আবগারি শুল্ক কমানো ও সংবাদপত্রের ওপর ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি

 

স্টাফ রিপোর্টার: সংবাদপত্রের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট বসানোর প্রস্তাব প্রত্যাহার করতে হবে। ব্যাংকে এক লাখ টাকার বেশি আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক বাড়ানোর যে প্রস্তাব করা হয়েছে সেটি কমাতে হবে। সবার আশঙ্কা, সদ্ধিান্ত পরিবর্তন না হলে দেশে অবৈধ চ্যানেলে টাকার লেনদেন বাড়বে। তাতে হুমকিতে পড়বে ব্যাংকিং খাত। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি আয়োজিত বাজেট আলোচনায় অংশ নেয়া ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ, গবেষক, ব্যাংকারসহ বিভিন্ন অংশীজনের প্রতিনিধিদের বক্তব্যে ছিলো এমন অভিন্ন সুর। আজ শনিবার রাজধানীর গুলশানে লেকশোর হোটেলে প্রস্তাবিত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে এ সংলাপের আয়োজন করা হয়।

সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘ভ্যাট ও আবগারি শুল্ক নিয়ে সংসদ ও সংসদের বাইরে অনেক আলোচনা চলছে। প্রধানমন্ত্রীর ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস আছে। তিনি এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না, যাতে জনগণের কোনো ক্ষতি হবে। আপনারা অপেক্ষা করুন। উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। এর একটি সুন্দর সুরাহা হবে।’ অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান আভাস দেন, আবগারি শুল্ক নিয়ে যে আলোচনা-সমালোচনা চলছে তার একটি সুষ্ঠু সমাধান আসবে।

সিপিডির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও বিশষ্টি অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানের সঞ্চালনায় বাজেট সংলাপে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন বিএনপি নেতা ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদষ্টো আকবর আলি খান, সিপিডির সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রমুখ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।

আকবর আলি খান তার বক্তব্যে অর্থমন্ত্রীকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘আপনি একদিকে ভ্যাটের হার বাড়াচ্ছেন, একই সঙ্গে আবগারি শুল্কও বাড়াচ্ছেন। ভ্যাট থাকলে আবগারি শুল্ক থাকার কথা নয়। আসছে ১ জুলাই থেকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট কার্যকর হলে আবগারি শুল্ক বাতিল করে দেওয়া উচিত। ‘ বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখার সমালোচনা করেন তিনি। বলেন, ‘আইনগতভাবে আপনি এটাকে বৈধ বললেও এটা অনৈতিক। বেসরকারি বিনিয়োগ কয়েক বছর ধরে স্থবির হয়ে আছে। প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তাদেরও প্রণোদনার কিছু নেই। ব্যাংকিং খাতে ধারাবাহিকভাবে অনিয়ম-দুর্নীতি চলে আসছে। এর পরও প্রস্তাবিত বাজেটে পুনর্মূলধনীকরণের জন্য দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখাটা দুঃখজনক। ’

আকবর আলি খান বলেন, ‘আমাদের দেশে যে প্রক্রিয়ায় বাজেট প্রণয়ন ও পাস করা হয় তার পুরোটার মধ্যেই ত্রুটি রয়েছে। এখানে বাজেট তৈরিতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির অংশগ্রহণ নেই। বাজেট তৈরির সময় সংসদীয় কমিটিতেও আলোচনা হয় না। ’ তিনি বলেন, ‘দেশে দীর্ঘদিন ধরে সত্যিকারের কোনো বিরোধী দল নেই। কার্যকর বিরোধী দল না থাকায় বাজেট নিয়ে তেমন আলোচনাই হয় না। বাজেট বইয়ের পৃষ্ঠা বেড়েছে; কিন্তু স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হয়নি। বাজেট বইয়ে অনেক কিছুই লুকানো থাকে, যেটা জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। ’

অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘কেউ কেউ বলছেন যে সংসদে বিরোধী দল নেই। বিরোধী দল কে হবে সেটা আমাদের দায়িত্ব নয়। এ জন্য আলাদা তহবিলও নেই। এই নামে কোনো খাত নেই। অর্থ বরাদ্দও নেই। তবে বিরোধী দল বাইরে আছে। ’ ব্যাংকিং খাত ঝুঁকিতে আছে বলে যে কথা উঠেছে সে প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ঝুঁকিবাজ সরকার। আমরা ঝুঁকি নিই। ব্যাংকগুলোতে বিপদ ছিলো। তা কেটে গেছে। অন্যান্য দেশেও ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়। মন্দ ঋণ হয়। ’ চালের দাম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা বোবা-কালা সরকার নই। চালের দাম বাড়েনি। ’

বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চেৌধুরী বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এ বছর তিনি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ বাজেট দিয়েছেন। কিন্তু শ্রেষ্ঠ বাজেট দিতে গিয়ে তিনি সব দিকে নজর দিতে পারেননি। অর্থমন্ত্রী সংবাদপত্রের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট বসানোর প্রস্তাব করেছেন। সংবাদপত্রে ব্যবহূত নিউজপ্রিন্ট, কালি, বিজ্ঞাপন, প্লেটের ওপর ভ্যাট বসানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এটা অত্যন্ত ভুল কাজ হয়েছে। অবিলম্বে এ প্রস্তাব প্রত্যাহার করা উচিত। ’ তিনি বলেন, গণতন্ত্র বিকাশের জন্য সরকারের সমালোচনা করার অধিকার থাকতে হবে। সরকারের ভুল ও ভালো দুটিই বলার সুযোগ থাকতে হবে। সুশাসন ও গণতন্ত্র না থাকলে যত টাকাই থাকুক না কেন, তাতে কোনো সুফল মিলবে না।

জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘বয়োবৃদ্ধদের মাসে স্বাস্থ্যসেবাতে ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। তাই তাদের কথা বিবেচনা করে তাঁদের করমুক্ত সীমা পাঁচ লাখ টাকা করা উচিত। আর বিদেশিদের চাপে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো ঠিক হবে না। ’ একই সঙ্গে তিনি বিড়ি-সিগারেটের ওপর কর বাড়ানোর দাবি জানান।

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, কয়েক বছর ধরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। সরকার চেষ্টা করছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপির মাধ্যমে সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে। কিন্তু ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ছাড়া বেশিদূর অগ্রসর হওয়া যায় না। তিনি বলেন, ১০ বছর আগে দেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিলো সাতের ঘরে। ১০ বছর পরও তা সেখানেই রয়ে গেছে। মানবসম্পদ সূচকে বাংলাদেশের তালিকা সবার পেছনে। এর কারণ হলো, সরকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে কাঙ্ক্ষিত হারে বাজেটে অর্থ বরাদ্দ দেয়নি।

অর্থমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে আমীর খসরু বলেন, ‘আপনি প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছেন না। শুধু পরোক্ষ করের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। সব ধরনের পণ্য ও সেবার ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট বসাচ্ছেন। সাধারণ মানুষের আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক বাড়াচ্ছেন। ’ তিনি বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক লড়াই চলছে। কারণ সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। প্রশাসনে অতিমাত্রায় রাজনৈতিকীকরণের কারণে সরকারি কর্মকর্তারা কাজ করতে পারছেন না। সরকারের বৈধতা নিয়ে সবখানে যখন আলোচনা হয় তখন ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ না হওয়াটাই স্বাভাবিক।

পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘অনেকে বলছেন টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। টাকা বাইরে যাবে না কেন। স্যামসাং আমাদের দেশে কারখানা করছে। টাকার একটা ধর্ম আছে। যেখানে সে মূল্যায়ন পাবে, ভালো মুনাফা পাবে, টাকা সেখানে যাবেই। আমাদের টাকাও বিদেশে যাচ্ছে। ’

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দেশে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি গড়ে ৭ শতাংশ হারে অর্জিত হচ্ছে। কিন্তু সে হারে বিনিয়োগ হচ্ছে না। কর্মসংস্থান হচ্ছে না। তাহলে কি কর্মহীন প্রবৃদ্ধি হচ্ছে? দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে প্রণোদনা জরুরি। কর্মসংস্থান বাড়ানোও জরুরি।