ইবোলা প্রতিরোধে বিমান স্থল ও নৌবন্দরে সর্বোচ্চ সতর্কতা

 

স্টাফ রিপোর্টার: প্রাণঘাতী ইবোলা প্রতিরোধে সর্বোচ্চ সতর্কতায় রয়েছে শাহজালালসহ দেশের সব প্রবেশদ্বার। বিমান, স্থল ও নৌবন্দরগুলোতে সার্বক্ষণিক ডাক্তার ও নার্স তৎপর। আফ্রিকান নাগরিক দেখা মাত্রই তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা হচ্ছে। শুধু ইবোলা আক্রান্ত ছয়টি দেশই নয়, গোটা আফ্রিকা থেকে আগত সব যাত্রীকে শাহজালাল বিমানবন্দরে চেক করা হচ্ছে। এমনকি বাদ যায়নি জিম্বাবুইয়ের ক্রিকেটাররাও। গতকাল শুক্রবার এই টিম ঢাকায় এলে তাদের বাংলাদেশের নার্স ও ডাক্তারদের জেরায় পড়তে হয়। গত বৃহস্পতিবার রাতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্বাস্থ্য, স্বরাষ্ট্র ও বিমান মন্ত্রণালয়ের জরুরি বৈঠকের পর পরই মূলত চোখে পড়ার মতো তৎপরতা দেখা যায়।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে শাহজালালে গিয়ে দেখা যায়, ডাক্তার-নার্স সবাই সর্বোচ্চ সতর্কতায়। যদিও এদিন ইবোলা আক্রান্ত তিনটি দেশ লাইবেরিয়া, গিনি ও সিয়েরালিওন থেকে কোনো নাগরিক আসেননি। তবুও গোটা আফ্রিকা থেকে আগত সব নাগরিককেই বিমানবন্দরে চেক করা হচ্ছে।

বিমানবন্দরে ইবোলা ডেস্কের ডা. লীনা জানান, জিম্বাবুইয়ের ক্রিকেট দলটি ঢাকায় এসেছে জাম্বিয়া ও দুবাই হয়ে। যদিও এসব এখনও ইবোলা আক্রান্ত হয়নি, তবুও আফ্রিকান দেশের নাগরিক হওয়ার কারণেই তাদের বিশেষ স্ক্রিনিং করা হয়। তবে কারোর শরীরেই কোন তাপমাত্রা মেলেনি।

ভিআইপি লাউঞ্জে বসার পর ক্রিকেট দলের সব সদস্যকেই এক এক করে পরীক্ষা করা হয়। টেম্পারেচার ডিটেক্টর হ্যান্ডসেট দিয়েই তাদের শরীরের তাপমাত্রা মাপা হয়। ডা. লীনা বলেন, এই কিট দিয়ে পরীক্ষা করার সময় ওদের শরীরে স্পর্শ করা লাগে না। শরীর থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরে কিট ধরা হলেই তাতে সিগন্যাল আসে। জিম্বাবুইয়ে দলের টেলর সবার স্বাস্থ্য পরীক্ষায় আমাদের আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেন। তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এ সময় এগিয়ে আসেন। কারোর শরীরেই মেলেনি অস্বাভাবিক তাপমাত্রা। গড়পড়তায় সবারই তাপমাত্রা ছিলো ৯৭ দশমিক ২১-এর মতো।

এদিকে ইমিগ্রেশন সূত্র জানায়, শুক্রবার শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে জিম্বাবুইয়ে দল ছাড়া আর কোনো আফ্রিকান নাগরিক ঢাকায় আসেননি। ইমিগ্রেশন এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতায় রয়েছে। এমনকি অন্য কোনো দেশের নাগরিক ইবোলা দেশ কিংবা আফ্রিকান কোন দেশ হয়ে আসছে কি-না সেটা বেশ খুঁটিয়ে দেখা হচ্ছে। শাহজালাল ছাড়াও দেশের অন্য দুটো ওসমানী ও শাহ আমানত বিমানবন্দরেও নেয়া হয়েছে একই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা।

এছাড়া দেশের স্থল ও নৌবন্দরগুলোতেও ইবোলা টিম কাজ করছে। ওই সব দেশের সব যাত্রীরই প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা হচ্ছে। বেনাপোল, হিলি, মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা যায়, গতকাল শুক্রবার এসব বন্দরে ইবোলা প্রতিরোধ টিমের সদস্যদের বেশ তৎপর থাকতে দেখা যায়।

