আমি অসুস্থ না, আবার ফিরে আসবো

যাওয়ার আগে বললেন প্রধান বিচারপতি

স্টাফ রিপোর্টার: প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, সরকারের একটা মহল আমার রায়কে ভুল ব্যাখ্যা করে পরিবেশন করায় প্রধানমন্ত্রী আমার প্রতি অভিমান করেছেন। প্রধানমন্ত্রী আমাকে ব্যক্তিগতভাবে যেভাবে সমালোচনা করেছেন, এতে আমি সত্যিই বিব্রত। অচিরেই তার অভিমান দূর হবে বলে আমার বিশ্বাস। গতকাল শুক্রবার রাতে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার উদ্দেশে বাসভবন ছাড়ার আগে এক খোলা চিঠিতে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের রদবদলের বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির উদ্বৃতি দিয়ে আইনমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে আমি শংকিতও বটে।

উচ্চ আদালতের বিচারপতি অপসারণ সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় ও রায়ে প্রধান বিচারপতি সিনহার দেয়া পর্যবেক্ষণের তীব্র সমালোচনা করেন সরকার ও সরকার দলীয় সংসদ সদস্যরা। তাতে যোগ দেয় সংসদের প্রধান বিরোধী দলও। এমনকি সরকারপন্থী বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের নেতারাও প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের দাবিতে সরব হন। এরপর দীর্ঘ অবকাশ শেষে সুপ্রিম কোর্ট খোলার একদিন আগে ২ অক্টোবর এক মাসের ছুটিতে যান প্রধান বিচারপতি। ছুটির চিঠিতে তিনি শারীরিক অসুস্থতার বিষয়টির উল্লেখ করেন। যদিও এ ছুটিতে যাওয়া নিয়ে দেশের বিভিণ্ন মহলে বিভিন্ন ধরনের গুঞ্জন শুরু হয়। তবে প্রধান বিচারপতি অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগে সাংবাদিকদের বলেছেন, আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি।

প্রধান বিচারপতি অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে গতকাল রাতে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের এসকিউ-৪৪৭ ফ্লাইটে ঢাকা ত্যাগ করেন। স্ত্রী সুষমা সিনহা তাকে বিমানবন্দরে বিদায় জানান। শনিবার ভোর ৬টায় ফ্লাইটটির সিঙ্গাপুর পৌঁছানোর কথা। সেখানে প্রায় এক ঘন্টা যাত্রাবিরতি শেষে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে রওনা হবেন প্রধান বিচারপতি। আজ শনিবার সন্ধ্যায় অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছাবেন। অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে প্রধান বিচারপতির বড় কন্যা সূচনা সিনহা বসবাস করেন। সেখানে তিনি অবস্থান করবেন।

এক মাসের ছুটিতে যাওয়ার পর আরো ১০দিন ছুটির মেয়াদ বৃদ্ধি করেন প্রধান বিচারপতি। রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পরই বৃহস্পতিবার আইন মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে। ওইদিনই সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের রাতের ফ্লাইটের টিকেট কাটেন প্রধান বিচারপতি। শুক্রবার অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়। দিনভর তিনি বাসায় অবস্থান করেন। এসময় তার নিকটাত্মীয় ও স্বজনরা প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করেন। প্রধান বিচারপতি গতকাল দেশ ছাড়ছেন এমন খবরে তার বাসভবনের সামনে সন্ধ্যা থেকেই ভীড় করেন ইলেকট্টনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকরা। রাত ১০টায় গাড়িতে করে সস্ত্রীক বাসভবন থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা হন। বাসভবনের লন থেকে গাড়ি গেট পর্যন্ত আসলে প্রধান বিচারপতি গাড়ি থেকে নেমে পড়েন। এ সময় প্রধান বিচারপতি সাংবাদিকদের বলেন, আমি অসুস্থ নই। আমি চলে যাচ্ছি, পালিয়েও যাচ্ছিনা। আমি আবার ফিরে আসবো। আমি একটু বিব্রত। আমি বিচার বিভাগের অভিভাবক। বিচার বিভাগের স্বার্থে, বিচার বিভাগটা যাতে কুলষিত না হয়, এ কারণেই আমি সাময়িকভাবে যাচ্ছি। আমার কারো প্রতি কোনো বিরাগ নেই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সরকারকে ভুল বোঝানো হয়েছে। এই আমার বক্তব্য আর কিছু বলবো না। আমি লিখিত বক্তব্য দিচ্ছি। এরপরই প্রধান বিচারপতি নিজ থেকেই তার বক্তব্য সম্বলিত ‘খোলা চিঠি’ সাংবাদিকদের হাতে দেন।

