আবারো আড়ালে দল ভাঙার রাজনীতি : বিশ্লেষকদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি

স্টাফ রিপোর্টার: দৃশ্যমান না হলেও পর্দার আড়ালে দল ভাঙার রাজনীতি অনেকটা জোরেশোরেই সক্রিয় হচ্ছে। বলা যায়, সাজঘরের প্রস্তুতি শেষের দিকে। লক্ষ্য নতুন বছরের জানুয়ারি মাস। প্রস্তুতি সফল হলে সময়টা বিএনপির জন্য আরও কঠিন হয়ে উঠতে পারে। এই যখন অবস্থা, তখন এক সময় যারা কিংস পার্টির স্বপ্ন দেখেছিলেন তাদেরও কেউ কেউ ফের নতুন স্বপ্নে বিভোর।
রাজনীতি নিয়ে এমন ঘাত-প্রতিঘাতের অঙ্কের পরিণতি যাই হোক না কেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে এবারের বিষয়টিকে একটু গুরুত্বের সাথে দেখছেন। তারা বলছেন, যদিও দল ভাঙার অপরাজনীতি করে অতীতে কেউই সফল হয়নি, তারপরও এবারের বেদনা ভিন্ন রকম হতে পারে। কেননা, মাইনাস ফর্মুলা থেকে শুরু করে অতীতে যারা যখন দল ভাঙার খবরের জন্ম দিয়েছেন তারা কেউ জনগণের কাতারে ছিলেন না। কিন্তু এবার যদি সত্যিই সে রকম ঘটে যায় তখন তা শক্ত ভিত পেয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। কারণ টানা দ্বিতীয় মেয়াদে অনেকটা শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে আওয়ামী লীগের মতো একটি বৃহৎ দল সরকারে রয়েছে।
তারা এও বলেন, নাটকের শেষ অঙ্ক কী হবে তা নিয়ে হয়তো এখনই হলফ করে কিছু বলা যাবে না। তবে এ সময়ে বিএনপির বিপরীতে আর একটি বিএনপি অবস্থান নিলে পানি বেশ খানিকটা ঘোলাটে হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ভোটের হিসাবের বাইরে পরিস্থিতির কারণে সাময়িক রোগমুক্তির জন্য অনেকে নতুন পতাকাতলে সমবেত হতে পারে।
এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমরা ইতিহাস থেকে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করি না। কিন্তু অনৈতিকতার পরিণতি ভয়াবহ। আমি আশা করি, সবারই শুভ বুদ্ধির উদয় হবে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে.জে. মাহবুবুর রহমান বলেন, বিএনপিকে কেউ কোনোদিন ভাঙতে পারবে না। এমন চেষ্টা অতীতেও সফল হয়নি। তবে তিনি মনে করেন, এখন আবার নতুন করে যারা চেষ্টা করছেন তাদের পেছনে প্রভাবশালী কোনো না কোনো পক্ষের হাত থাকতে পারে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, আমরা ভাঙা-গড়ার রাজনীতি করি না। যদি কেউ বিএনপি থেকে বেরিয়ে যায় তার জন্য তো সরকার দায়ী নয়। সাম্প্রতিক সময়ে হঠাৎ করে গুপ্তহত্যা বেড়ে যাওয়ায় দল ভাঙার গোপন প্রক্রিয়ার পালে জোরেশোরে বাতাস লাগে। একদিকে এসব ষড়যন্ত্রমূলক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সরকার যেমন উদ্বিগ্ন, তেমনি এ উদ্বেগ থেকেই রাজনীতির অন্দর মহলে শুরু হয়েছে নানা তৎপরতা। বিশেষ করে দু বিদেশি হত্যাকাণ্ডের পর থেকে রাজনীতির পটভূমি তৃতীয় কোনো পক্ষ ঘোলাটে করতে অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। একইসাথে এ ধরনের স্পর্শকাতর হত্যাকাণ্ডে বিএনপির যোগসূত্রতার খবর প্রকাশিত হওয়ায় কঠিন বিপর্যয়ে থাকা দলটি আরও বেকায়দায় পড়েছে। সরকারও কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়ার মতো বিএনপিকে প্রতিটি ঘটনায় কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে বদ্ধপরিকর। বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাস্তবিক অর্থে এমন দুঃসময়ে দল ভেঙে যাওয়ার খবর সত্যি হলে তা কিছুটা হলেও বিএনপির জন্য ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে বিপাকে ফেলবে।
বিভিন্নসূত্রে জানা গেছে, এই মুহূর্তে সরকারের রাজনীতির কৌশলগত দিক হচ্ছে বিএনপিকে চাপে রাখা। এজন্য দায়েরকৃত পুরনো মামলাগুলো কাজে লাগানোর পাশাপাশি তাদের সব ধরনের সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক যোগাযোগের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। সম্ভব হলে ২০ দলীয় জোটে বিভক্তি বা দলটির মধ্যকার দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে তাদের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টিতেও সক্রিয় উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে। এদিকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের দণ্ড কার্যকরের দিন ক্রমেই এগিয়ে আসছে। আর এতেই ঘাতকদের অনুসারীরা বেপরোয়া হয়ে দেশে অস্থিরতা তৈরিতে গুপ্তহত্যা এবং বোমা বিস্ফোরণের পথ বেছে নিয়েছে বলে মনে করছেন সরকার সংশ্লিষ্টরা। বিএনপি-জামায়াত সরাসরি এসব ঘটনার পেছনে রয়েছে বলে তারা দাবি করেন। এ পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণে সরকারের নীতিনির্ধারকরা নিজেদের মধ্যে দফায় দফায় আলোচনা করছেন। এ আলোচনায় বিএনপি ও জামায়াতকে চাপে রাখার কৌশল নেয়া হয়েছে। কৌশলের অংশ হিসেবে ২০ দলীয় জোটের পরিধি সংকুচিত করার পাশাপাশি বিএনপি ও জামায়াতের ভেতরের দ্বন্দ্বকে সুকৌশলে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে সংশ্লিষ্ট মহল। খুব শিগগিরই এসব উদ্যোগ ও পদক্ষেপের ব্যাপারে কার্যকর ফলাফলের বিষয়েও আশাবাদী এর উদ্যোক্তারা।
