অবশেষে এমপি পিনু খানের বিলাসবহুল প্রাডো জিপ গাড়িটি জব্দ

 

রনির আকুতি : মা যেভাবে হোক আমাকে বাঁচাও

স্টাফ রিপোর্টার: অবশেষে জোড়া খুনে ব্যবহৃত সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য পিনু খানের বিলাসবহুল প্রাডো জিপ গাড়িটি মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) জব্দ করেছে। হত্যাকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ আলামত হিসেবে সোমবার সকালে গাড়িটি (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-৬২৩৯) জব্দ করে ডিবি কার্যালয়ে আনা হয়। এছাড়া এ হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স বাতিলের জন্য দু-একদিনের মধ্যে আদালতে আবেদন জানানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

প্রসঙ্গত ১৩ এপ্রিল রাজধানীর নিউ ইস্কাটন এলাকায় পিনু খানের গাড়ি থেকেই এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়েন তার ছেলে বখতিয়ার আলম রনি। এতে মারা যান নিরীহ রিকশাচালক হাকিম ও দৈনিক জনকণ্ঠের সিএনজি অটোরিকশাচালক ইয়াকুব। সংসদ সদস্য পিনু খান মহিলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক। নারী কোটায় সংসদ সদস্য হওয়ার পর তিনি শুল্কমুক্ত সুবিধা নিয়ে এ প্রাডো গাড়ি কেনেন। সরকারি দলের সংসদ সদস্যের ছেলে হওয়ায় প্রথম দফা রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেনি। এ অবস্থায় পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশিত হলে দ্বিতীয় দফা রিমান্ডে আনা হলে মুখ খোলেন রনি।

এদিকে এতোদিন ছেলের পক্ষে সাফাই গাইলেও চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনার আদ্যোপান্ত জানতে গতকাল তিনি প্রয়োজন বোধ করেন। এজন্য সোমবার দুপুরে পিনু খান কারাগারে গিয়ে ছেলের সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে এক কর্মকর্তার কক্ষে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা সবিস্তারে মা ও ছেলের মধ্যে কথা বিনিময় হয়। নির্ভরযোগ্য সূত্র বলেছে, মায়ের অনেক প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ছেলে রনি বেশির ভাগ সময় মাথা নিচু করে থাকেন। এক পর্যায়ে নিজের অপরাধ আড়াল করতে রনি তার মাকে বলেন, ‘সেদিনের ঘটনা তার কিছুই মনে নেই।’ ছেলের এমন জবাব শুনে পিনু খান ক্ষুব্ধ হয়ে ছেলেকে ধমকও দেন।’ এক পর্যায়ে তিনি ছেলেক বলেন, ‘আমি ভাবতেই পারিনি তুমি এতোটা খারাপ হয়ে গেছ। অনেকবার তোমাকে বলেছি, ভালোভাবে চলাফেরা করো। কিন্তু তুমি শোনোনি। আজ তোমার জন্য আমার ভবিষ্যতও শেষ হতে চলেছে। মানসম্মান, রাজনৈতিক ক্যারিয়ার সবকিছুই ধুলায় মিশে গেছে।’ মায়ের এমন ক্ষোভের কথা শোনার পর ছেলে রনি তাকে বাঁচানোর জন্য বারবার মাকে অনুরোধ করেন। একবার বলে ওঠেন, মা যেভাবে হোক আমাকে বাঁচাও। শেষ পর্যন্ত ছেলেকে কারাগারে রেখেই বিষণ্ণ মনে এমপি পিনু খান বেরিয়ে আসেন।

কারাগার থেকে বের হয়ে সংসদ সদস্য পিনু খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগ করি বলেই এ ঘটনা নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে। এজাহারে ছিলো শাদা গাড়ি, কিন্তু জব্দ করা হয়েছে আমার কালো গাড়ি। তিনি সাংবাদিকদের প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে বলেন, এ প্রশ্ন এখন পুলিশকে কে জিজ্ঞেস করবে? এদিকে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক দীপক কুমার দাস জানান, ‘প্রযুক্তিগত তদন্তের মাধ্যমে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তার ভিত্তিতেই তদন্ত এগিয়ে চলছে। ঘটনাস্থলে কালো রঙের প্রাডো গাড়িটিই ছিলো বলে যথেষ্ট প্রমাণ মিলেছে। আর এ গাড়ি থেকেই গুলি করা হয়েছে। এছাড়া ইতমধ্যে গাড়িচালক ইমরান ফকির এ বিষয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। তাই জোড়া খুনের ঘটনায় ব্যবহৃত গুরুত্বপূর্ণ আলামত হিসেবে ওই গাড়িটি জব্দ করা হয়েছে।