প্রসঙ্গত, উচ্চ আদালতের বিচারপতি অপসারণ সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে গত ৩ জুলাই রায় দেন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির বেঞ্চ। পুন:র্বহাল করা হয় সামরিক ফরমানের মাধ্যমে সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত হওয়া সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বিধান। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের মূল রায়টি লিখেছেন প্রধান বিচারপতি সিনহা। ৭৯৯ পৃষ্ঠার রায়ে প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্র ও সমাজ, সামরিক শাসন, রাজনীতি, নির্বাচন কমিশন ও সংসদ ও বিচার বিভাগ নিয়ে নানা পর্যবেক্ষণ দেন। কড়া সমালোচনা করেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘আমি ও আমিত্ব’-এর সংস্কৃতির। বেঞ্চের অপর বিচারপতিরাও ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে তাদের অভিমত তুলে ধরেন রায়ে। এরপরই ওই রায় ও রায়ে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার দেয়া পর্যবেক্ষণের তীব্র সমালোচনা করেন সরকার ও সরকার দলীয় সংসদ সদস্যরা। তাতে যোগ দেয় সংসদের প্রধান বিরোধী দলও। এমনকি সরকার ও সরকারপন্থী বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের নেতারাও প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের দাবিতে সরব হন। পাশাপাশি রায়ে প্রধান বিচারপতির দেয়া পর্যবেক্ষণও স্বত:প্রণোদিত হয়ে প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়। এছাড়া গত ১৩ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং তার কিছু পর্যবেক্ষণের বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নিতে একটি প্রস্তাবও গ্রহণ করা হয়। তবে রায়কে স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য দেয় বিএনপি ও তার সমর্থিত আইনজীবীরা। এদিকে প্রধান বিচারপতি ছুটিতে যাওয়ার পরেই ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি সংগ্রহ করে রাষ্ট্রপক্ষ।

গত ৩ অক্টোবর থেকে পহেলা নভেম্বর পর্যন্ত এক মাসের ছুটিতে যান প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা। কিন্তু ওই মেয়াদ শেষ না হতেই গত ১০ অক্টোবর ছুটির মেয়াদ আরো দশ দিন বৃদ্ধি করেন প্রধান বিচারপতি। ওইদিনই সুপ্রিম কোর্ট থেকে একটি চিঠি আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে বলা হয়, বিচারপতি এসকে সিনহা দীর্ঘদিন বিচার কাজে থাকায় এবং অবসর গ্রহনের তারিখ নিকটবর্তী হওয়ায় মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্থ। মানসিক অবসাদ দূর করার জন্য প্রধান বিচারপতি অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য গমন ও অবস্থান করতে চান। চিঠির এই বিষয়টি প্রধান বিচারপতি তার একান্ত সচিবকে বাচনিক (মৌখিক) নির্দেশনা প্রদান করেছেন বলে সুপ্রিম কোর্টের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ে এই চিঠি যাওয়ার পরই তা পাঠিয়ে দেওয়া হয় রাষ্ট্রপতির দফতর। কিশোরগঞ্জ থেকে ঢাকায় ফিরে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ প্রধান বিচারপতির বিদেশ গমন সংক্রান্ত নথিতে স্বাক্ষর করেন। পরদিন ১২ অক্টোবর এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে আইন মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, প্রধান বিচারপতি বর্ধিত ছুটি কালীন বিদেশে অবস্থানকালে ২ নভেম্বর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত অথবা পুনরায় স্বীয় কার্যভার গ্রহন না করা পর্যন্ত বিচারপতি মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা প্রধান বিচারপতির কার্যভার পালনের দায়িত্ব চালিয়ে যাবেন।

২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি দেশের ২১ তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচারপতি এসকে সিনহা শপথ নেন। ওইদিন থেকে এ পদে দায়িত্ব পালন করে আসছেন তিনি। প্রধান বিচারপতি হিসাবে দায়িত্ব পালনকালে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিচারিক সম্মেলনে যোগদানের লক্ষ্যে একাধিকবার বিদেশ সফর করেছেন। সর্বশেষ জাপানে অনুষ্ঠিত এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর প্রধান বিচারপতিদের সম্মেলনে যোগদান শেষে ২৪ সেপ্টেম্বর তিনি দেশে ফেরেন। ছুটিতে থাকাকালীন এই প্রথম তিনি দেশের বাইরে ব্যক্তিগত সফরে যাচ্ছেন। এই সফরে সরকারের কোন আর্থিক সংশ্লেষ নেই বলে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো সুপ্রিম কোর্টের চিঠিতে বলা হয়েছে। ২০১৮ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি বিচারপতি সিনহা অবসরে যাবেন।