অস্ত্র বিহারের : টাকা আসে দুবাই থেকে

 

স্টাফ রিপোর্টার: ভারতের বিহার রাজ্যের মুঙ্গের শহরের একটি অস্ত্র তৈরির কারখানায় তৈরি হয়েছে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি রেস্টুরেন্টে জঙ্গিদের ব্যবহৃত একে-২২ রাইফেল। একই অস্ত্র পরে অন্য জঙ্গি আস্তানায়ও পাওয়া গেছে। সবকটি একে-২২ রাইফেল একই কারখানার বলেই ধারণা করছেন তদন্তকারীরা। একটি রাইফেলে বিহারের ওই কারখানার সিলও রয়েছে। তদন্তকারীরা নিশ্চিত হয়েছেন বিহার থেকে এসব অস্ত্র চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে এজেন্টের কাছে পৌঁছানো হয়। তিনিই সীমান্ত পার করে জঙ্গিদের হাতে পৌঁছে দেন। আর দুটি পিস্তল ইউরোপ থেকে নেপাল হয়ে সড়কপথে বাংলাদেশে ঢুকেছে।

তদন্তকারী একটি সূত্র জানিয়েছে, অর্থের উত্স খুঁজতে গিয়ে তারা এক পাকিস্তানি নাগরিকের সম্পৃক্ততা পেয়েছেন। তিনি বর্তমানে দুবাই অবস্থান করছেন। কতো টাকা, কার মাধ্যমে পাঠিয়েছেন তা এখনো নিশ্চিত করেননি তদন্তকারীরা। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘টাকার বিষয়ে তদন্ত চলছে। তবে আমরা একটা রুট খুঁজে পেয়েছি। সেটা মধ্যপ্রাচ্য।’

মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে যে অস্ত্র জঙ্গিরা ব্যবহার করেছে সেই একই অস্ত্র পাওয়া গেছে নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ার আস্তানায়। এটা একে-২২ রাইফেল। গুলশান থেকে উদ্ধার করা তিনটি অস্ত্রের মধ্যে একটির গায়ে বিহারের মুঙ্গের শহরের একটি ফ্যাক্টরির সিল রয়েছে। অন্যগুলো একই অস্ত্র হওয়ায় আমরা ধারণা করছি বিহার থেকে একে-২২ রাইফেলগুলো এসেছে।’ কিভাবে অস্ত্রগুলো দেশে ঢুকল এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তদন্ত করে আমরা জানতে পেরেছি, বিহার থেকে ওদের লোকের মাধ্যমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে পাঠানো হয়। সীমান্তের ওপারে জঙ্গিদের লোক রয়েছে। তারাই অস্ত্রগুলো রিসিভ করে। পরে সেখান থেকে সীমান্ত পার করে জঙ্গিদের হাতে পৌঁছে দেয় তাদের নেটওয়ার্কের লোকজনই।’

তদন্তকারী একটি সূত্র জানিয়েছে, অস্ত্র ও টাকার উত্স দুটিরই রুট খুঁজে পেয়েছে পুলিশ। এই নেটওয়ার্কের বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতারের জন্য খোঁজা হচ্ছে। এই নেটওয়ার্কের দু’একজন অচিরেই গ্রেফতার হবে এমন আশা তদন্তকারীদের। তারা বলছেন, তামিম আহমেদ চৌধুরী অভিযানে মারা গেছে। এখন টার্গেট বরখাস্ত মেজর জিয়া ও নুরুল ইসলাম মারজান। এই দুজন ধরা পড়লে জঙ্গিদের নেটওয়ার্ক ভেঙে যাবে। যদিও এখনই তাদের নেটওয়ার্ক খুব একটা সচল নেই। বিচ্ছিন্ন হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে তাদের অনেক সদস্য।

নিহত দুজনের পরিচয় মিলেছে, একজন অজ্ঞাত: এদিকে নারায়ণগঞ্জের আস্তানায় নিহত তিন জনের মধ্যে দুজনের পরিচয় নিশ্চিত করেছে পুলিশ। এদের একজন তামিম আহমেদ চৌধুরী ও অপরজন যশোরের কাজী হাবিবুল্লাহর ছেলে কাজী ফজলে রাব্বি। নিহত অপর ব্যক্তি প্রসঙ্গে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার ছানোয়ার হোসেন বলেন, ধারণা করা হচ্ছে নিহত ওই ব্যক্তি ধানমন্ডির তাওসিফ। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য নেয়া আঙ্গুলের ছাপের সঙ্গে তার আঙ্গুলের ছাপ মেলেনি। এমনকি কোনো স্বজনের পক্ষ থেকেও পরিচয় নিশ্চিত করা হয়নি।

