মাথাভাঙ্গা মনিটর: বাগদাদে মালিকি সরকারের প্রধান কার্যালয় থেকে শতকিলোমিটার দূরে নাজাফ শহরের একটি ভবন পতনের মুখে পড়া ইরাকের ভাগ্যনির্ধারণে কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দেশটির রাজনৈতিক সংস্কার ও সাম্প্রতিক সুন্নি বিদ্রোহ মোকাবেলায় নাজাফেরনির্দেশনা মানছে ইরাকিরা। অন্যদিকে দু মেয়াদের শাসক নুরি আল মালিকিরপ্রধানমন্ত্রীত্বের প্রতি দেখা দিয়েছে চরম আস্থাহীনতা। শহরেরঐতিহ্যবাহী ও ধর্মীয় স্মৃতি বিজড়িত একটি স্থাপত্যে সোনালি গম্বুজের ছায়ায়অবস্থানকারী প্রবীণ গ্রান্ড মুফতি আয়াতুল্লাহ আলি আল-সিস্তানি গত তিনসপ্তাহ ধরে জুমার নামাযের ভাষণে রাজনৈতিক দিক নির্দেশনাও দিয়ে যাচ্ছেন, যাইতঃপূর্বে তাকে করতে দেখা যায়নি। ইরাকে ইঙ্গ-মার্কিন হামলার সময়েও অনেকটানিশ্চুপ ছিলেন সিস্তানি।তবে ইরাকের মসুল প্রদেশসহ উত্তরাঞ্চলেরবৃহৎ অংশ এখন আল কায়েদা সংশ্লিষ্ট জঙ্গিগোষ্ঠী ‘দ্য ইসলামিক স্টেট ইন ইরাকঅ্যান্ড লেভান্ট’ বা আইএসআইএল-এর দখলে। দেশটির অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিতেলক্ষেত্রগুলোও এখন সুন্নি বিদ্রোহীদের দখলে। বিদ্রোহীরা ইরাক ও সিরিয়ারদখলকৃত অঞ্চল নিয়ে নতুন ইসলামিক খেলাফত গঠনের স্বপ্ন দেখছে। তাদের আশা আলোরমুখ দেখলে ইরাকের ভাঙন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।ইরাকেরপ্রধানমন্ত্রী নুরি আল-মালিকির বিরুদ্ধে দেশের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িকবিভাজন সৃষ্টির বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। শিয়া মতাবলম্বী হলেও দেশটির শিয়াজনগোষ্ঠীর একটি অংশও তার বিরুদ্ধে অপশাসনের অভিযোগ আনছে। মালিকির পশ্চিমাবন্ধুরাও তার পরিবর্তে ইরাকে নতুন নেতৃত্ব দেখতে চায়।গত ১০ জুনমসুল শহর থেকে ইরাকি সেনাদের তাড়িয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে সুন্নি জঙ্গিদেরদখলাভিযান শুরু হয়। সাবেক এক নায়ক সাদ্দাম হোসেনের অনুগত সেনা কর্মকর্তাদেরসহায়তায় জঙ্গিদের অগ্রযাত্রা এখন বাগদাদের কাছাকাছি।
মসুলের পতনের তিন দিনের মাথায় গত ১৩ জুন জুমার নামাজের ভাষণে বিদ্রোহীদেরবিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার আহ্বান জানান সিস্তানি। পাশাপাশি জনরোষের মুখে থাকামালিকি প্রশাসনের অবসান ঘটিয়ে নতুন নেতৃত্ব বেছে নিতে জনপ্রতিনিধিদেরনির্দেশ দেন তিনি।সিস্তানি ইরাকের এমন একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, যারনির্দেশের বাস্তবায়নে অনুসারিদের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে হিসেবে শিয়াপ্রধানমন্ত্রী মালিকির রাজনৈতিক ভবিষ্যত এখন স্বল্পায়ুতে পরিণত হয়েছে বলেইধরে নিচ্ছেন বিশ্লেষকরা।দু মাস আগেই ইরাকে জাতীয় নির্বাচনঅনুষ্ঠিত হয়েছে যাতে শিয়া নেতারাই অধিকাংশ স্থান থেকে নির্বাচিত হয়েছেন।নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী চলতি সপ্তাহেই নতুন সরকার গঠনের সাংবিধানিকবাধ্যবাধকতা রয়েছে।নতুন সরকারে মালিকিকে বাদ রাখার নির্দেশ দেয়ারকারণেই মূলত আলোচনায় উঠে আসেন সিস্তানি। শিয়া রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রধানধর্মীয় নেতার রাজনীতির বিষয়ে মত প্রকাশের নজির খুবই কম।
