আখেরি মোনাজাতে শেষ বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব : বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর শান্তি সংহতি কামনা

 

স্টাফ রিপোর্টার: ইহকালে শান্তি ও পরকালের মাগফিরাত এবং বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর সুখ-শান্তি কল্যাণ, সমৃদ্ধি এবং বিশ্ব শান্তি ও মুসলিম ঐক্য কামনা করে আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে সম্পন্ন হলো বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। মোনাজাত পরিচালনা করেন তবলিগ জামাতের দিল্লির মারকাজের শূরা সদস্য, ইসলামি চিন্তাবিদ, বিশ্ব মাওলানা সাদ কান্ধলভী। গত বছরেও প্রথম পর্বে তিনিই মোনাজাত পরিচালনা করেন। এ মোনাজাতে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বঙ্গভবনে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে স্বজনদের নিয়ে আখেরি মোনাজাতে শরিক হন। বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ তার গুলশানের বাসায় এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন গুলশানের বাসভবন ‘ফিরোজায়’ বসে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন। টঙ্গীর তুরাগতীরে গতকাল রোববার বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাত শুরু হয় বেলা ১১টায়। আর শেষ হয় ১১টা ৩৫ মিনিটে। ৩৫ মিনিটের মোনাজাতে মহান আল্লাহর দরবারে দুই হাত তুলে কেঁদে কেঁদে ক্ষমা চেয়েছেন মুসল্লিরা। কামনা করেছেন দেশ-জাতি-মানবতার কল্যাণ ও সমৃদ্ধি এবং মুসলিম উম্মাহর শান্তি।

তবলিগ জামাতের মারকাজের শূরা সদস্য মাওলানা মুহাম্মদ সাদ আরবি ও উর্দু ভাষায় মোনাজাত করেন। তার সাথে লাখ লাখ মুসল্লি দুই হাত তুলে আমিন, আমিন ধ্বনি তোলেন। বিশ্ব ইজতেমার ময়দান ও আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে লাগানো মাইকে সেই ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে। সকাল ১০টা থেকেই ইজতেমা ময়দান ও আশপাশের এলাকায় পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। থেমে থেমে এই নীরবতা ভঙ্গ করে লাখ লাখ মুসল্লির আমিন, সুম্মা আমিন, আল্লাহুম্মা আমিন ধ্বনিতে মুখরিত প্রকম্পিত হয়ে ওঠে ইজতেমা ময়দান। মাওলানা সাদ মোনাজাতে স্রষ্টার কাছে সবার অতীতের ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং সব বিপদ-আপদ থেকে রক্ষার জন্য আর্জি জানান। এ সময় মহান আল্লাহ পাকের অশেষ মহিমায় আবেগাপ্লুত হন লাখো মুসল্লি। অশ্রুসিক্ত নয়নে হাত তোলেন তারা।  এ সময় কারও দুই চোখ ছিল মুদিত, কারও দৃষ্টি ছিল সুদূরে প্রসারিত। আর থরথর কম্পোনে দুই ঠোঁটে মৃদু স্বরে উচ্চারিত হয়েছে আমিন আমিন ধ্বনি। জীবনের সব পাপ-তাপ থেকে মুক্তির জন্য, পরম দয়াময় আল্লাহর দরবারে অনুনয়-বিনয় করে পানাহভিক্ষা চান তারা। ভোর থেকেই মোনাজাতে অংশ নিতে টঙ্গীর তুরাগ তীরে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের ঢল নামে। ফজরের নামাজের পরই টঙ্গী শহর, ইজতেমাস্থল ও এর আশপাশ এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ও আবদুল্লাহপুর-আশুলিয়া সড়কের চার-পাঁচ কিলোমিটার এলাকা পরিণত হয় জনসমুদ্রে।
ভোর থেকেই ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের চান্দনা চৌরাস্তা থেকে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। আখেরি মোনাজাতের জন্য টঙ্গীর আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানাসহ অনেক অফিসে দেয়া হয় ছুটি।

এবার আল্লাহুম্মা আমিন ধ্বনি উচ্চারিত হয় দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতেও। স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলগুলো বিশ্ব ইজতেমার এ বিশেষ মোনাজাত সরাসরি সম্প্রচার করায় বাসা-বাড়ি, দোকান, অফিস, আদালত যে যেখান থেকে পেরেছেন দেশ-বিদেশের মুসলমানরা মোনাজাতে শরিক হন। পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও মোনাজাতে অংশ নেন। নারীরা ইজতেমা প্যান্ডেলের বাইরে অবস্থান নেন।

