আলমডাঙ্গায় রেললাইনের ওপর অবৈধভাবে মোষের হাট বসানোর ফলে ভয়াবহ ভাঙন

 

আলমডাঙ্গা ব্যুরো: ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলাদেশের প্রথম রেললাইনের গৌরব চুয়াডাঙ্গার দর্শনা থেকে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত রেলওয়ের মধ্যে আলমডাঙ্গার অংশ বিশেষের অবস্থা ক্রমেই ঝুকিপূর্ণ হচ্ছে। আলমডাঙ্গা লালব্রিজ সংলগ্ন পশুহাট বরাবর রেললাইনের গাইড লাইনও ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। নিয়মবহির্ভূত রেললাইনের ওপর মোষের হাট বসানোর ফলে রেললাইনের এমন ভয়াবহ ভাঙন শুরু হয়েছে।

জানা গেছে, ১৮৩২ সালে প্রথম ভারতে রেল ব্যবস্থা প্রবর্তনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ১৮৫১ সালের ২২ ডিসেম্বর ভারতে প্রথম রেল চালু হয়। ভারতের রুরকিতে স্থানীয় একটি খাল নির্মাণকাজে মালপত্র আনানেয়া করার জন্য এই ট্রেনটি চালু করা হয়েছিলো। তবে এটাকে অনেকেই রেলের আনুষ্ঠানিক যাত্রা হিসেবে স্বীকার করেন না। তাদের দাবি এটি ছিলো রেললাইন প্রতিষ্ঠার একটি প্রক্রিয়া। ১৮৫৩ সালের ১৬ এপ্রিল গেট ইন্ডিয়ার পেনিনসুলার রেলওয়ে নামক কোম্পানি কর্তৃক নির্মিত মুম্বাই থেকে আনা পর্যন্ত ৩৩ কিলোমিটার দীর্ঘ রেল লাইনটির উদ্বোধন করা হয়। এটিই ছিলো ব্রিটিশ ভারতের রেলওয়ের প্রথম যাত্রা। ১৮৫৪ সালে ভারতের তৎকালীন গভর্নর-জেনারেল লর্ড ডালহৌসির নির্দেশে মূলত বাংলাদেশে রেলওয়ের কার্যক্রম শুরু হয় ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৬২ সালে। বাংলাদেশে রেলওয়ের কার্যক্রম শুরু হয় ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর থেকে। সে সময় চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনা হতে কুষ্টিয়া জেলার জগতি পর্যন্ত ৫৩.১১ কিলোমিটার লাইন স্থাপিত হয়। নীলকরদের বিরুদ্ধে এতদাঞ্চলে প্রচণ্ড কৃষক বিদ্রোহের কারণে বিতাড়িত কিছু নীলকর সাহেব জগতিতে আখ মাড়াইয়ের কল উৎপাদন শুরু করেছিলো। আখ মাড়াইয়ের কল বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের নিকট পৌঁছুনো সহজ হবে রেলপথে। এমন চিন্তা থেকেই কুষ্টিয়ার জগতিতে পর্যবসিত প্রাক্তন নীলকর সাহেবদের স্বার্থে ও প্রযতেœ অবহেলিত এ জনপদে অন্যান্য অঞ্চলের অগেই রেলের যাত্রারম্ভ। পরে ১৮৭১ সালের ১ জানুয়ারি গোয়ালন্দ পর্যন্ত সেকশনটি চালু হয়। অবশ্য বাংলায় আরও প্রায় ৮ বছর আগে প্রথম রেলপথ চালু হয় ১৮৫৪ সালে পশ্চিম বঙ্গের হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার রেলপথের উদ্বোধনের মাধ্যমে। ১৮৯৭ সালে দর্শনা–পোড়াদহ সেকশনটি সিঙ্গেল লাইন থেকে ডাবল লাইনে উন্নীত করা হয়। পর্যায়ক্রমে ১৯০৯ সালে পোয়াদহ–ভেড়ামারা, ১৯১৫ সালে ভেড়ামারা–ঈশ্বরদী এবং ১৯৩২ সালে ঈশ্বরদী–আব্দুলপুর সেকশনগুলোকে ডাবল লাইনে উন্নীত করা হয়। আলমডাঙ্গায় কুমার নদের ওপর লালব্রিজখ্যাত বর্তমান রেলওয়ে ব্রিজটি ১৯০৯ সালে উদ্বোধন করা হয়। তারপর কালীদাসপুর থেকে রেলস্টেশন আলমডাঙ্গায় স্থানান্তরিত হয় বলে জানা যায়।

