গভবন থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় ওবায়দুল কাদের জানান, ‘রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে।’

রাষ্ট্রপতির কাছে আওয়ামী লীগের ১১ সুপারিশ: চারটি প্রস্তাবের পাশাপাশি ১১টি সুপারিশ রাষ্ট্রপতির কাছে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। সুপারিশগুলো হলো, একটি স্বাধীন ও কার্যকর নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনকালীন সময়ে নির্বাহী বিভাগের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/সংস্থার দায়িত্বশীলতা, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও এর মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা/কর্মচারীদের দায়িত্বশীলতা ও নিরপেক্ষ আচরণ, ছবিযুক্ত একটি নির্ভুল ভোটার তালিকা এবং ভোটগ্রহণের দিন নির্বাচন কেন্দ্রের সার্বিক নিরাপত্তা, নির্বাচন পরিচালনায় বেসরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা/কর্মচারীদের পরিবর্তে কেবলমাত্র প্রজাতন্ত্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা/কর্মচারীদের প্রিজাইডিং অফিসার থেকে পোলিং অফিসার পদে নিয়োগ করা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সদস্যদের নিরপেক্ষ ও দায়িত্বশীল আচরণ, দেশি/বিদেশি পর্যবেক্ষক থেকে শুরু করে মিডিয়া ও সিভিল সোসাইটির সদস্যদের নির্মোহ তত্পরতা, নির্বাচনে পেশিশক্তি ও অর্থের প্রয়োগ বন্ধ এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ সকল পর্যায়ের ভোটারের অবাধ ভোটদানের সুযোগ নিশ্চিত করা, নির্বাচনের পূর্বে ও পরে এবং নির্বাচনের দিন ভোটারসহ সর্ব সাধারণের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নির্বাচনকালীন সময়ে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীসহ নির্বাচন পরিচালনার জন্য আবশ্যকীয় সকল সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে ন্যস্ত করা, নির্বাচনকালীন সরকারের কর্মপরিধি কেবলমাত্র আবশ্যকীয় দৈনন্দিন (রুটিন) কার্যাবলীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা। সাংবাদিক সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের এ তথ্য জানান। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ইস্যুতে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঐকমত্য হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দলের যেসব নেতা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে নেন তারা হলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আবুল মাল আব্দুল মুহিত, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, এইচ টি ইমাম, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম, বেগম মতিয়া চৌধুরী, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, সাহারা খাতুন, উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য অ্যাম্বাসেডর মো. জমির, অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গির কবির নানক, ডা. দীপু মনি, আইন বিষয়ক সম্পাদক আব্দুল মতিন খসরু, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, দপ্তর সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ।

সংসদের বাইরে থাকা বিএনপির সঙ্গে আলোচনা মধ্য দিয়ে গত ১৮ ডিসেম্বর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। ইসির নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে চার দফায় মোট ২৩টি দলের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির আলোচনা শেষ হয়েছে। পঞ্চম দফায় আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দলকে রাষ্ট্রপতি সংলাপের আমন্ত্রণ জানাবেন বলে বঙ্গভবন থেকে জানানো হয়েছে।