আতঙ্কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আত্মঘাতী জঙ্গিদের আনা ২৪ বোমার হদিস নেই

 

সন্দেহপ্রবণ এলাকাগুলোতে চলছে চিরুণি তল্লাশি আত্মঘাতীদের ধরতে সতর্ক অভিযানের পরামর্শ অন্যত্র ঘাঁটি গড়লেও জঙ্গিদের মূল টার্গেট ঢাকা

স্টাফ রিপোর্টার: হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আত্মঘাতী হামলা চালানোর টার্গেট নিয়ে কয়েক জোড়া সুইসাইডাল ভেস্টসহ ৩০টি শক্তিশালী বোমা ঢাকায় মজুদ করেছিল জঙ্গিরা। এর মধ্যে র‌্যাব সদর দফতরের অস্থায়ী ব্যারাক এবং বিমানবন্দর সড়কে পুলিশের তল্লাশি চৌকির সামনে দুটি সুইসাইডাল ভেস্টের বিস্ফোরণ ঘটায় আত্মঘাতীরা। খিলগাঁওয়ের একটি চেকপোস্টে র‌্যাবের গুলিতে নিহত আত্মঘাতী যুবকের ব্যাগ থেকে উদ্ধার করা হয় আরও একটি সুইসাইডাল ভেস্টসহ তিনটি তাজা বোমা। সব মিলিয়ে ৬টি বোমার হিসেব পাওয়া গেলেও বাকি আরও ২৪টির কোনো হদিস নেই।

কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের একজন দায়িত্বশীল গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, গত ৭ মার্চ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চান্দিনার কুটুম্বপুর এলাকায় যাত্রীবাহী বাস থেকে নেমে পুলিশের ওপর অতর্কিত বোমা হামলা চালানোর সময় জনতার হাতে ধরা পড়া দুই জঙ্গির মধ্যে একজন ঢাকায় দু দফায় ৩০টি শক্তিশালী বোমা আনার কথা স্বীকার করেন। কখন, কোথায়, কীভাবে কার কাছে এসব বোমা পৌঁছে দেয়া হয় দুর্ধর্ষ ওই জঙ্গি তা-ও গোয়েন্দাদের জানান। তবে এসব বোমা দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আত্মঘাতী হামলা করার টার্গেট করার কথা জানাতে পারলেও ওই জঙ্গি সুনির্দিষ্টভাবে সেগুলো নাম বলতে পারেননি।

সিটিটিসি সূত্র জানায়, হদিস না পাওয়া ওই ২৪ বোমা নিয়ে তারা শুধু উদ্বিগ্নই নয়, রীতিমতো আতঙ্কেও রয়েছে। কেননা শক্তিশালী ওই বোমার সাথে সুইসাইডাল স্কোয়াডের একাধিক দুর্ধর্ষ সদস্য থাকাটাই স্বাভাবিক। তাই ঢাকার নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ সতর্কতার পাশাপাশি তল্লাশি অভিযান জোরদার করা হয়েছে। হদিসবিহীন বোমার খোঁজে অনেকটা নীরবে রাজধানীর সন্দেহভাজন এলাকাগুলো চষে ফেলার কথাও স্বীকার করেন সিটিটিসির একাধিক কর্মকর্তা।

