আটকানো গেল না গণিত পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসও

দেড় ঘণ্টা আগে প্রশ্ন ফেসবুকে : দেশের বিভিন্ন স্থানে গ্রেফতার ২১
স্টাফ রিপোর্টার: চলতি এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ গতকাল শনিবার অনুষ্ঠিত গণিত বিষয়ের প্রশ্নপত্রও পরীক্ষা শুরুর প্রায় দেড় ঘণ্টা আগে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলে আসে। অনলাইনে তা দেশের বিভিন্ন স্থানেও ছড়িয়ে পড়ে। পরীক্ষার আগে ফাঁস হওয়া ওই প্রশ্নসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ২১ জন গ্রেফতার হয়েছে। এ নিয়ে গত ৭ দিনে মোট ৩০ জনকে গ্রেফতার করা হলো। এছাড়া পরীক্ষার হলে ঢুকে প্রশ্ন সংগ্রহ ও প্রশ্নের উত্তর তৈরির অপকর্মে জড়িত থাকার দায়ে কয়েকজন শিক্ষককে পরীক্ষার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে নকলের মহোৎসব। দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেকটাই ফ্রি স্টাইলে চলছে এ অপকর্ম। বিশেষ করে উপজেলা সদরের বাইরে স্থাপিত কেন্দ্রগুলোতে নকলের অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। ওইসব কেন্দ্রে একশ্রেণির অসাধু শিক্ষক প্রশ্নের উত্তর লিখে সরবরাহ করেছেন। অনেক স্থানেই প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা বিষয়টি জেনেও নিশ্চুপ ছিলেন বলে অভিযোগ আছে। বরিশালের আগৈলঝাড়ায় তিন ঘণ্টার পরীক্ষা চার ঘণ্টা ধরে নেয়ার খবর পাওয়া গেছে। চট্টগ্রামের চন্দনাইশে গণিতের পরিবর্তে কৃষিশিক্ষা প্রশ্ন সরবরাহ করা হয়। শিক্ষার্থীরা বিষয়টি জানানোর পর কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। এই ফাঁকে চলে যায় দেড় ঘণ্টা। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে এসএসসি পরীক্ষার গণিত প্রশ্নে নানা ভুল ধরা পড়েছে। তবে ব্যতিক্রমী খবরও পাওয়া গেছে। নকলের সুযোগ না দেয়ায় কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার যাদুরচর উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভাঙচুর চালিয়েছে পরীক্ষার্থীরা। এ সময় রৌমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দীপঙ্কর রায় ওই কেন্দ্রে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। পরীক্ষার্থীরা ইউএনওর গাড়িও ভাঙচুর করে।
এদিকে বাংলা প্রথম ও দ্বিতীয়পত্রের প্রশ্নফাঁসের পর অভিযোগ তদন্তসহ সার্বিক বিষয়ে সুপারিশের জন্য ৪ ফেব্রুয়ারি একজন সচিবের নেতৃত্বে কমিটি গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়। কাজ শুরু তো দূরের কথা, ছয় দিনে তদন্ত কমিটি গঠনের আদেশই জারি হয়নি। ফলে কার্যপরিধি না জানায় কমিটি কাজও শুরু করতে পারেনি। নাম প্রকাশ না করে কমিটির একজন সিনিয়র সদস্য সাংবাদিকদের বলেন, কমিটি গঠনের আদেশ, কমিটির কার্যপরিধি ইত্যাদি ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা শনিবার পর্যন্ত পাননি তারা। যে কারণে কাজ শুরু করা যায়নি। আরেকজন সদস্যও একই কথা জানান। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ তদন্ত ও তথ্য উদঘাটনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা।
