আইন লঙ্ঘন করে ফোনালাপ প্রচার

স্টাফ রিপোর্টার: প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর টেলি সংলাপ প্রকাশ নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনার ঝড় উঠেছে। সংবিধান ও তথ্য প্রযুক্তি আইন লঙ্ঘন করে দু নেত্রীর কথোপকথন রেকর্ড এবং তা গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। আইন, সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং বিশিষ্ট নাগরিকরা দু নেত্রীর সংলাপ প্রকাশের ঘটনাকে শিষ্টাচার বহির্ভূত বলে অভিহিত করেছেন। এ নিয়ে দোষারোপের রাজনীতিও শুরু হয়েছে।

তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু দাবি করেছেন, যে টেলিকথোপকথন গণমাধ্যমে এসেছে, তা সরকার প্রকাশ করেনি। যারা প্রকাশ করেছেন, তারাই বলতে পারবেন- কার কাছ থেকে এটি নিয়েছেন। অন্যদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, এটি সম্পূর্ণ শিষ্টাচার বর্জিত ও রাজনৈতিক অসত উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। সরকার জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এ কথোপকথন গণমাধ্যমে সম্প্রচার করেছে। বিশিষ্ট আইন বিশেষজ্ঞ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ল’র পরিচালক ড. শাহদীন মালিক বলেন, রাষ্ট্রের দুজন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির টেলিফোন সংলাপ যারা রেকর্ড করেছেন, তারা বেআইনি কাজ করেছেন। সরকারের উচিত হবে, কারা সেটি রেকর্ড করেছেন এবং গণমাধ্যমে প্রকাশে সহায়তা করেছেন- তা খুঁজে বের করা। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম বলেন, যারা রাজনীতিতে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছে, ফোনালাপ প্রকাশ তারাই করেছে। গত শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া নিজ নিজ বাসভবন থেকে টেলিফোনে কথা বলেন। দু নেত্রীর টেলিসংলাপ গত সোমবার গভীর রাতে সর্বপ্রথম ৭১ টিভি সম্প্রচার করে। গতকাল মঙ্গলবার প্রায় সব ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও অনলাইন সংবাদপত্রে এ টেলিসংলাপ প্রকাশ করে।  সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদে যোগাযোগের গোপনীয়তা রক্ষার নির্দেশনা রয়েছে। ওই অনুচ্ছেদের (খ) উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রত্যেক নাগরিকের চিঠি-পত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকিবে। এ প্রসঙ্গে ড. শাহদীন মালিক বলেন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা হুমকির আশঙ্কা হলে সরকার আদেশ দিয়ে কারো টেলিযোগাযোগ বা পত্র যোগাযোগ রেকর্ড করতে পারে। কিন্তু পাগলও বোঝে, দু নেত্রীর এ টেলিসংলাপ রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকি নয়। তিনি বলেন, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির এ টেলিসংলাপ কারা রেকর্ড করেছে তা সরকারের উচিত হবে অবিলম্বে তদন্ত করে খুঁজে বের করা।

আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এক্ষেত্রে দুটি অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। প্রথমত হচ্ছে- নাগরিকের গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন করে তা রেকর্ড করা এবং দ্বিতীয়ত হচ্ছে- তথ্য প্রযুক্তি আইন ২০০৬-এর ৬৩ (১) ধারা অমান্য করে তা প্রকাশ করা। ওই ধারায় বলা আছে, এ আইন বা আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে ভিন্নরূপ কোনো কিছু না থাকিলে, কোনো ব্যক্তি যদি এ আইন বা তদধীন প্রণীত বিধি বা প্রবিধানের কোনো বিধানের অধীন কোনো ইলেক্ট্রনিক রেকর্ড, বই, রেজিস্টার, পত্রযোগাযোগ, তথ্য, দলিল বা অন্য কোনো বিষয়বস্তুতে প্রবেশাধিকারপ্রাপ্ত হইয়া, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সম্মতি ব্যতিরেকে, কোনো ইলেক্ট্রনিক রেকর্ড, বই, রেজিস্টার, পত্রযোগাযোগ, তথ্য, দলিল বা অন্য কোনো বিষয়বস্তু অন্য কোনো ব্যক্তির নিকট প্রকাশ করেন, তাহা হইলে তাহার এ কার্য হইবে একটি অপরাধ? এখানে স্পষ্ট করেই উল্লেখ রয়েছে, তথ্য বা অন্য কোনো বিষয়বস্তু অন্য কোনো ব্যক্তির নিকট প্রকাশ করা দণ্ডনীয় অপরাধ। চলতি বছর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে সংশোধনী এনে এর অপরাধসমূহকে আমলযোগ্য ও জামিন অযোগ্য করা হয়েছে। শাস্তির মেয়াদ করা হয়েছে ৭ থেকে ১৪ বছর।