এদিকে বৃহস্পতিবার রাতে শাহজালালে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম সাংবাদিকদের জানান, ঢাকায় এখন পর্যন্ত কোনো ইবোলা যাত্রীর সন্ধান মেলেনি।

ইবোলার সূত্রপাত সেই ১৯৭৬ সালে, কঙ্গো ও সুদানে। তারপর আজ অবধি বাংলাদেশে কেউ আক্রান্ত হয়নি। মাস ছয়েক আগে সেটিই আবার দেখা দেয় কঙ্গো, লাইবেরিয়া ও গিনিতে। তারপর বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ওই দেশগুলোতে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে। মূলত আফ্রিকান দেশগুলোতে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ার পর বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (হু) যেভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিশ্বব্যাপী সতর্কতা জারি করেছে, তাতে বাংলাদেশও উদ্বিগ্ন। হু’র নির্দেশনায় বাংলাদেশও তৎপর হয়। মাস তিনেক আগে এ নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটিও গঠন করা হয়।

হু’র ভাষ্যমতে, যেহেতু এ রোগের কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই, প্রতিষেধক নেই, তাই আফ্রিকার চার দেশে রোগটি ছড়িয়ে পড়তেই হু বিশ্বজুড়ে সতর্কতা জারি করেছে। এ ভাইরাসের হানায় ইতোমধ্যেই আফ্রিকার চার দেশে মারা গেছেন চার হাজারেরও বেশি মানুষ। কিন্তু হঠাৎ চলতি সপ্তায় যুক্তরাষ্ট্রে একজন নাগরিক ও নার্স ইবোলা আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পরই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে গোটা দুনিয়ায়। হঠাৎ তৎপর হয়ে ওঠে জাতিসংঘসহ পশ্চিমা দুনিয়া।

সূত্র মতে, লাইবেরিয়া থেকে ইবোলা আক্রান্ত টমাস এরিক ডানকান নামক এক নাগরিক টেক্সাসের একটি হাসপাতালে মারা যান। তার চিকিৎসায় ন্যস্ত এক নার্সও ইবোলায় মারা যান। আক্রান্ত হয় আরও এক নার্স। এতেই হইচই পড়ে যায় গোটা মার্কিন মুল্লুকে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে গোটা দুনিয়ায় থাকা মার্কিনী দূতাবাসগুলোতে। বাদ যায়নি ঢাকাও। আতঙ্কিত হয়ে গত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে শাহজালাল বিমানবন্দরে ছুটে যায় আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি আটলান্টা) দল। তারা বিমানবন্দরের ইবোলা কার্যক্রম আরও জোরদার করার পরামর্শ দেয়। তারপরই বৃহস্পতিবার রাতে শাহজালালে ডাকা হয় আন্তঃমন্ত্রণালয়ের জরুরি বৈঠক। এসব বিবেচনায় রেখেই বাংলাদেশের সব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, স্থলবন্দর ও সীমান্ত এলাকায় নেয়া হয়েছে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক পদক্ষেপ। জরুরীভিত্তিতে থার্মাল স্ক্যানার আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. দীন মোহাম্মদ নুরুল হক বলেন, দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছাড়াও আরও ২০টি সীমান্ত এলাকায় হেলথ ডেস্ক বসানো হয়েছে। সরকার এ বিষয়ে বেশ সতর্ক বলেই স্বাস্থ্য, ইমিগ্রেশন সিভিল এভিয়েশন ও সেনাবাহিনীর দায়িত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ১১ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করেছে। এ কমিটি সারাদেশের সব পয়েন্টের কর্মকাণ্ড মনিটর করছে।

