অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য দেশে হস্তক্ষেপ বন্ধে খসড়া প্রস্তাব পাস

বাংলাদেশে চলমান ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের সম্মেলনে সংশ্লিষ্ট স্ট্যান্ডিং কমিটিতে অনুমোদন

স্টাফ রিপোর্টার: কোনো সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য কোনো দেশের হস্তক্ষেপ চলবে না। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে চলমান ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) সম্মেলনের চতুর্থ দিনে গতকাল মঙ্গলবার এ সংক্রান্ত খসড়া প্রস্তাবটি সংশ্লিষ্ট স্ট্যান্ডিং কমিটিতে অনুমোদন পেয়েছে। আজ বুধবার সম্মেলনের শেষ দিনে আইপিইউর মূল কমিটিতে পাস বা অনুমোদনের পর ঢাকা ডিক্লিয়ারেশনে অন্তর্ভুক্ত হবে। এছাড়া আরো ৪টি প্রস্তাবের খসড়া গতকাল সংশ্লিষ্ট স্ট্যান্ডিং কমিটিগুলোতে অনুমোদন পেয়েছে বলে জানা গেছে।

আইপিইউ সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য কোনো দেশের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে গতকালের সম্মেলনে স্ট্যান্ডিং কমিটিতে উত্থাপিত প্রস্তাবটি ৪৪-১০ ভোটে গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে আইপিইউভুক্ত দেশের আইন প্রণেতাদের বেশির ভাগ সদস্য অঙ্গীকার করেছেন অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করবেন না। বিশেষ কোনো কারণে যদি প্রয়োজনও হয় তাহলে জাতিসংঘের আইন অনুযায়ী করার ওপর মত দেন এসব আইন প্রণেতা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গতকাল শান্তি ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ক আইপিইউর স্ট্যান্ডিং কমিটির সভায় দিনভর এ খসড়া প্রস্তাবের পক্ষে বিপক্ষে তীব্র বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। পরে ভোটাভুটিতে পাস হলে বিষয়টির ওপর খসড়া প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এ সময় কমিটিতে সভাপতিত্ব করছিলেন মেক্সিকোর প্রতিনিধি দলের প্রধান লোরা রোজাস। স্ট্যান্ডিং কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাবটি আজ বুধবার এক্সিকিউটিভ কমিটিতে যাবে। ১৭ সদস্যের ওই এক্সিকিউটিভ কমিটির সভাপতি আইপিইউ প্রেসিডেন্ট সাবের হোসেন চৌধুরী। এছাড়া ৬ জন ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ১০ জন সদস্য রয়েছেন এক্সিকিউটিভ কমিটিতে। সেখানেই চূড়ান্ত হবে প্রস্তাবটি। অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বন্ধে আনীত এই খসড়া প্রস্তাবটির ওপর গত দুই দিন বিভিন্ন দেশের এমপিরা তাদের মতামত তুলে ধরেন। আলোচনা শেষে স্ট্যান্ডিং কমিটিতে গ্রহণের আগে ভোট অনুষ্ঠিত হয়। সেই ভোটে বাংলাদেশ, ভারতসহ ৪৪টি দেশ পক্ষে মত দেয়। অন্যদিকে ১০টি দেশ জার্মানি, যুক্তরাজ্য, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, কানাডা, তুরস্ক, আইসল্যান্ড, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড এবং ইউক্রেন এই প্রস্তাব সরাসরি বাতিলের পক্ষে মত দেয়। আর বেলজিয়াম ভোট দান থেকে বিরত থাকে। বিপক্ষে ভোট দেয়া দেশ ফিনল্যান্ডের প্রতিনিধি বলেন, প্রস্তাবটি আমরা ঠিকমতো বুঝতে পারিনি। যে কারণে আমি মনে করি অনেক দেশের প্রতিনিধিই এই প্রস্তাব বুঝতে না পেরে ভোট দেয়নি।