তদন্ত কর্মকর্তা আরও বলেন, রনির পিস্তল থেকেই গুলি ছোড়া হয়েছে কিনা ব্যালাস্টিক পরীক্ষা শেষে তা নিশ্চিত হওয়া যাবে। আসলে মামলাটি প্রথমদিকে ছিল একটি ক্লু-লেস ঘটনা। এ ধরনের ঘটনা তদন্তে ডিবি পুলিশ যে প্রযুক্তি ব্যবহার করে, এখানেও তা প্রয়োগ করে আসল তথ্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা চলছে। তবে এখন পর্যন্ত ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কারও আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ডিবি পুলিশের যুগ্মকমিশনার (ক্রাইম) কৃষ্ণপদ রায় জানান, তদন্তে বখতিয়ার আলম রনির লাইসেন্স করা পিস্তলের গুলিতে রিকশাচালক হাকিম ও সিএনজিচালক ইয়াকুব মারা যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। রনির নিজের লাইসেন্স করা সেভেন পয়েন্ট সিক্স ফাইভ বোরের পিস্তল থেকে এসব গুলি ছোড়া হয়েছিল। আর পিস্তলটিতে ব্যবহার হয়েছিলো পয়েন্ট ৩২ বোরের গুলি। অস্ত্রটি এর আগেই জব্দ করে ব্যালাস্টিক পরীক্ষার জন্য সিআইডির ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট পাওয়ার পর শতভাগ নিশ্চিত হয়ে অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিলের জন্য আদালতে আবেদন জানানো হবে।

জানা গেছে, নিহত রিকশাচালক আবদুল হাকিমের মা মনোয়ারা বেগম ঘটনার দুদিন পর রমনা থানায় মামলা করেন। তিনি লোকমুখে শুনে এজাহারে উল্লেখ করেন, ঘটনার রাতে একটি শাদা মাইক্রোবাস থেকে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়া হলে তার ছেলে রিকশাচালক আবদুল হাকিম ও ইয়াকুব আলী নামে একজন অটোরিকশাচালক গুলিবিদ্ধ হন। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ দুজনই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তবে তদন্তে নেমে ডিবি পুলিশ ইস্কাটন ও মগবাজার এলাকার সিসি টিভির ভিডিও ফুটেজ থেকে দেখতে পায় ঘটনার সময় সাদা মাইক্রোবাস নয়, কালো রঙের একটি প্রাডো সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করছে। পরে পুলিশ ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা থেকে ওই গাড়িটির নম্বর সংগ্রহ করে বিআরটিএ থেকে মালিকানা যাচাই করে। পুলিশ জানতে পারে, গাড়িটির মালিক সংরক্ষিত-২৩ আসনের মহিলা সংসদ সদস্য পিনু খান। পরে প্রযুক্তির মাধ্যমে গাড়ির চালক ইমরান ফকিরকে শনাক্ত করা হয়। ৩১ মে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং এক পর্যায়ে সে গোয়েন্দা পুলিশকে জানায়, ঘটনার রাতে সংসদ সদস্যের ছেলে বখতিয়ার আলম রনি ও তার তিন বন্ধু ওই গাড়িতে ছিলেন।

ওই সময় রাস্তায় তীব্র যানজট ছিলো। কিন্তু যানজটে ক্ষুব্ধ হয়ে রনি সাহেব নিজের পিস্তল দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করেন। এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়ার পর গোয়েন্দা পুলিশ ওই রাতেই রনিকে গ্রেফতার করে। এরপর ঘটনার আসল রহস্য ও সত্যতা বেরিয়ে আসে। এদিকে সোমবার ডিবির যুগ্মকমিশনার মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাদী মামলা করার আগে আশপাশের লোকজনের মুখে শুনে শাদা মাইক্রোবাসের কথা উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু পরে পুলিশ প্রযুক্তিগত তদন্তের মাধ্যমে খুনের ঘটনায় ব্যবহৃত কালো প্রাডো গাড়িটি শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। এছাড়া গাড়িচালক ইমরান আদালতে নিজের দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, প্রাডো গাড়ি থেকে রনিই গুলি করেছিলেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুলিশ কোনো ধরনের চাপে থেকে কাজ করছে না। পুলিশই এ ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করেছে।