আলমডাঙ্গা কায়েতপাড়ার বাঁওড় সভাপতি জিয়া হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনে পুলিশ : তথ্য সংগ্রহে ৫ দিকে গুরুত্বারোপ

 

আলমডাঙ্গা ব্যুরো: আলমডাঙ্গার রামদিয়া-কায়েতপাড়া বাঁওড়ের সভাপতি জিয়াউর রহমান জিয়া হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনে পুলিশ ৫ দিকে গুরুত্বারোপ করে তথ্য সংগ্রহ করছে। খুব দ্রুত এ মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের রহস্যভেদ করতে পারবেন বলে আলমডাঙ্গা থানা পুলিশ দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেছে।

জানা গেছে, আলমডাঙ্গার রামদিয়া-কায়েতপাড়া বাঁওড়ের সভাপতি জিয়াউর রহমান জিয়া হত্যাকাণ্ডের ইতোমধ্যে ২ দিন পার হয়েছে। এখনও তার হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের রহস্য উন্মোচিত হয়নি। তবে এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বেশ কয়েকজনকে নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন বলে জানা গেছে।

আলমডাঙ্গা থানা অফিসার ইনচার্জ আকরাম হোসেন দৃঢ়তার সাথে বলেন, খুব দ্রুত এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচিত হবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুলিশ বেশ কয়েকটি বিষয়কে সন্দেহের তালিকায় রেখে তদন্ত অব্যাহত রেখেছে।

আধিপত্য বিস্তার: রামদিয়া-কায়েতপাড়া বাঁওড়ের আয়তন প্রায় ১২শ বিঘা। এতোবড় বাঁওড়ের আধিপত্য নিয়ে সব সময় কম-বেশি লড়াই ছিলো। গত টার্মে যারা লিজসূত্রে বাঁওড়ের মালিকানা ভোগ করেছিলেন তাদের সাথে নিহত জিয়ার সম্পর্ক কেমন ছিলো। সে পক্ষের সাথে জিয়ার সম্পর্কের উন্নতি-অবনতি খতিয়ে দেখছে পুলিশ।

এলাকাসূত্রে জানা যায়, আগের টার্মের বাঁওড় লিজগ্রহীতা পক্ষের নেতা ওল্টু ও সেলিম গং নিহত জিয়ার নিকট আবারও ৩ বছরের জন্য বাঁওড়ের অধিকার চেয়েছিলো। জিয়ার সমিতি তাতে রাজি না হওয়ায় তিয়রবিলার ওল্টু ৩-৪ জনকে সাথে নিয়ে জিয়ার সমিতিকে প্রথমে ৬ লাখ ও পরে ৩ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। এ নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিলো।

ইউপি নির্বাচন কেন্দ্রীক দ্বন্দ্ব: গত ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র দু গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। সে দ্বন্দ্বে নির্বাচন শেষ হতে না হতেই  তিয়রবিলা গ্রামের নজরুলকে গুলি করে ও জবাই করে হত্যা করা হয়। সে দ্বন্দ্ব মাথা চাড়া দিয়ে উঠা অস্বাভাবিক না। নির্বাচনীয় আধিপত্য বিস্তার এ হত্যার নেপথ্য কি-না তাও পুলিশ খতিয়ে দেখছে।

গ্রামের একাধিক সূত্র জানায়, নিহত জিয়া বর্তমান চেয়ারম্যান রুন্নুর ভোট করেছিলো। অন্যদিকে, পূর্বে যারা বাঁওড়ের মালিকানা ভোগ করতেন তারা লালের পক্ষের লোক। তাছাড়া চাঁদা দাবিকারী ওল্টুর বাড়ি লালের গ্রামে। সে ক্ষেত্রে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান লালও পুলিশের সন্দেহের তালিকার বাইরে না বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে। তবে এলাকার অনেকেই জানিয়েছেন, বর্তমানে লাল এলাকার কোনো ঝামেলায় থাকেন না। এমনকি গ্রামেও যান না।

কয়েকজন ভয়ঙ্কর নৈশ্যপ্রহরী: নিহত জিয়া নৈশ্যপ্রহরীদের সাথে বাঁওড়ের পানিতে নৌকায় রাত কাটাতো। প্রতি ভোরে তিনি মসজিদের নিকটে কুলে নৌকা ভিড়িয়ে ডাঙ্গায় নামতেন। মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে তারপর বাড়িতে ঢুকতেন। কিন্তু শুরু হত্যাকাণ্ডের ভোরে তিনি মসজিদের নিকট না নেমে কিছুটা দূরে আলপথে নামেন। কেন শুধু ওই ভোরেই এ ব্যত্যয় ঘটলো? কোন কোন নৈশ্যপ্রহরীর তাকে প্ররোচিত করে ওই আলপথে নামতে? বিষয়টি খতিয়ে দেখছে পুলিশ।

নিহত জিয়ার সমিতির ৬ জন নৈশ্যপ্রহরীর মধ্যে ৩-৪ জন ভয়ঙ্কর বলে এলাকাসূত্রে জানা যায়। এদের মধ্যে ৩ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলাসহ নানা ধরনের মামলা রয়েছে বলে জানা যায়। এদের মধ্যে কায়েতপাড়ার সলোক, আব্দার, ইউনুস উল্লেখযোগ্য। এলাকার অনেকেই বলেছেন এদেরকে গ্রেফতার করে ভালোভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই রহস্য উন্মোচিত হতে পারে। সন্দেহের তালিকায় থাকা নৈশ্যপ্রহরীদের মোবাইলফোনের গত কয়েকদিনের কললিস্ট মনিটরিং করা হলেই উন্মোচিত হতে পারে এ হত্যারহস্য বলে অনেকের ধারণা।