গোয়েন্দাদের ধারণা, আত্মঘাতী দলের সদস্যরা এসব বোমা তাদের কাছে ভাগাভাগি করে সময় সুযোগের অপেক্ষা করছে। তাদের সবার কাছেই সুইসাইডাল ভেস্ট রয়েছে। তাই সাধারণ অভিযান চালিয়ে তাদের জীবিত অবস্থায় গ্রেফতার করা কঠিন হবে। কোনো ধরনের অসতর্ক অভিযান চালালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাঠপর্যায়ের সদস্যদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন গোয়েন্দারা। তাই হদিসবিহীন বোমার সন্ধানে সর্বোচ্চ সতর্ক অভিযান চালানোর বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা। তবে এ নিয়ে গোয়েন্দারা উদ্বেগ প্রকাশ করলেও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের ভাষ্য, ‘চান্দিনায় গ্রেপ্তারকৃত এক জঙ্গির কাছ থেকেই ঢাকায় ৩০টি বোমা আনার তথ্য পাওয়া গেছে। তার মানে এই নয় যে, জঙ্গি দলের আর কেউ কোনো বোমা ঢাকায় আনেনি। একাধিক আরও গ্রুপ ঢাকায় বোমা সরবরাহ করে থাকতে পারে। তবে এসব দিয়ে শুধু ঢাকাতেই হামলা চালানো হবে- এমনটি ভাবা ঠিক হবে না। ঢাকা থেকে ওইসব বোমা অন্য জেলাতেও পাঠানো হতে পারে। বেগতিক পরিস্থিতিতে জঙ্গিরা এসব বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয় করে ফেলারও সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এসব ব্যাপারে উদ্বিগ্ন না হয়ে বরং জঙ্গি দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তৎপর হওয়ার পরামর্শ দেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। জঙ্গিরা একের পর এক আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে বিশ্বব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি করলেও তাদের অবস্থান বর্তমানে ততটা দৃঢ় নয় বলে মনে করেন তারা।

এ ব্যাপারে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশীদ বলেন, জঙ্গিদের এই আত্মঘাতী হয়ে ওঠা এটাই প্রমাণ করে যে তারা কোণঠাসা অবস্থায় আছে। তারা এখন টিকে থাকার জন্য এই হামলা করছে। সারা বিশ্বে প্রচার পাওয়ার জন্য জঙ্গিরা র‌্যাব-পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে টার্গেট করেছে বলে মনে করেন এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখনও পাকিস্তান, সিরিয়া কিংবা আফগানিস্তানের মতো হয়ে যায়নি। কারণ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ সরকারের ওপর আছে, জঙ্গিদের নয়। তাই জঙ্গিদের সামপ্রতিক আত্মঘাতী হয়ে ওঠা উদ্বেগজনক হলেও এটা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান বলেন, বাংলাদেশে আত্মঘাতীর হামলার প্রবণতা আগেও ছিলো। বর্তমানে বাংলাদেশে জঙ্গিরা এখন কোণঠাসা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধাওয়ার কারণে জঙ্গিদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। তাই তারা সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আত্মঘাতী হামলা করছে। এসব হামলা এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হলেও আগামীতে তা বেসামরিক জনগণের দিকেও গড়াবে কিনা এ বিষয়ে জানতে চাইলে মারজান বলেন, এর জন্য সরকারকে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। আইএস ইসলামের ভুল ব্যাখা দিয়ে আসছে। এর বিরুদ্ধে দেশের ইমাম মাশায়েখদের নিয়ে কোরআনের ভালো আয়াতের ব্যাখ্যা করতে হবে। যেসব জঙ্গি দেশের বিভিন্ন কারাগারে বন্দি রয়েছে তাদের সাইকোলজিক্যাল কাউন্সিলিং দেয়া প্রয়োজন।

