অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে নতুন ইতিহাস টাইগারদের

স্টাফ রিপোর্টার: স্টেডিয়ামের ঘড়িতে তখন দেড়টা পেরিয়েছে কেবল। আসলেই কি পার হলো? জোড়ালো আবেদন, আম্পায়ারের আঙুল, আবেদন থেকেই দুহাত ছড়িয়ে তাইজুলের উল্লাস, বাকিদের বাঁধনহারা উচ্ছ্বাস, ওই মুহূতর্টায় কী থমকে গেলো না সময়? জয়, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম টেস্ট জয়! টেস্টে খেলুড়ে দেশগুলোর মধ্যে এতোদিন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে কোনো জয় ছিলো না বাংলাদেশের। অবশেষে সেই অধরা লক্ষ্যে পৌঁছে গেলো সাকিব-তামিম-মুশফিকরা। একই সাথে লেখা হলো নতুন ইতিহাস। কিন্তু কে বলবে এই ম্যাচটা এভাবেই জিতে যাবে টাইগাররা। না হলে কেনো এতো রং বদলাবে মিরপুর টেস্ট। এক সময়ের প্রবল পরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়া, টেস্টের জগতে অভিজাত অস্ট্রেলিয়া, ১১ বছর পর বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট খেলা অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দিলো বাংলাদেশ। ২০ রানের রোমাঞ্চকর ও মহাকাব্যিক জয়ে স্মরণীয় হয়ে রইলো মিরপুর টেস্ট।

তাইজুল যখন পেলেন শেষ উইকেট, মিড উইকেটে তখন বেশ কাছেই সাকিব আল হাসান। ছুটে আসলেন বোলারের দিকে। তাইজুল লাফ দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন তাকে। অসাধারণ এই জয়ের নায়ক তো বাংলাদেশের সুপারম্যানই!

প্রথম ইনিংসে ব্যাট হাতে ৮৪ রান। দুই ইনিংসেই ৫টি করে উইকেট। চতুর্থ দিনে যখন হাত থেকে ফসকে যাচ্ছে জয়, তখনই আবির্ভাব ত্রাতা হয়ে। জাদুকরী পারফরম্যান্সে সাকিব রাঙালেন নিজের ৫০তম টেস্ট।

সাকিবের পাশাপাশি তামিমেরও এটি ছিলো ৫০তম টেস্ট। মুশফিকুর রহিম টেস্টের আগে বলেছিলেন, এই দুই নায়কের জন্যই খেলবে বাংলাদেশ। কিন্তু সতীর্থদের উপহার দিলেন তারা দুজনই, উপহার দিলেন দেশকেও। সাকিবের অসাধারণ অলরাউন্ড পারফরম্যান্স, ব্যাটিং দূরূহ উইকেটে তামিমের ৭১ ও ৭৮!

গত বছর এই শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামেই ইংল্যান্ডকে ১০৮ রানে হারিয়েছিলো বাংলাদেশ। এরপর গত মার্চে শ্রীলঙ্কায় হারিয়েছিলো শ্রীলঙ্কাকে। টেস্টে এগিয়ে যাওয়ার পালায় যোগ হলো আরেকটি পালক। চতুর্থ দিনে অস্ট্রেলিয়ার প্রয়োজন ছিলো ১৫৬ রান, বাংলাদেশের ৮ উইকেট। সকালে শুরুটা ছিলো বাংলাদেশের জন্য হতাশার। প্রথম ৫০ মিনিটে পড়েনি উইকেট, এসেছে রান। ওয়ার্নার করে ফেলেন উপমহাদেশে তার প্রথম সেঞ্চুরি।

উপমহাদেশে আগের ১১ টেস্টে ওয়ার্নারের গড় ছিলো ২৫.০৪। চারটি পঞ্চাশে সর্বোচ্চ ছিলো ৭১। এবারের সেঞ্চুরি হয়তো তাকে দেবে স্বস্তি। তবে দলকে জেতানোর তৃপ্তি পেলেন না। ওয়ার্নারের ব্যাটে ম্যাচ যখন বেরিয়ে যাওয়ার পথে, বাংলাদেশকে ফেরালেন সেই সাকিব।

আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ে তাইজুল-মিরাজকে চাপে ফেলে দিয়েছিলেন ওয়ার্নার। সাকিব এসে শুরুতে বাধ দেন রানের গতিতে। এরপর দারুণ এক ডেলিভারিতে ফিরিয়ে দেন ওয়ার্নারকে। কঠিন উইকেটেও ওয়ার্নারের ব্যাটে ছিলো নিজস্ব গতি। করেছেন ১৩৫ বলে ১১২। স্মিথের সাথে তৃতীয় উইকেট জুটি ১৩০ রানের। সেই জুটি ভাঙার রেশ মিইয়ে যাওয়ার আগেই সাকিবের হাত ধরে আরও খুশির ছটা। এবার ফিরিয়ে দিলেন অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক স্মিথকে।সাকিবে উজ্জীবিত তাইজুল ততক্ষণে শুরু করেছেন দারুণ বোলিং। পেলেন সেটির পুরস্কারও। যদিও উইকেটে নিজের ভাগ দাবি করতে পারেন সৌম্য সরকার! স্লিপে দুই বারের চেষ্টায় দারুণ রিফ্লেক্স ক্যাচে ফেরালেন পিটার হ্যান্ডসকমকে। হ্যান্ডসকমের উইকেটেই টেস্টে ৫০ উইকেট পূর্ণ হলো তাইজুলের। তার সৌজন্যে খানিক পর ত্বরিত বিদায় প্রথম ইনিংসে ভোগানো অ্যাশটন অ্যাগারও। বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে তখন গ্লেন মাক্সওয়েল। তার জন্য সাকিব আছেন না! লাঞ্চের পর প্রথম বলেই বোল্ড ম্যাক্সওয়েল। ম্যাচে দ্বিতীয়বার ৫ উইকেট। এক ম্যাচে ১০ উইকেটও নিলেন দ্বিতীয়বার। বাংলাদেশে আর কারও নেই একবারের বেশি। এরপর শুধু শেষের অপেক্ষা। তবু যেনো হতে চায় না শেষ। লেজের দিকে লড়াই করলেন প্যাট কামিন্স ও ন্যাথান লায়ন। তবে তাতে বাংলাদেশের জয়ের অপেক্ষাটাই কেবল দীর্ঘায়িত হয়েছে একটু। আর বেড়েছে জয়ের মাহাত্ম্যও। শেষ পর্যন্ত এরকম রোমাঞ্চের দোলায় দুলিয়ে এলো বলেই হয়ত জয়টি হয়ে থাকবে আরও স্মরণীয়!