হত্যাকাণ্ডের পূর্বদিন দেয়া খুনের হুমকি: জিয়া হত্যাকাণ্ডের পূর্বদিন অর্থাৎ মঙ্গলবার বিকেলে নিহত জিয়ার ভাই আশা মাছ আনতে যায় রামদিয়ায়। সে সময় রামদিয়া বাজারে আশার সাথে তিয়রবিলার ওল্টু, রামদিয়ার টাকুসহ ৪-৫ জনের একটি গ্রুপের কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে তারা আশাকে হুমকি দিয়ে বলে, ‘তোর ভাই জিয়ার আজই শেষ দিন।’

এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওল্টু হরিণাকুণ্ডু উপজেলার ঠকপাড়ার হানেফ আলীর সাথে চরমপন্থী গ্রুপ করতো। তারা দুজনেই প্রায় দেড় যুগ জেল খেটে বাড়ি ফেরে। টাকু প্রায় ১ যুগ আগে রমজান মাসে তারাবি নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হলে প্রতিপক্ষ ৩ জনকে গুলি করে গুরুতর আহত করেন। সে মামলায় বহু বছর জেল খেটে সেও বর্তমানে বাড়িতে। এলাকাবাসীর ধারণা এ দুজনের নেতৃত্বে নতুন চরমপন্থি গ্যাংগ্রুপ তৈরি করা হয়েছে। এরাই জিয়াকে হত্যা করতে পারে। কয়েকজন নৈশ্যপ্রহরী তাদের সাথে জড়িত থাকতে পারে। জিয়া হত্যাকাণ্ডের সকালে গ্রাম থেকে পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির পোস্টার গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখেছিলো অনেকে। ওল্টু নিজেও হানেফের সাথে পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি সক্রীয়ভাবে করতো।

মেয়াদ থাকা সত্বেও শান্ত জোয়ার্দ্দারের বাঁওড় ছেড়ে যাওয়া: এছাড়াও পুলিশ গুরুত্বের সাথে দেখছে চুয়াডাঙ্গার শান্ত জোয়ার্দ্দারের মেয়াদ থাকা সত্বেও বাঁওড় ছেড়ে যাওয়ার ব্যাপারটি। বাঁওড়ের মৎস্যজীবী সমিতির সাথে চুক্তি অনুযায়ী শান্ত জোয়ার্দ্দারের এগ্রিমেন্টের মেয়াদ ছিলো এই এপ্রিল মাস অবধি। তিনি শতকরা ৬৫ ভাগ ও সমিতি ৩৫ ভাগ মাছ বিক্রির লভ্যাংশ পেতেন। প্রথম ভাগে মাছ ছোট থাকায় লাভ খুব বেশি না হলেও শেষের দিকে মাছ তো বেশ বড় আকৃতির হয়। ফলে শেষভাগে লাভের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। তারপরও শান্ত জোয়ার্দ্দার ২ বছর পূর্তির আগেই গত জানুয়ারির প্রথম ভাগে বাঁওড় ছেড়ে আসেন। কেন তিনি বাঁওড় ছাড়লেন মেয়াদ পূর্তির আগেই? তিনিও কি হুমকির মুখে ছিলেন? এ বিষয়টি পুলিশ গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন বলে জানা যায়।

ঘটনার দিনই পুলিশ হরিণাকুণ্ডু উপজেলার ফতেহপুর গ্রামের রবিউল ওরফে রবুল ও কায়েতপাড়ার সেলিম নামের একজনকে গ্রেফতার করে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ওসি (তদন্ত) লুতফুল কবীর জানান, গত ২০ এপ্রিল গ্রেফতার করা হয়েছে নৈশ্যপ্রহরী রামদিয়ার সলোককে। তাকে চুয়াডাঙ্গা গোয়েন্দা পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করছে। তাছাড়া গতকাল গোয়েন্দা পুলিশ বাকি নৈশ্যপ্রহরীদেরও ডেকে নিয়ে গভীর রাত অবধি জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রেখেছিলো বলে জানান তিনি। নৈশ্যপ্রহরীদের অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে বলে পুলিশের একটি সূত্র জানায়।

উল্লেখ্য, আলমডাঙ্গার কায়েতপাড়া গ্রামের মৃত আবুল মণ্ডলের ছোট ছেলে জিয়াউর রহমান জিয়া ছিলেন রামদিয়া-কায়েতপাড়া বাঁওড় (বড় বিল) মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি। গত ১৯ এপ্রিল ভোরে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা তাকে বাওড়ের কিনারে গুলি করে হত্যা করে। রাতে জিয়াউর রহমান জিয়া বাঁওড়ের নৌকায় ছিলেন। ভোর ৪টার দিকে নামাজ পড়ার উদ্দেশে নৌকা থেকে নেমে নিকটেই অবস্থিত নিজ বাড়িতে যাচ্ছিলেন। সে সময় ওঁত পেতে থাকা দুর্বৃত্তরা তাকে উদ্দেশ্য করে গুলি চালায়। এ সময় তার মাথায় ও কোমরে গুলি বিদ্ধ হলে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়।