তিনি জানান, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এ চারটে দেশ থেকে আসা যাত্রীদের প্রাথমিক পরীক্ষার ইমিগ্রেশন করানো হয়। বিমানবন্দরে সার্বক্ষণিক চালু রয়েছে হেলথ ডেস্ক। সেখানে রয়েছে স্ট্যান্ডবাই অ্যাম্বুলেন্স। এখন পর্যন্ত এ দেশে কোনো ইবোলার সন্ধান মেলেনি। তারপরও যদি বিমানবন্দরের কোনো যাত্রীকে দেখে সন্দেহ হয়, তাহলে তাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে পাঠিয়ে দেয়া হবে কুর্মিটোলায় জেনারেল হাসপাতালে। এখানে ২০ শয্যাবিশিষ্ট আলাদা ইউনিট চালু করা হয়েছে। সেখানে রেখেই তার শরীরে ভাইরাস আছে কি-না সেটা নিশ্চিত হওয়া যাবে। এছাড়াও প্রয়োজনে আইসিডিডিআরবির সহযোগিতায় রোগ নির্ণয় সংক্রান্ত পরীক্ষা করার সুযোগ আছে। এমনকি ইবোলা ভাইরাস সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র থেকেও প্রয়োজনীয় ল্যাবটেস্ট সহযোগিতা পাওয়া যাবে। কাজেই এ নিয়ে তেমন আতঙ্কের কিছু নেই। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বাত্মক প্রস্তুতি ও পদক্ষেপ রয়েছে।

ইমিগ্রেশন পুলিশের স্পেশাল সুপারিন্টেনডেন্ট নাফিউল হক বলেন, চারটি দেশ থেকে আগত সব যাত্রীকেই পরীক্ষা করা হচ্ছে। কাউকেই বিমানবন্দরের স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ছাড়পত্র ছাড়া ইমিগ্রেশন থেকে রিলিজ দেয়া হচ্ছে না।

এটা প্রাণঘাতী ভাইরাস। এর মূল বাহক এক প্রজাতির ফল-খেকো বাদুড়। তারা ভাইরাসটি বহন করে, তবে নিজেরা আক্রান্ত হয় না। পরে ওই বাদুড় থেকে বিভিন্ন প্রাণীর দেহে রোগ সংক্রমিত হয়। আর কোনোভাবে আক্রান্ত প্রাণীদের মাংস খেয়ে ফেললে বা সংস্পর্শে এলেই ইবোলা ভাইরাসটি চুপিসারে ঢুকে পড়ে মানবদেহে। তারপর সংক্রমিত মানুষের রক্ত বা দেহরস (যেমন হাঁচি, কাশি) থেকে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে অন্য মানুষের দেহে।

প্রথমেই আসে জ্বর। সঙ্গে চোখ-নাক-মুখ দিয়ে রক্তক্ষরণ, গায়ে ব্যথা, মাথার যন্ত্রণা, হয় পেট খারাপ, হতে পারে বমিও। তারপর ক্রমশ বিকল হতে শুরু করে লিভার, কিডনির মতো বিভিন্ন অঙ্গ। শেষে মৃত্যু ঘটে কোষের। হু’র রিপোর্ট অনুযায়ী, ইবোলায় আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুর আশঙ্কা ৯০ শতাংশ। এ সব লক্ষণ দেখা দিলে বিলকুল মৃত্যু, যদি সেটা চলে কয়েক সপ্তা ধরে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিকারের ব্যবস্থা যে হেতু নেই, তাই প্রতিরোধ ব্যবস্থাই জোরদার করা হোক। এড়িয়ে চলা হোক আক্রান্তের (মানুষ বা পশু-পাখি) সংস্পর্শ।

রোগ নিয়ন্ত্রণ সংক্রামক ব্যাধির পরিচালক ও ইবোলা জাতীয় কমিটি সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. বেনজীর আহমদ বলেন, ইবোলা মোকাবেলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। কোথাও কোনো ঘাটতি নেই। সবাই সতর্ক। শাহজালাল ছাড়াও দেশের সব বন্দরে নেয়া হয়েছে সর্বোচ্চ সতর্কতা। এমনকি সীমান্ত দিয়ে প্রতিবেশী ভারত থেকেও যাতে কোনো আফ্রিকান এ দেশে ইবোলা নিয়ে প্রবেশ করতে না পারে সে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসা বিজ্ঞানের দীর্ঘ ইতিহাসে ইবোলা ভাইরাসের এহেন সংক্রমণের নজির আর নেই। ভাইরাসটি প্রথম ধরা পড়েছিলো ১৯৭৬ সালে, কঙ্গো ও সুদানে। সেবার প্রায় সাতশ লোক মারা গিয়েছিলেন ইবোলার ছোবলে। কিন্তু এবারের ধাক্কায় মরে গেছেন চার হাজারেরও বেশি। এবার ইবোলা প্রথম ধরা পড়ে গত মার্চ মাসে গিনিতে। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে পড়শি দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে রোগ।