ভোগান্তি: মোনাজাত শেষে বাড়ি ফেরা নিয়ে ভোগান্তিতে পড়েন মুসল্লিরা। পাবলিক পরিবহন বন্ধ থাকায় দূর-দূরান্তের মুসল্লিরা ইজতেমার প্যান্ডেল থেকে বের হয়ে সড়ক মহাসড়কের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। এদিকে বিকল্প হিসেবে ট্রেন বেছে নিয়েও ভিড়ের কারণে ট্রেনে উঠতে পারেননি বেশিরভাগ মুসল্লি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্রেন ও বাসস্টেশন গুলোতে অপেক্ষা করেও নিজ গন্তব্যে পৌঁছুতে বিড়ম্বনা আর ভোগান্তি বাড়ছে। অপর দিকে দু-একটি বাস বা ট্রাক পেলেও ভাড়া বেশি নেয়ার অভিযোগ রয়েছে।

তাশকিল কামরা: ইজতেমা ময়দানের উত্তর প্রান্তে করা হয়েছে তাশকিলের কামরা। ময়দানের খিত্তাগুলো থেকে চিল্লায় নাম লেখানো ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের জামাতবন্দি করে তাশকিলের কামরায় জায়গা করে দেয়া হয়েছে। আখেরি মোনাজাত শেষে এসব মুসল্লি জামাতবন্দি হয়ে ঢাকার কাকরাইল মসজিদে গিয়ে রিপোর্ট করে তবলিগের মুরুব্বিদের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী জামাতবন্দি হয়ে দীনের দাওয়াতি মেহনতে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বেন। এসব জামাত বন্দিদের মধ্যে ৪০ দিন, ৩ মাস, ৬ মাস, ১ বছর ও আজীবন চিল্লাধারী মুসল্লিরা রয়েছেন। তারা বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা শহর এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে দাওয়াতি কাজ করবেন।

আট মুসল্লির মৃত্যু: এবারের বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে এসে আরো এক মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে তিন দিনে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৮ জনে দাঁড়িয়েছে। মাসলাহাল জামাতের আমির আদম আলী জানান, শনিবার সন্ধ্যায় ইজতেমা ময়দানে আরো এক মুসল্লি মারা গেছেন। মৃতের নাম বেদন মিয়া (৬৫)। তার বাড়ি ঢাকার সবুজবাগের কদমতলা এলাকায়। শীত ও বার্ধক্যজনিত কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। চার দিন বিরতি দিয়ে আগামী শুক্রবার শুরু হবে এবারের বিশ্ব ইজতেমার শেষ পর্ব। রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হবে এবারের বিশ্ব ইজতেমা। ইজতেমার দ্বিতীয় ধাপে যেসব জেলা খিত্তা ওয়ারি অবস্থান করবেন সে জেলাগুলো হলো- ঢাকা জেলার (খিত্তা নং-১, ২, ৩, ৪, ৫ ও ৭), মেহেরপুর জেলা (খিত্তা নং-৬), লালমনিরহাট জেলা (খিত্তা নং-৮), রাজবাড়ি (খিত্তা নং-৯), দিনাজপুর (খিত্তা নং-১০), হবিগঞ্জ (খিত্তা নং-১১), মুন্সীগঞ্জ (খিত্তা নং-১২, ১৩), কিশোরগঞ্জ (খিত্তা নং-১৪, ১৫), কক্সবাজার (খিত্তা নং-১৬), নোয়াখালী (খিত্তা নং-১৭, ১৮), বাগেরহাট (খিত্তা নং-১৯), চাঁদপুর (খিত্তা নং-২০), পাবনা (খিত্তা নং-২১, ২২), নওগাঁ (খিত্তা নং-২৩), কুষ্টিয়া (খিত্তা নং-২৪), বরগুনা (খিত্তা নং-২৫) ও বরিশাল জেলার (খিত্তা নং-২৬) মুসল্লিরা অংশ নেবেন। তবে ঢাকা জেলার মুসল্লিরা ইজতেমার দুই পর্বেই অংশ নেবেন। মুসল্লিদের সুবিধার্থে ময়দানের উত্তর দিক থেকে ক্রমানুসারে দক্ষিণ দিকে খিত্তার নম্বর বসানো হয়েছে।