শিক্ষামন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী প্রশ্নফাঁস বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওই কমিটির আহ্বায়ক একই মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগের সচিব মো. আলমগীর। তিনি শনিবার বলেন, ‘প্রশ্নফাঁসের বিষয়ে কমিটির আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়নি। তবে আমরা এ নিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।’ কমিটি সংক্রান্ত কোনো অফিস আদেশ হয়েছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে তিনি বলেন, ‘সার্বিক দিকে আমাদের সতর্ক নজরদারি আছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন গ্রুপসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সব বিভাগ কাজ করছে। অচিরেই আপনারা দৃশ্যমান অগ্রগতি পাবেন।’ কমিটির আরেক সদস্য ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার বলেন, ‘মিটিং না হলেও আমরা কমিটির সদস্যরা যার যার অবস্থানে কাজ করে যাচ্ছি। শিগগিরই এ নিয়ে বৈঠক হবে।’
গণিত প্রশ্নও ফাঁস: গতকাল শনিবার সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটের পর ফেসবুকের কয়েকটি গ্রুপ, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন সাইটে এসএসসির কথিত গণিত প্রশ্ন তুলে দেয়া হয়। এর মধ্যে ফেসবুকের একটি গ্রুপে দেয়া হয় গণিতের বহুনির্বাচনী ‘চাঁপা’ নামের ‘খ’ সেট প্রশ্নপত্রের উত্তরসহ ছবি। গণমাধ্যম কর্মীদের ওই খবর পেতে অবশ্য ২০-২৫ মিনিট সময় লাগে। অনেকেই ৯টার মধ্যে সেই প্রশ্নপত্র পেয়ে যান। পরীক্ষার পর মূল প্রশ্নপত্রের সঙ্গে আগে পাওয়া প্রশ্নের মিল পাওয়া গেছে।
ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার বলেন, ‘এ রকম অভিযোগ আমরাও শুনি। কিন্তু অনেক সময়েই তো মিল পাওয়া যায় না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দেখি কী করা যায়। টেকনিক্যাল পারসনরা এ নিয়ে কাজ করছেন। সচিব স্যার আপনাদের এ নিয়ে ব্রিফ করবেন। তার কাছে জানতে পারবেন।’ তবে কবে নাগাদ ও কী ব্রিফিং করা হবে, একাধিকবার জানতে চেয়েও তার জবাব পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগের সচিব এবং প্রশ্নফাঁস সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক মো. আলমগীর বলেন, ‘কারিগরি বা মাদরাসা বিভাগের ব্যাপারে আমি দায়িত্বপ্রাপ্ত। এ ব্যাপারটি ছাড়া অন্য বিষয়ে আমি কথা বলতে পারি না। যদি দাখিল বা এসএসসি ভোকেশনাল প্রশ্নের বিষয় থাকে তাহলে সেটা আমার কাছে জানতে চাইতে পারেন। অন্য বিষয়ে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই।’
এদিকে প্রশ্নফাঁসের ক্ষেত্রে যুক্ত হয়েছে নতুন পন্থা। এতোদিন ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্নফাঁস হচ্ছিলো। গতকাল শনিবার স্থানীয় পর্যায়েও প্রশ্নফাঁস বা ফাঁসের চেষ্টার তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া একশ্রেণির শিক্ষক নকল সরবরাহ বিশেষ করে বাইরে লেখা উত্তরপত্র কেন্দ্রে সরবরাহের মতো অপকর্ম করছেন। আবার কোথাও ধরা পড়ার পর ব্যবস্থা না নেয়ার মতো ঘটনা আছে। তবে শনিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এসব ঘটনায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবস্থা নেয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ঠাকুরগাঁও, রংপুরের পীরগঞ্জ, গাজীপুরের শ্রীপুর, যশোর, শেরপুর, দিনাজপুরের চিরিরবন্দর, রাজশাহীসহ কয়েকটি এলাকা থেকে ২১ জনকে গ্রেফতারের খবর পাওয়া গেছে। নড়াইলে একজনকে ধরে জরিমানা অনাদায়ে ৭ দিনের কারাদ- দেয়া হয়। মাদারীপুরের টেকেরহাটে ২ শিক্ষককে পরীক্ষার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। নাটোরের বাগাতিপাড়ায় এক পরীক্ষার্থীর বাবা-মাকে ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। যশোর ব্যুরো জানায়, পরীক্ষা শুরুর আগে মোবাইলফোনে এসএসসির গণিত প্রশ্ন দেখানোর সময় মনিরুজ্জামান নামে এক যুবককে আটক করেছে পুলিশ। গতকাল শনিবার সকাল ৯টার দিকে যশোর জিলা স্কুল প্রাঙ্গণ থেকে অভিভাবকদের সহায়তায় তাকে আটক করা হয়।