জঙ্গি সংগঠনগুলো যেন নতুন করে লোকবল সংগ্রহ করতে না পারে সে জন্য জনগণের মধ্যে জঙ্গিবিরোধী ব্যাপক প্রচার চালানোরও পরামর্শ দেন এই দুই বিশেষজ্ঞ। তারা বলেন, বাংলাদেশের মানুষ প্রাকৃতিকভাবে কঠোর প্রকৃতির নয়। ফলে উগ্রবাদ এখানে কখনও বিকশিত হয়নি। তাই তোড়জোড়ভাবে জঙ্গিবিরোধী প্রচারণা চালালে তারা কখনো বিকশিত হতে পারবে না। এদিকে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের গোয়েন্দারা জানান, নব্য জেএমবির উত্তরাঞ্চলীয় কমান্ডার রাজীব গান্ধীসহ সম্প্রতি সময়ে যেসব জঙ্গি নেতা ধরা পড়েছে, তাদের কাছ থেকে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। জঙ্গিরা তাদের কোণঠাসা অবস্থা কাটিয়ে সুসংগঠিত এবং শক্তিশালী হয়ে ওঠারও দাবি করেছে। তবে তাদের এসব তথ্য পর্যালোচনায় গোয়েন্দারা নিশ্চিত- সিলেট, মৌলভীবাজার, সীতাকুণ্ডু ও কুমিল্লাসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘাঁটি গড়ে তুললেও তাদের আত্মঘাতী হামলার মূল টার্গেট ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ কোনো স্থাপনা। তবে রাজধানীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সবসময় তৎপর থাকায় জঙ্গিরা সেখানে আত্মগোপন করতে নিরাপদবোধ করছে না। তাই বিগত সময়ের মতো ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ঘাঁটি না গড়ে তারা জেলা শহর কিংবা বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল বেছে নিয়েছে। সেখানে বসেই তারা ঢাকায় আত্মঘাতী হামলার ছক করছে। মিশনের অল্প কয়েকদিন আগে তারা খালি হাতে ঢাকায় পৌঁছে টার্গেটকৃত এলাকায় অবস্থান করছে। এ সময় অন্য সদস্যরা তাদের কাছে সুইসাইডাল ভেস্টসহ হাতে নিক্ষেপযোগ্য শক্তিশালী গ্রেনেড ও বোমা পৌঁছে দিচ্ছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, হদিসবিহীন ওই ২৪ বোমা যেকোনো সময় ঢাকার যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিস্ফোরিত হতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করছে। এ কারণেই সন্ত্রাসী কোনো গোষ্ঠীর হামলার হুমকি না থাকলেও এবারের নববর্ষের অনুষ্ঠানে রাজধানীতে নজিরবিহীন নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। বিশেষ করে যেসব কর্মসূচিতে অতিরিক্ত লোকসমাগম ঘটবে সেখানে তিন থেকে পাঁচস্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনি তৈরির নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গোয়েন্দা ওই কর্মকর্তা জানান, আত্মঘাতী জঙ্গিদের সামনে সত্যিকার অর্থেই তারা অনেকটা অসহায়। কেননা, স্ত্রী-সন্তান, পরিবার-পরিজন এমনকি নিজের জীবনের প্রতি মায়া না থাকায় তারা যে কোনো মুহূর্তে সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিতে পারে। যা সামাল দেয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী যেকোনো বাহিনীর পক্ষেও অসম্ভব।

এদিকে আত্মঘাতী জঙ্গিদের আগেভাগে চিহ্নিত করে তাদের গ্রেফতার করতে না পারার ব্যর্থতা গোয়েন্দারা অনেকটা নিঃসংকোচেই স্বীকার করেন। তারা জানান, আত্মঘাতী জঙ্গিদের অধিকাংশেরই বিগত সময়ে বড় ধরনের কোনো সন্ত্রাসী কিংবা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার রেকর্ড নেই। এমনকি নারী আত্মঘাতীদের প্রায় সবাই সাধারণ পরিবারের শান্তিপ্রিয় গৃহবধূ। তাই তাদের আকস্মিক ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার তথ্য কেউই কখনো আন্দাজ করতে পারেনি।

অন্যদিকে সুইসাইডাল স্কোয়াডের জঙ্গিরা আত্মঘাতী হওয়ার পর ভয়াবহ বিস্ফোরণে তাদের শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ায় এসব লাশ শনাক্ত করাও কঠিন। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাদের পরিচয়ের সূত্র ধরে দলের অন্যদের চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। ক্রাইম সিন ও বোম ডিস্পোজল টিমের একাধিক কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি যেসব জঙ্গি দলবদ্ধ হয়ে আত্মঘাতী হয়েছে তাদের পরিচয় শনাক্ত করা দূরে থাক, অধিকাংশ সময় তাদের সংখ্যা নিরূপণ করাও কঠিন হয়ে পড়ে। বেশ কয়েকটি ঘটনায় আত্মঘাতীদের ছিন্নভিন্ন হওয়া হাতে ও পায়ের জোড়া মিলিয়েও নিহতদের সংখ্যা নির্ণয় করা হয়েছে বলেও স্বীকার করেন তারা।