সংক্ষিপ্ত স্কোর: বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: ২৬০, অস্ট্রেলিয়া ১ম ইনিংস: ২১৭, বাংলাদেশ ২য় ইনিংস: ২২১,

অস্ট্রেলিয়া ২য় ইনিংস: (লক্ষ্য ২৬৫, আগের দিন ১০৯/২) ৭০.৫ ওভারে ২৪৪ (ওয়ার্নার ১১২, রেনশ ৫, খাওয়াজা ১, স্মিথ ৩৭, হ্যান্ডসকম ১৫, ম্যাক্সওয়েল ১৪, ওয়েড ৪, অ্যাগার ২, কামিন্স ৩৩*, লায়ন ১২, হেইজেলউড ০; মিরাজ ২/৮০, নাসির ০/২, সাকিব ৫/৮৫, তাইজুল ৩/৬০, মুস্তাফিজ ০/৮), ম্যাচসেরা: সাকিব আল হাসান।

টেস্ট র‌্যাংকিংয়ে আটে বাংলাদেশ: বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া টেস্ট সিরিজের প্রথম ম্যাচে জয় পাওয়ায় র‍্যাংকিংয়ে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। টেস্ট র‍্যাংকিংয়ে আট নম্বরে উঠে এসেছে টাইগাররা। বুধবার ক্যাঙ্গারু বধের আগ পর্যন্ত অবশ্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের টেস্ট র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিলো ৯। রেটিং পয়েন্ট ছিলো ৬৯। অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান ছিলো ৪। রেটিং পয়েন্ট ছিলো ১০০। টেস্ট র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের উপরে ছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ৮ নম্বরে থাকা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে পেছনে ফেলে সে স্থান দখল করেছে বাংলাদেশ।সদ্য শেষ হওয়া এ সিরিজে বাংলাদেশ জিতলে র‌্যাংকিংয়ে এগিয়ে যাবে সেটি অবশ্য আগেই এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছিল ক্রিকেট নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি।

মুশফিক-সাকিবদের ৬ কোটি টাকা পুরস্কার: সাকিব-মুশফিকদের ৬ কোটি টাকার পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথমবারের মতো টেস্ট জয়ের পর বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান এই আর্থিক পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। এই ছয় কোটি টাকার মধ্যে অস্ট্রেলিয়াকে প্রথমবারের মতো টেস্টে হারানোয় দেয়া হবে ২ কোটি টাকা। আর গত জুনে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনালে ওঠায় আইসিসি থেকে চার কোটি টাকা পেয়েছে বিসিবি। সেই টাকাও একইসাথে দেয়া হবে দলকে। ১৪ ক্রিকেটার ছাড়াও দলের কোচিং স্টাফরাও পাবেন পুরস্কারের অংশ। মোট ৬ কোটি টাকার পুরস্কার দ্রুতই খেলোয়াড়দের হাতে তুলে দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন বিসিবি সভাপতি।

দ্বিতীয় টেস্টের বাংলাদেশ দল ঘোষণা: চট্টগ্রামে দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টের জন্য ১৪ সদস্যের অপরিবর্তিত দল ঘোষণা করা হয়েছে। প্রথম টেস্টে দলের সদস্যরা ভালো করায় তাদের ওপর আস্থা রেখে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার অস্ট্রেলিয়ার সাথে বাংলাদেশ দলের জয়ের কিছু সময় পরই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) এ সিদ্ধান্তের কথা জানায় মোসাদ্দেক হোসেনের চোখের সমস্যায় দলে ফেরা মুমিনুল হক জায়গা ধরে রেখেছেন। সোমবার জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে শুরু হবে দ্বিতীয় ও শেষ টেস্ট। ঢাকায় ২০ রানে জিতে সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ।

দ্বিতীয় টেস্টের বাংলাদেশ দল: মুশফিকুর রহিম (অধিনায়ক ও উইকেটরক্ষক), তামিম ইকবাল (সহঅধিনায়ক), সৌম্য সরকার, ইমরুল কায়েস, সাকিব আল হাসান, নাসির হোসেন, সাব্বির রহমান, মেহেদী হাসান মিরাজ, শফিউল ইসলাম, তাইজুল ইসলাম, মুস্তাফিজুর রহমান, মুমিনুল হক, লিটন দাস, তাসকিন আহমেদ।