প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে বিরোধীদলীয় নেত্রীকে ফোন করেন। বিরোধীদলীয় নেত্রী ওই সময় তার গুলশানের বাসভবনে ছিলেন। তাদের মধ্যে কথা হয়েছে মোবাইল ফোনে। প্রায় ৩৭ মিনিট তারা কথা বলেন। টেলিফোন সংলাপ প্রকাশ করা নিয়ে দু পক্ষই পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছে। তথ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন সরকার এটি প্রকাশ করেনি। অন্যদিকে বিরোধী দল থেকে এ ঘটনার জন্য সরকারকে দায়ী করা হচ্ছে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, প্রথম দিন গণমাধ্যমে শুধু প্রধানমন্ত্রীর কথোপকথনের দৃশ্যই দেখানো হয়েছিলো। বিরোধীদলীয় নেত্রীর কোনো সংলাপ কেউ দেখাতে পারেনি। এ থেকেই বোঝা যায় সরকার এটি করেছে। তিনি বলেন, সরকার জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এটি গণমাধ্যমে সম্প্রচার করিয়েছে।

টেলিসংলাপ প্রকাশ এবং রেকর্ড করা নিয়ে নাগরিক সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, দু নেত্রীর আলাপের আংশিক নয়, পরিপূর্ণ রেকর্ড প্রকাশ হয়েছি কি-না তা দেখতে হবে। এতে কোনো বিকৃতি বা ত্রুটি আছে কি-না তা দেখতে হবে। তিনি বলেন, প্রকাশিত রেকর্ডে দু নেত্রীর আলাপনে সংলাপ হওয়ার মতো বা সমঝোতা হওয়ার কোনো আশা নেই। সরকার নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, বিএনপি তা ঠেকাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দু নেত্রীর মধ্যে আর সংলাপ হবে বলে মনে হয় না। এটি জনগণকে বোঝাবার চেষ্টা। সংঘাতের দিকেই এগোচ্ছে দেশ।  ড. শাহদীন মালিক বলেন, যিনিই এটি করুন না কেন আপাতত দৃষ্টিতে এটি আইনসিদ্ধ হয়নি। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যদি সেটি রেকর্ড করতে হয় তাহলে সরকারের প্রশাসনিক নির্দেশ লাগবে। সরকার সেই নির্দেশ দিয়েছে বলে আমি মনে করি না। ফলে যারাই সেটি করুন না কেন আইনগত কর্তৃত্ব নিয়ে তারা করেননি। মনে হচ্ছে দু নেত্রীকে রাজনৈতিক কারণে হেয় করার জন্য এটি করা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম বলেন, দু নেত্রীর ফোন-সংলাপ প্রকাশ করার ঘটনায় বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরো তিক্ত ও বিষাক্ত করেছে। এতে পরস্পরের দোষারোপের খেলা বাড়বে। এভাবে দু পক্ষের অনুমতি না নিয়ে এটি প্রকাশ করা বড় রকমের অনৈতিকতা, বিব্রতকরও। তিনি বলেন, ফোনালাপের রেকর্ড যেই প্রকাশ করুক এবং যে রেকর্ড করেছে দু পক্ষকেই শনাক্ত করা প্রয়োজন। আইন অনুযায়ী বিচারও করা যেতে পারে। কেননা এটি সাধারণের (পাবলিকলি) মধ্যে প্রকাশ করে যারা মজা পেতে চাচ্ছেন, তারা মজা পাচ্ছেন ও নিচ্ছেন। এমনিতেই আমরা অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি। ফোনালাপের প্রকাশ তারাই করেছে, যারা রাজনীতিতে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি করতে চাইছে।