গত তিনসপ্তাহ ধরে জুমার নামাযের বক্তব্যে ইরাকের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে একইনির্দেশনাগুলো স্পষ্ট করে যাচ্ছেন ৮৩ বছর বয়সী সিস্তানি; ইরাকে এবংপাশ্ববর্তী দেশগুলোতে যার রয়েছে অগনিত অনুসারী। সিস্তানির বক্তব্যআন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে ব্যাপক গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হয়েছে।গতএক শতকের মধ্যে ইরাকের রাজনীতি নিয়ে দেশটির শিয়া ইমামতন্ত্রের ফতোয়া এটাইপ্রথম। সিস্তানিপন্থি ইমামদের দাবি, ইরাক নামক দেশটির পতন ঠেকানোর জন্যতাদের নেতা এ ধরনের ফতোয়া দিয়েছেন।সিস্তানির নির্দেশ পেয়ে অনেকইরাকিকে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে দেখা গেছে। সুন্নি জঙ্গিদের প্রতিহত করতেবাগদাদের রাজপথে সশস্ত্র মহড়া দিয়েছেন সাধারণ ইরাকিরা। এছাড়া মালিকিকে বাদদিয়ে সব পক্ষের অংশগ্রহণে একটি নতুন সরকার গঠনের বিষয়টিও আলোচিত হচ্ছেজনপ্রতিনিধিদের বৈঠকে।গত শুক্রবারের বক্তব্যেও জুলাইয়ের শুরু থেকেনতুন একজন প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট ও স্পিকার ঠিক করতে রাজনীতিবিদদেরআহ্বান জানিয়েছেন সিস্তানি।তার ওই প্রভাবশালী ফতোয়া ইরাকের স্থিতিশীলতায় স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী ফল বয়ে আনবে বিশ্লেষকদের ধারণা।
জনগণকেঅস্ত্র তুলে নেয়ার আহ্বান সহিংসতাকে আরো ঘনীভূত করবে অভিযোগ করেন অনেকসুন্নি নেতা। দেশটির ঐতিহাসিকভাবে জিইয়ে থাকা শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বের ক্ষতওআবার ছড়িয়ে পড়তে পারে। কারণ এতোদিনে সাধারণত শিয়াদের ধর্মীয় নেতারারাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করতো না।ইমামতন্ত্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখেন এমন একজন শিয়া এমপি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সিস্তানিই এখন চালকের আসনে।
পুরোনো স্মৃতি:শিয়ামতবাদের অনুসারীদেরকে একজন ধর্মীয় ইমামের অনুসারি হতে হয়। আরবিতে এ ধরনেরপদ্ধতিকে বলা হয় মারজা। এই নিয়মেই শিয়াদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় পদ ‘আয়াতুল্লাহ’ নির্বাচন করা হয়ে থাকে।বর্তমানে মুসলিম বিশ্বে ইরাকের নাজাফ ও ইরানের কুম শহরে দুজন ‘আয়াতুল্লাহ’ ধর্মীয় অনুসানের দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন।নাজাফেরহাজার বছরের পুরোনো শিয়া ইমামতন্ত্রের প্রধান হিসেবে রয়েছেন সিস্তানি। সেহিসেবে ইরাকের সব শিয়াদের ধর্মীয় নেতা তিনি। ধর্মীয় বিষয় ছাড়াও অন্যান্যসমসাময়িক বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে থাকেন তিনি।মোহাম্মদ হোসেইন আলহাকিমের বাবা নাজাফের শীর্ষ চারজন ইমামের একজন। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়েআলোচনা করতে গিয়ে তিনি শতাব্দির পুরোনো শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বের কথা স্মরণকরেন। সুন্নি জঙ্গিদের উত্থানের কারণে নতুন করে সেই দ্বন্দ্ব ইরাকে মাথাছাড়া দিয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা তার।