বাংলাদেশ ডেলিগেশন টিমের প্রধান ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট মো. ফজলে রাব্বী মিয়া বলেন, এটা সত্য কোনো দেশই অন্য দেশের ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। এটা করাও উচিত না। আইপিইউ যদি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, তাহলে আমি মনে করি কিছুটা হলেও ওইসব মোড়ল দেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যাবে। প্রস্তাবটি গ্রহণ করায় চায়নার প্রতিনিধি সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, আমরা খুব খুশি যে প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হয়েছে। এটা গণতন্ত্রের জন্য ভালো। ভোট প্রদানের পর বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য মঈনুদ্দিন খান বাদল বলেন, আমরা কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে না খোঁচাই না। এই সম্মেলনে আমরা বলতে চাই সব শেষে গণতন্ত্রকে সমর্থন দিতে হবে।

উল্লেখ্য, রোববার কমিটির বৈঠকে বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি খসড়া প্রস্তাবে একটি সংযোজনী আনার প্রস্তাব করে বলেন, বর্তমানে অনেক দেশ এনজিওর মাধ্যমে অন্য দেশে নাক গলানোর চেষ্টা করে। এটি বন্ধ করতে হবে। প্রতিটি দেশের নিজস্ব স্বাধীনতা রয়েছে। প্রতিটি দেশের অধিকার আছে নিজেকে শাসন করার এবং কীভাবে উন্নয়ন করবে সেটি ঠিক করার। তবে অনেক দেশ মনে করে তারা ইরাক বা সিরিয়াতে নাক গলানোর অধিকার রাখে এবং এর ফলে সে দেশে সন্ত্রাসী গ্রুপ সৃষ্টি হচ্ছে।’ তিনি বলেন, প্রায় এক বছর আলোচনার পর এ রেজ্যুলেশনের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। কিন্তু বেশ কয়েকটি দেশ এ খসড়ার বিরোধিতা করেছে। তারা এটিকে বাতিল করার প্রস্তাব করেছে। পরে এনজিও বিষয়টি বাতিল হয়ে যায়। এ খসড়া প্রস্তাব সমর্থন করে চীন বলে, বিদেশি শক্তি এবং এর প্রভাব গ্রহণযোগ্য নয়। ২০০৩ সালে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের অজুহাত দেখিয়ে একটি দেশ ইরাক আক্রমণ করেছিল কিন্তু পরে দেখা গেছে সেখানে এ ধরনের কোনো অস্ত্র নেই। রাশিয়া এ খসড়া সমর্থন করে জানিয়েছে, এটি বাতিল করা হলে সারা বিশ্বে একটি ভুল বার্তা যাবে। ভারতও এ রেজ্যুলেশন সমর্থন করে বলে জানায় বৈঠক সংশ্লিষ্ট সূত্র।

গতকাল পাস হওয়া আরো একটা প্রস্তাব: ইয়েমেন, দক্ষিণ সুদান, সোমালিয়া ও উত্তর কেনিয়ার তীব্র খরার কবলে পড়া দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সাহায্যে দ্রুত এগিয়ে আসার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আইপিইউর স্ট্যান্ডিং কমিটি পাস করে। এর আগে গত রোববার সম্মেলনের সাধারণ আলোচনায় প্রস্তাবটি ভোটে গ্রহণ করা হয়। পরদিন সোমবার এর ওপর আলোচনাও হয়। রোববার বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য ও কেনিয়ার প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে প্রস্তাবটি আইপিইউ অধিবেশনে তোলা হয়। তবে মেক্সিকোর দেয়া ‘বিশ্বজুড়ে কঠোর অভিবাসন নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঝুঁকি’ এবং আরব গ্রুপের পক্ষে ফিলিস্তিনের দেয়া ‘বসতি স্থাপন প্রক্রিয়াকে ইসরাইলের আইনি বৈধতা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন’ শীর্ষক দুটি প্রস্তাব ভোটে নাকচ হয়ে যায় সেদিন। দুর্ভিক্ষ নিয়ে প্রস্তাবে বলা হয়- ইয়েমেন, দক্ষিণ সুদান, সোমালিয়া ও উত্তর কেনিয়ায় চলমান দুর্ভিক্ষ চরম মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। ১০ মার্চ জাতিসংঘও এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সতর্ক করে দিয়েছে। এছাড়া বৈশ্বিক জঙ্গিবাদ রোধ ও বৈষম্য নিরসন বিষয়ে আরো দুটি প্রস্তাব স্টিয়ারিং কমিটি গ্রহণ ও অনুমোদনের জন্য ড্রাফট করেছে বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, এবারের আইপিইউ সম্মেলন খুবই ফলপ্রসূ হচ্ছে। তিনি জানান, কোনো সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বাইরের হস্তক্ষেপ বন্ধে একটি প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটিতে প্রস্তাবটি পাস হয়েছে। এটি আজ বুধবার আইপিইউর সাধারণ অধিবেশনে পাস হবে। এছাড়া জঙ্গিবাদ নিয়ে এবারে সরব হয়েছে আইপিইউ সম্মেলন। তরুণ পার্লামেন্টরিয়াদের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। গণতন্ত্র, সুশাসন, বৈষম্য দূরীকরণ ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। মোট কথা এবারের আইপিইউ সম্মেলন খুবই কার্যকরী হবে এবং আমরা একটি কার্যকরী ‘ঢাকা ডিক্লিয়ারেশন’ পাব আশা করি।