আলমডাঙ্গা অঞ্চলে রেললাইন মূলত: বিল বা নিচু জমির মধ্যদিয়ে সৃষ্টি হয়েছে। পাথর, ইটের টুকরো, মাটি-বালির সংমিশ্রনে এ সুউচ্চ রেললাইন প্রতিষ্ঠিত। ভারতের মালদহসহ বিভিন্ন এলাকার ( মালবদ্দি, সাঁওতালসহ) বিভিন্ন উপজাতির অক্লান্ত পরিশ্রমে নির্মিত এ রেললাইন। এরা রেললাইন তৈরির সময় অস্থায়ীভাবে বসবাস করতেন বর্তমান রোয়াকুলি গ্রামে। এখানে বসবাসকারী শ্রমিকরা রেললাইনের লোহার কাজের কাজ করতো বলে এদেরকে স্থানীয়রা বলত ‘নুয়ার কুলি’ (লোহার কুলি)। পরবর্তীতে তা বিকৃত হয়ে ‘নুয়াকুলি’ হয়। আরও পরে যা  ‘রোয়াকুলি’-তে পরিবর্তীত হয়েছে।

বাংলাদেশে প্রথম রেললাইনের গর্ব দর্শনা থেকে জগতি পর্যন্ত রেললাইনের আলমডাঙ্গা অংশ আজ নানাভাবে হুমকির সম্মুখিন। বিশেষ করে লালব্রিজ সংলগ্ন পশুহাটের অংশটুকো হুমকির মুখে। রেললাইনের একবারে পাদদেশে এ পশুহাট অবস্থিত। তারপর আবার অনেক বছর ধরেই অবৈধভাবে রেললাইনের ওপর নিয়োমিত মোষের হাট বসানো হচ্ছে। প্রতি হাটবারে বহু সংখ্যক মোষ রেললাইনের ঢাল বেয়ে ওপরে অবস্থিত মোষের হাটে উঠানামা করে। এতে প্রতিনিয়ত রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাছাড়া মোষ কেনাবেঁচার দালালরা রেললাইন ও তার ঢালে মোষ দাবড়িয়ে নিয়ে বেড়াই। মোষের তেজিত্ব প্রদর্শন করে। এতে রেললাইনের একেবারে পাশ ঘেষে ঢালের মাটি ভেঙে গেছে। মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে রেললাইন। বেশ কয়েক বছর আগে মোষের হাটের দৌরাত্ব থেকে রেললাইনকে রক্ষা করতে গাইড নির্মাণ করা হয়েছিলো। বর্তমানে সেই গাইড লাইনের পাশের মাটিও সরে গেছে। তাছাড়া পশুহাটের নির্ধারিত দিনেও খোদ রেললাইনের ওপর মোষের হাট বসে। ফলে চলাচলের সময় যাত্রীবাহী ট্রেন দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে বহু মানুষের প্রাণহানির ঝুঁকি রয়েছে। এত ঝুঁকির মধ্যেও সম্পূর্ণ অবৈধভাবে রেললাইনের ওপর নিয়মিত পশুহাট বসানো হয়।

এছাড়াও রেললাইনের ওপর অবৈধ বসতি নির্মাণ, বসতিদের রেললাইনের ঢাল কেটে রাস্তা তৈরি, রেললাইনের একেবারে পাদদেশে অবৈধভাবে পুকুর কেটে মাছচাষ করাসহ বিভিন্ন কারণে রেলপথটি আজ হুমকির সম্মুখীন। বাংলাদেশে রেলওয়ের ঐতিহ্যের স্মারক আলমডাঙ্গার রেললাইনের গৌরব আজ ধ্বংসের মুখে। অথচ দেখার কেউ নেই।