ইউরিয়া সারের মূল্য টনপ্রতি ৪ হাজার টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব

 

স্টাফ রিপোর্টার: উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে- এ অজুহাতে ইউরিয়া সারের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়। যদিও সরকার দীর্ঘদিন ধরেই ইউরিয়ায় ভর্তুকি দিয়ে আসছে। তারপরও সার উৎপাদন ও বিপণনে লোকসান বাড়ছে। এ অবস্থায় প্রতি টন ইউরিয়া বর্তমান সরকার নির্ধারিত ১৪ হাজার টাকার স্থলে ১৮ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করেছেন শিল্প সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। এতে টনপ্রতি দাম বাড়বে ৪ হাজার টাকা এবং ৫০ কেজির বস্তাপ্রতি দাম বাড়বে ২০০ টাকা। সোমবার শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব অর্থ এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। তবে শিল্প মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্ত বিবেচনা করা হলে কৃষকের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যাবে। এমন আশংকা প্রকাশ করে কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর বিরূপ প্রভাব পড়বে খাদ্য উৎপাদনে। যদিও সরকার কয়েক বছর ধরে প্রতি টন ইউরিয়া সারে ২ হাজার ৭৯৬ টাকা করে ভর্তুকি দিচ্ছে। কৃষি উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে এ ভর্তুকি বড় ভূমিকা রাখছে বলে কৃষি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। কৃষিকাজে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ইউরিয়া সার। সরকার নিজস্ব উৎপাদন এবং আমদানির মাধ্যমে এ সারের চাহিদা মিটিয়ে থাকে। বর্তমানে ইউরিয়া সারে সরকার নির্ধারিত বস্তাপ্রতি মূল্য ৭০০ টাকা। ডিলার কমিশনের পর তা কৃষক পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকায়।

জানতে চাইলে শিল্প সচিব (সিনিয়র) মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া সোমবার বলেন, গ্যাস সংকটে বছরের ৭ মাস সার কারখানগুলো বন্ধ থাকছে। পাশাপাশি বিসিআইসিতে অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল বাস্তবায়ন ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির কারণে সারের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। এতে আগের চেয়ে ক্রমান্বয়ে লোকসান বাড়ছে সার কারখানাগুলোর। যে কারণে ইউরিয়া সারের মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার সভাপতিত্বে গত মাসে শিল্প মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে ইউরিয়ার মূল্য টনপ্রতি ১৮ হাজার টাকা নির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয়। সরকার যদি কোনো কারণে মূল্য বাড়াতে অপারগ হয়, তাহলে বর্তমান ভর্তুকি ২ হাজার ৭৯৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪ হাজার টাকা করারও প্রস্তাব করা হয়।

সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) ক্রমান্বয় লোকসান ঠেকাতে সারের মূল্য বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে বলা হয়, বিসিআইসি কর্তৃক প্রতি টন ইউরিয়া সারের গড় মূল্য ১৬ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকা। কিন্তু সরকার নির্ধারিত মূল্য হচ্ছে ১৪ হাজার টাকা। ফলে এক টন সারে লোকসান হচ্ছে ২ হাজার ৭৯৬ টাকা। আরও বলা হয়, প্রত্যেক শিল্পকারখানা মুনাফা অর্জনের প্রত্যাশায় পরিচালনা হচ্ছে। কিন্তু বিসিআইসির সার কারখানাগুলো ক্রমাগত লোকসান গুনার কারণে আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। সুষ্ঠুভাবে কারখানাগুলো পরিচালনার স্বার্থে ইউরিয়া সারের দাম বাড়ানো আবশ্যক। প্রস্তাবে বলা হয়, বিসিআইসি’র ইউরিয়া সার কারখানাগুলো নিজস্ব উৎপাদিত বিদ্যুতের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন গ্যাসনির্ভর হওয়ায় এ খাতে ব্যয় বাড়ছে। সরকার ক্যাপটিভ পাওয়ার খাতে গ্যাসের মূল্য ৪ দশমিক ১৮ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৩৬ টাকা নির্ধারণ করেছে। এ দাম বাড়ানোর প্রভাব পড়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। এছাড়া নতুন শাহ জালাল সার কারখানায় উৎপাদিত সারের বেশিরভাগই দেশের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলে সরবরাহ হচ্ছে। এক্ষেত্রে সার লোড-আনলোড এবং পরিবহনে ২ হাজার টাকা বেশি ব্যয় হচ্ছে। যে কারণে সারের গড় উৎপাদন মূল্য বেড়েছে। কিন্তু বিক্রি করতে হচ্ছে সরকারের নির্ধারিত প্রতি টন ১৪ হাজার টাকা মূল্যে।

আগামীতে ইউরিয়া সারের উৎপাদন ব্যয় আরও বাড়বে- এ আশংকা প্রকাশ করে প্রস্তাবে ২০১৭-১৮ সাল পর্যন্ত ইউরিয়া সারের সম্ভাব্য ব্যয়ের একটি ধারণা সেখানে তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১০ লাখ ২৩ হাজার ৮০০ টন সার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এজন্য ব্যয় হবে ২ হাজার ৫০ কোটি টাকা। ওই হিসাবে প্রতি টন সারের উৎপাদন মূল্য হবে ২০ হাজার ৩০ টাকা। এর পরবর্তী অর্থবছর ২০১৭-১৮ সালে ১৪ লাখ ২৫ হাজার টন সার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এজন্য ব্যয় হবে ২ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা। ওই হিসাবে প্রতি টন সারের মূল্য দাঁড়াবে ১৫ হাজার ২৭০ টাকা এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৪ লাখ ২৫ হাজার টন সার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এজন্য ব্যয় হবে ১ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। ওই হিসাবে প্রতি টন সারের মূল্য ১৬ হাজার ১৫০ টাকায় উন্নীত হবে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সারের মূল্য না বাড়ানো হলে বিসিআইসির লোকসানের পরিমাণ আরও বাড়বে জানিয়ে বলা হয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে ২৪টি গুদাম রয়েছে। আমদানিকৃত ইউরিয়া সার এসব গুদামে রেখে বিতরণ করা হচ্ছে। এসব গুদামের রক্ষণাবেক্ষণে বিপুল অংকের অর্থ ব্যয় হচ্ছে। পাশাপাশি গ্যাস সংকটের কারণে সার উৎপাদন কমছে, আর উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। অপরদিকে উৎপাদন ব্যয় থেকে কম মূল্যে বিক্রি করার দরুন লোকসানের চাপে সার কারখানাগুলোর আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। অর্থের অভাবে কারখানাগুলো সংস্কার করা যাচ্ছে না। উল্লেখ্য, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে কৃষক পর্যায়ে ইউরিয়া সারের দাম ১২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও ২০১০-১১ অর্থবছরে তা ২০ টাকায় উন্নীত হয়। ২০১১ সালের ১ জুন ইউরিয়া সারের দাম বৃদ্ধি করে ২০ টাকা করা হয়েছিল। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পরিসংখ্যান মতে, ২০১৩ সালের ২৫ আগস্ট ইউরিয়া সারের দাম ২০ টাকা থেকে কমিয়ে ১৬ টাকা করা হয়েছে, যা বর্তমানে কার্যকর।