এ বিষয়ে আইপিইউর সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, সম্মেলনের মূল বিষয় ছিলো বিশ্বব্যাপী নানা ধরনের বৈষম্য নিরসনে কার্যকর ভূমিকা পালন করা। আর গত ৪ দিন ধরে আইপিইউর ৪টি কমিটিতে এ বিষয়সহ বেশ কয়েকটি বিষয়ে নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। ইয়েমেন, দক্ষিণ সুদান, সোমালিয়া ও উত্তর কেনিয়ার তীব্র খরার কবলে পড়া দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সাহায্যে দ্রুত এগিয়ে আসার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন। এছাড়া কোনো রাষ্ট্র যাতে অন্য কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে না পারে সে বিষয়ে নির্দিষ্ট কমিটিতে আলোচনা হয়ে প্রস্তাবটির ওপর ড্রাফট করেছে। যা বুধবার মূল কমিটিতে তারা প্রস্তাবাকারে পাঠাবে এবং মূল কমিটি এটির ওপর আলোচনা করে অনুমোদন দেবে। যা ঢাকা ডিক্লিয়ারেশনের অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

তিনি বলেন, আইপিইউমূলত বিশ্বব্যাপী অসমতা দূর করা, জঙ্গিবাদের প্রসার রোধ করা, সুশাসনের অভাব, নানাবিধ বৈষম্যের অবসান করা, মানবাধিকার রক্ষা ও ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত পৃথিবী গড়ার ওপর জোর দিয়েছে। কিভাবে সরকারের সঙ্গে সঙ্গে পার্লামেন্টের সদস্যদের ক্ষমতা বাড়ানো যায় সে বিষয়ে আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি। তিনি বলেন, অনেক সময় আমরা জঙ্গিবাদ, বৈষম্য, দরিদ্রতা নিয়ে আলোচনা করি। এ সম্মেলনে এসবের অন্তর্নিহিত কারণ কি তা বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে। আইপিইউ মনে করে জঙ্গিবাদ সামরিক ব্যবস্থা দিয়ে রোধ করা যাবে না। এটির কারণ খুঁজে এর মূল উৎপাটন করতে হবে। এ নিয়ে আমরা আলোচনা চালাচ্ছি।
সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ইয়েমেন, সিরিয়া, ভেনিজুয়েলার সমস্যা দীর্ঘ দিনের। এ সমস্যা কিভাবে সমাধান করা যায় তা নিয়ে আইপিইউ আলোচনা করেছে। আমরা এসব দেশের সরকারের ক্ষমতার সঙ্গে পার্লামেন্টের সক্ষমতা বাড়াতে কাজ করছি। এসব দেশের সরকার পার্লামেন্টের কথা শুনত না। এখন এর পরিবর্তন আসছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী বৈষম্য ও সুশাসনের অভাবের কারণে জঙ্গিবাদের উত্থান হচ্ছে। আমরা এর মূল উৎপাটন করতে চাই।