মালয়েশিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাওসিফ ছুটিতে মাঝে মাঝে দেশে আসতো। এবছর এমনই এক ছুটিতে দেশে ফিরে ৩ ফেব্রুয়ারি বাইরে নাস্তা করার কথা বলে ধানমণ্ডির বাসা থেকে বের হয়ে যায় তাওসিফ। তারপর থেকেই সে নিখোঁজ রয়েছে। ধানমণ্ডির ১৫ নম্বর সড়কের ১৯/২ নম্বরের বাসাটিতে গত ৬ বছর ধরে কাজ করেন গার্ড নান্নু মিয়া। তার গ্রামের বাড়ি বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ। ওই বাড়ির কেয়ারটেকার মো. শহীদ বলেন, ‘ওইদিন বিকালে তাওসিফ বাইরে নাস্তা করার কথা বলে বাসা থেকে বের হয়। সন্ধ্যার পরও সে ফিরে না আসায় তার বাবা আজমল সাহেব ইন্টারকমে ফোন দিয়ে গার্ড নান্নু মিয়ার সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু সে আর ফেরেনি।’

তিনজনেরই মাথায় গুলি লেগেছে: নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের ঘটনায় নিহত তিন জঙ্গিই মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন ময়নাতদন্তকারী চিকিত্সক। তিনজনের ময়নাতদন্ত শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ গতকাল বলেন, ‘তিন জনেরই মাথায় গুলির চিহ্ন রয়েছে। তিনজনই আমাদের কাছে অজ্ঞাতপরিচয়। তবে মিডিয়াতে যাকে তামিম বলা হচ্ছে, তার মাথায় একটি গুলি পেয়েছি। বাকি দু’জনের মাথায় গুলি লেগে বের হয়ে গেছে। তাদের হাতে বোমার স্পিন্টারের আঘাতও রয়েছে। গুলিতেই তাদের মৃত্যু হয়েছে।’

অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম নিশ্চিত করেন, ‘তামিমের মাথায় যে গুলিটি লেগেছে সেটি স্নাইপার রাইফলের। পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে স্নাইপার রাইফেল দিয়ে গুলি করে অভিযানকারী সোয়াত টিমের সদস্যরা। তামিমকে টার্গেট করেই গুলি ছোড়া হয়েছিলো। এবং একটি গুলি তামিমের মাথায় লাগার পর সে পড়ে যায়।’

গুলশান-শোলাকিয়া হামলায় জড়িত আরও আটজন শনাক্ত: গুলশান-শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার ঘটনায় মাস্টারমাইন্ড জিয়া, নিহত তামিম ও মারজান ছাড়াও বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত আরও আটজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা জানান অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, কল্যাণপুরে নিহত নয় জঙ্গির মধ্যে চারজন এবং শনিবার নারায়ণগঞ্জে অভিযানে নিহত তামিম ছিলেন নব্য জেএমবি’র গুরুত্বপূর্ণ নেতা। নব্য জেএমবিকে দমন করার কথাও বলেন তিনি। জঙ্গি মারজান সম্পর্কে তিনি বলেন, জঙ্গি মারজান খুব মেধাবী, ইংরেজি ও আরবি ভাষায় পারদর্শী। নিহত জঙ্গি তামিমের পক্ষ হয়ে তিনি বাইরে থেকে নতুন সদস্যদের ব্রেনওয়াশ করতেন। নারায়ণগঞ্জের যে আস্তানায় অভিযান হয়েছে তার আশপাশের লোকজন পুলিশকে জানিয়েছে, জঙ্গিদের ওই ফ্লাটে ইংরেজিতে কোরআন শরীফ পড়া হতো। এর মধ্যে একজন খুব একটা ভালো বাংলা বলতে পারত না। সে সব সময় ইংরেজিতে কথা বলত।

নারায়ণগঞ্জে দুটি মামলা, বাড়ির মালিক গ্রেফতার: আমাদের নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গত শনিবার নারায়ণগঞ্জের দেওয়ান বাড়ির জঙ্গি আস্তানায় অপারেশন হিট স্ট্রং-২৭ এর অভিযানের ঘটনায় কয়েকজনকে আসামি করে গতকাল রোববার দুপুরে সন্ত্রাস দমন আইনে নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছেন। মামলার বিবরণে নিহত তিনজনসহ অজ্ঞাতনামা আরও আট-দশজনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। জব্দকৃত অস্ত্র ও মালামালের বিবরনও সেখানে আছে। অপরদিকে তথ্য গোপনের অভিযোগে সদর থানায় পুলিশ বাদী হয়ে বাড়ির মালিক নুরুদ্দিন দেওয়ানকে আসামি করে আরও একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।