অবশ্য এর আগেই ২০ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে এসেছেন বিএনপির পুরনো মিত্র শেখ শওকত হোসেন নিলু। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছেন বিএনপির সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা। তার এই সাক্ষাৎ নিয়েও বাজারে নানা গুঞ্জন রয়েছে। অপরদিকে সাবেক এমপি শহিদুল হক জামাল ও আবু হেনা নতুন বিএনপি গড়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিএনপির সাবেক এ দু নেতা দলটির সংস্কারপন্থী নেতাদের সংগঠিত করে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনে জোর তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন।
জানা গেছে, বিএনপির সাবেক এ দু নেতা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ার আগ্রহ ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু কৌশলগত কারণে ক্ষমতাসীনরা বিএনপির নেতাদের দলে না নিয়ে তাদের ভিন্ন কিছু করার পরামর্শ দেয়। এর পরপরই তারা নতুন বিএনপি গড়ার লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নেমে তৎপরতা শুরু করেন। এ প্রসঙ্গে আবু হেনা বলেন, দলের বহু নেতাকর্মী জেলে রয়েছেন। তাদের মুক্ত করতে আমাদের সংগ্রাম করতে হবে। তিনি জানান, সবাইকে নিয়ে জানুয়ারির মধ্যে কনভেনশন করে সেখানে নতুন নেতা নির্বাচন করা হবে।
এদিকে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, বিকল্প ধারার মাহী বি. চৌধুরীর সাথে পর্দার আড়ালে সরকারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। বিএনপিতে বি. চৌধুরীর ফিরে যাওয়ার গুঞ্জনের পর ওই যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয় বলে সূত্রটি দাবি করে। এর পরেই বিএনপিতে বিকল্প ধারার একীভূত হওয়া ঠেকানো সম্ভব হয় বলে দাবি করেন সংশ্লিষ্টরা। এর বাইরে ২০ দলীয় জোটের ছোট ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ক্ষমতাসীনদের যোগাযোগ রয়েছে বলে জানা গেছে। শাসক দলের পক্ষ থেকে তাদের ভুল রাজনীতি থেকে সরে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে। লন্ডনে অবস্থানরত জামায়াত নেতা ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের অস্বাভাবিক নীরবতার পেছনেও কৌশলগত রাজনৈতিক কারণ রয়েছে বলে খোদ দলটির নেতাকর্মীরা মনে করেন।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা, সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিয়াউর রহমানের ভাই আহমেদ কামালের ডাকা মিলাদ মাহফিল নিয়েও গুজবের অন্ত নেই। বলা হচ্ছে, এর পেছনেও সরকারের হাত রয়েছে এবং এটিই হল বিএনপি ভাঙার বড় সঙ্কেত। এমন অভিযোগ করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা।
অবশ্য এসব বিষয়কে পুরনো কৌশল এবং এর সম্ভাবনার ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করছে সচেতন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল। তারা বলছেন, সব অগণতান্ত্রিক সরকারের আমলেই এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়। সর্বশেষ ওয়ান-ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও এমন জোরালো তৎপরতা ছিলো। দেশের প্রধান দু রাজনৈতিক দলের নেত্রীকে মাইনাস করার সক্রিয় উদ্যোগও সে সময় সফল হয়নি। বরং শেষ অবধি নিজ নিজ রাজনৈতিক দলে দু নেত্রীর ক্ষমতা আরও সুসংহত হয়েছে।
সাবেক দু এমপি শহিদুল হক জামাল ও আবু হেনার উদ্যোগ, আহমেদ কামালের মিলাদ মাহফিল এবং দলটির কেন্দ্রীয় নেতা শমসের মবিন চৌধুরীর সরে যাওয়ার বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে.জে. মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, আবু হেনা ও শহিদুল হক জামালের উদ্যোগের ফলে বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।
এ ছাড়া আহমেদ কামালের মিলাদ মাহফিলকে তিনি ধর্মীয় অনুষ্ঠান বলে মন্তব্য করেন। শমসের মবিন চৌধুরীর সরে যাওয়ার বিষয়ে মাহবুবুর রহমান বলেন, তিনি অসুস্থতাজনিত কারণ দেখিয়েছেন। এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারেই। এদিকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ আরও বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় থেকে দুর্নীতি, সন্ত্রাস এবং জঙ্গি লালন করেছে। ক্ষমতার বাইরে গিয়েও তারা একই কাজ করছে। জঙ্গিদের লালন-পালন এবং আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে, রাজনীতির নামে পেট্রলবোমা দিয়ে মানুষ হত্যা করছে। এতে তারা যেমন জনগণের কাছে অজনপ্রিয় হয়েছে, তেমনি নিজ দলের নেতাকর্মীদের আস্থাও হারিয়েছে। এরকম অবস্থায় দলটিতে ফাটল ধরার যথেষ্ট কারণ তৈরি হয়েছে।