আত্মসমার্পনের পর জেলহাজতে এমপি আমানুর

 

স্টাফ রিপোর্টার: টাঙ্গাইলের প্রভাবশালী খান পরিবারের বড় ভাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় ৪৬টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে বিচার ছাড়াই ৪৪টি মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন তিনি। অব্যাহতি না পেলেও একটি মামলা উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত আছে। তবে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যার ঘটনায় আমানুরসহ চার ভাইকে আসামি করে অভিযোগপত্র আদালতে দেয়া হয়েছে। এই মামলার অভিযোগ গঠনের জন্য আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর শুনানির দিন ধার্য রয়েছে। ফলে এই মামলায় তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

ফারুক হত্যায় নাম আসার পর প্রায় দুই বছর ধরে আত্মগোপনে ছিলেন টাঙ্গাইল-৩ আসনের সাংসদ আমানুর। গতকাল রোববার সকালে টাঙ্গাইলে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করেন। আদালত জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠিয়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, যে ৪৪টি মামলা বিচার ছাড়াই শেষ হয়েছে তার বেশির ভাগ মামলায় বাদী ও সাক্ষী অনুপস্থিত ছিলেন, মামলা রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্যাহারের সুপারিশ ছিল, বিচার শুরুর আগেই আদালত থেকে অব্যাহতি ও কোনোটি পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়েছে। অব্যাহতি পাওয়া মামলাগুলোর মধ্যে হত্যা মামলার পাশাপাশি চাঁদাবাজি, মারধর, অস্ত্রসহ বিভিন্ন ফৌজদারি অপরাধের মামলাও ছিলো।

আওয়ামী লীগের সাংসদ আমানুর রহমান খানের (রানা) তিন ভাই হলেন টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র সহিদুর রহমান খান (মুক্তি), ব্যবসায়ী নেতা জাহিদুর রহমান খান (কাকন) ও ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সহসভাপতি সানিয়াত খান (বাপ্পা)। তাদের বিরুদ্ধে বেশ অনেকগুলো মামলা রয়েছে। তার আরেক ভাই আমিনুর রহমান খানের (বাপ্পি) বিরুদ্ধে দুটি হত্যা মামলাসহ কয়েকটি মামলা ছিলো। ২০০৩ সালের নভেম্বরে শহরে নিজ বাড়ির কাছে খুন হন তিনি। সহিদুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৩৬টি। অপর দুই ভাই জাহিদুর রহমান ও সানিয়াত খানের বিরুদ্ধে দুটি হত্যাসহ কয়েকটি মামলা রয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো মামলায় তাঁদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি। গত বছরের ১৩ অক্টোবর সন্ধ্যায় গণভবনে নিহত ফারুকের স্ত্রী নাহারকে ডেকে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বামীর হত্যার বিচার প্রসঙ্গে নাহার আহমেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী তাকে বিচারের ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছেন। খুনিদের সাথে আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ করলে প্রধানমন্ত্রী তাকে বলেছেন, খুনি যেই হোক, তাদের ছাড় নেই। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, ‘আমি আশাবাদী স্বামীর খুনিদের বিচার হবেই।’

ভয়ে লড়তে চান না বাদীরা: ২০০৪ সালের অক্টোবরে শহরে খুন হন জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি এম এ রউফ। এর কয়েক দিন আগে খুন হন সাবেক পৌর কমিশনার রুমি চৌধুরী। এই দুটি হত্যায় সাংসদসহ চার ভাইকে আসামি করে মামলা করা হয়। পুলিশ তদন্ত শেষে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে। এই মামলা দুটির বিচারকাজ চলছিলো জেলার অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর মামলা দুটি প্রত্যাহারের আবেদন করা হয়। কিন্তু মামলা বিচারাধীন থাকা, হত্যা মামলা ও রাজনৈতিক কারণে এই মামলা করা হয়নি উল্লেখ করে কমিটি মামলা প্রত্যাহারের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। পরে ২০১২ সালের নভেম্বরে উপনির্বাচনে বড় ভাই আমানুর রহমান খান সাংসদ নির্বাচিত হলে পরের বছর আবার আবেদন করেন তারা। ২০১৩ সালের শেষ দিকে মামলা দুটি প্রত্যাহারের সুপারিশ করে সরকারের মামলা প্রত্যাহার কমিটি।

রউফ হত্যা মামলার বাদী তার বাবা দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘মামলাটি প্রত্যাহার হচ্ছে শুনেছি। এরা ক্ষমতাবান। এদের বিরুদ্ধে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কীই-বা করার আছে। কিছু করতে চাই না। কোনো রকমে বেঁচে আছি, সেভাবেই থাকতে চাই।’ আদালত সূত্রে জানা গেছে, মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ আসার পর তা অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়েছে। এই সুপারিশের বিরুদ্ধে কেউ কোনো আপত্তি দেয়নি। ফলে এর কার্যক্রম চলছে না।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বাদীদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে দেন খান পরিবারের সদস্যরা। মামলা নিয়ে পুলিশ ও আদালতে দৌড়ঝাঁপ করা তো দূরের কথা, অন্তত চারটি বাদী পরিবার এখন এলাকাছাড়া হয়েছে। তারা এখন আর শহরে থাকে না। একটি পরিবারের কয়েকজন নারী সদস্য শুধু নিয়মিত বাসায় থাকেন। ছেলে সদস্যরা ঢাকা বা অন্য কোথাও থাকছেন। মামলা চলছে না কেন জানতে চাইলে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাদীদের অসহযোগিতার কারণে অনেক মামলাই আর চলেনি। তবে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, এ জন্য বাদীদের দোষ দেয়া যায় না। নানা কারণে তারা মামলা চালাতে চাননি। পুলিশেরও কিছু দায় ছিলো।

১৯৯৯ সালের মে মাসে শহর ছাত্রলীগের সভাপতি খোরশেদ আলম খুন হন। তিনি খান পরিবারের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু দরপত্র নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে খান পরিবারের সাথে বিরোধ তৈরি হয়। খোরশেদের মা মাজেদা বেগম বাদী হয়ে সাংসদসহ তিন ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা করেন। কিন্তু পুলিশ খান পরিবারের তিন ভাইয়ের নাম বাদ দিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। এর বিরুদ্ধে মাজেদা বেগম নারাজি জানালেও কোনো লাভ হয়নি।