দু শতাব্দি আগে ইরাকেরনাজাফের উত্তরে অবস্থিত কারবালায় সুন্নিরা শিয়াদের বিরুদ্ধে ব্যাপক সহিংসতাচালিয়েছিলো বলে জানান তিনি। নতুন করে শুরু হওয়া রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সেইদাঙ্গার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।এখনতাদের (সুন্নিদের) সক্ষমতা আগের চেয়ে অনেক বেশি। বিধ্বংসী বাহিনী আগের চেয়েসক্রিয়। তাদের ধ্বংসাত্ত্বক পরিকল্পনাও অনেক জোরালো, বলেন হাকিম।রয়টার্সের সঙ্গে আলাপকালে সপ্তম শতাব্দিতে শিয়াদের ইমাম আলী হোসাইনের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটিও উল্লেখ করেন তিনি।প্রতিপক্ষের প্রতারণার শিকার হয়ে ইরাকের কারবালায় সপরিবারে হত্যার শিকার হয়েছিলেন ইসলামের আলোচিত ব্যক্তিত্ব ইমাম হোসেন।সাবেকপ্রেসিডেন্ট সাদ্দামের শাসনামলে নাজাফ ও কারবালায় শিয়াদের তীর্থযাত্রানিষিদ্ধ ছিলো। তবে সাদ্দামের পতনের পরই শিয়ারা ইরাকের ক্ষমতায় আসে। শিয়াদেরনাজাফ কেন্দ্রীয় তৎপরতা জোরদার হয়।
চাপে আছেন মালিকি: রাজনীতিতেআয়াতুল্লাহ আলি আল সিস্তানির হস্তক্ষেপের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে ইরাকেনতুন করে সবার অংশগ্রহণমূলক একটি সরকার গঠনের উদ্যোগ। ২০১০ সালেরনির্বাচনের পর এমন একটি উদ্যোগের কথা উঠলেও পরে তা বাস্তবায়ন হয়। নতুনসরকার থেকে দুই মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী মালিকিকে সরানোর প্রস্তাবও রয়েছেতার।মালিকিকে সরানোর ইঙ্গিত দিয়ে শুক্রবার সিস্তানির দেয়াবক্তব্যের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশি শক্তিগুলোর ইচ্ছার মিল রয়েছে। ২০০৪সালে যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইরাকের পুনর্গঠনেরও উদ্যোগ নিয়েছিলেন সিস্তানি। এর পরতাকে আর রাজনৈতিক বিষয়ে তেমন বক্তব্য দিতে দেখা যায়নি।দেশের মধ্যেসাম্প্রদায়িক বিভক্তি সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে মালিকির বিরুদ্ধে। সুন্নিদেরকোণঠাসা করার কারণেই তারা আল কায়েদা সংশ্লিষ্ট জঙ্গিদেরকে মালিকি বিরোধীযুদ্ধে সহায়তা করছেন বলেও শোনা যাচ্ছে।এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহপশ্চিমা মহল মালিকিকে প্রধানমন্ত্রীত্ব থেকে সরাতে চাইছে। সিস্তানির ফতোয়াপশ্চিমা বিশ্বের সেই ইচ্ছায় সহায়কই হবে।
মার্কিন আগ্রাসনকালে নিশ্চুপ সিস্তানি: ইরাকের সুন্নি ইমামদের অভিযোগ, বর্তমান পরিস্থিতিতে শিয়া ইমাম সিস্তানির তৎপরতা গোষ্ঠীগত সংঘাত আরো ঘনীভুত করবে।আহমেদ আল কুবাইসি মধ্যপ্রচ্যের আল আরাবিয়া টিভিকে বলেন, সিস্তানি তারঅনুসারীদেরকে উর্দি পরার নির্দেশ দিচ্ছেন এবং সুন্নিদের বিরুদ্ধে লড়াই করতেবলছেন।সিস্তানির সাম্প্রতিক ফতোয়ার সমালোচনা করেন ইরাকের আরেকসুন্নি ধর্মীয় নেতা রিফা আল রিফায়ি। ইরাকে ইঙ্গো-মার্কিন হামলার সময় তাররহস্যময় নীরবতারও সমালোচনা করেন তিনি।আজকের ‘সিংহ’ সিস্তানি ইরাকেমার্কিন আগ্রাসনের সময় কোথায় ছিলেন?তারা আমাদের উপর অবিচার করেছে।অব্যাহত আক্রমণের শিকার হয়েছি আমরা। আমাদের রক্তে ইরাকের মাটি রঞ্জিতহয়েছে। নারীরা ধর্ষিত হয়েছেন,বলেন রিফা।তবে সিস্তানির সমর্থকদেরদাবি, তাদের ইমাম আইএসআইএল জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ইরাকের সব জনগণকে অস্ত্র হাতেনিতে বলেছেন। তিনি নির্দিষ্ট করে শিয়াদেরকে ইঙ্গিত করেননি।
সিস্তানিরঅনুসারী হাকিম আরো বলেন, তাদের ইমাম রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সঙ্গে অংশনিয়ে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন। সেনাবাহিনীকে এড়িয়েগৃহযুদ্ধে নামতে নির্দেশ দেননি তিনি।তা সত্ত্বেও সিস্তানির ওই ফতোয়া শিয়াদের জঙ্গিবাদের ধর্মীয় বৈধতা দিচ্ছে বলেও দাবি করেন অনেক বিশ্লেষক।