অবরোধ : হিলিতে পেট্রোল বোমায় ট্রাকচালকসহ দুজন অঙ্গার

চুয়াডাঙ্গার সড়কে আগুন : মেহেরপুরে পুলিশের হাতে গ্রেফতার ১ : ছাড়েনি সবজির ট্রাকও 

 

স্টাফ রিপোর্টার: বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের ডাকা অনির্দিষ্টকালের অবরোধের তৃতীয় দিন গতকাল শুক্রবার দুর্বৃত্তদের পেট্রোল বোমায় হিলিতে দুজন নিহত হয়েছেন। চুয়াডাঙ্গায় গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় সড়কের তিনটি স্থানে পাউডার ও পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরায় অবরোধকারীরা। চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপির একাংশ সমাবেশ করেছে বলে তারা প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে। মেহেরপুরে বাস চলাচল বন্ধ তো রয়েছেই, গতকাল থেকে সবজি নিয়েও কোনো ট্রাক মেহেরপুর ত্যাগ করেনি। পুলিশ একজনকে গ্রেফতার করেছে। ঝিনাইদহের শৈলকুপার একটি ভোটকেন্দ্রসহ বিভিন্ন স্থানে নির্বাচনী অফিসে হামলা, পুলিশের সাথে নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ, ককটেল বিস্ফোরণ, সড়কে আগুন ও গাছ ফেলে যান চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা হয়। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন ১১৯ জন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আটক করে ১৫৯ জনকে।

হিলি স্থলবন্দর থেকে পেঁয়াজ বোঝাই ট্রাক নিয়ে গাইবান্ধা যাওয়ার পথে বাওনা এলাকায় দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রোল বোমায় দগ্ধ হয়ে ট্রাকচালক কাম মালিক নেওয়াজ (৩২) ও পেঁয়াজের মালিক আদিনুর রহমান (৪০) ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এ ঘটনায় সুমন (৩০), শাহজাহান (২২) ও ইউসুফ (৪৫) নামে আরও ৩ জন আহত হয়েছেন। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ট্রাকটি খাদে পড়ে যায়। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নেভায়। ফেনী-৩ নির্বাচনী এলাকার দাগনভূঞায় দুর্বৃত্তরা ৫টি ভোটকেন্দ্রে গান পাউডার দিয়ে আগুন দেয়। এতে ২টি কেন্দ্র সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। এদিকে রাজধানী ঢাকায় যাত্রীবাহী বাসে দুর্বৃত্তদের ছোঁড়া পেট্রোল বোমায় এক নারী যাত্রীসহ তিনজন দগ্ধ হয়েছেন। গতকাল শুক্রবার সকালে পরীবাগ ওভারব্রিজ ও বোরাক টাওয়ারের সামনে এ ঘটনা ঘটে। অগ্নিদগ্ধরা হলেন- বাসচালক বাবুল হাওলাদার (৪০), বাসযাত্রী ফল বিক্রেতা মোহাম্মদ ফরিদ মিয়া (৬০), ইন্স্যুরেন্স কর্মকর্তা শাহিনা বেগম (৩৮)। ফরিদ মিয়া ও শাহিনা বেগমের অবস্থা আশঙ্কাজনক। পুলিশ এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গতকাল কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। রাজধানীর তিন নম্বর রুটের (আব্দুল্লাহপুর-গুলিস্তান) বাসটি গুলিস্তানের দিকে যাচ্ছিলো।

এদিকে গতকাল সন্ধ্যার পর ৭টার দিকে চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের প্রধান সড়ক শহীদ আবুল কাশেম সড়কের সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে সড়কে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। সেখানে পাউডারও ছেটানো হয়। প্রায় একই সময় চুয়াডাঙ্গা ভি.জে স্কুল কোর্টরোডের পুরাতন জেলখানার অদূরবর্তী জেলা পরিষদ ডাকবাংলার সামনে অভিন্ন কৌশলে আগুন জ্বালানো হয়। রাত সাড়ে ১১টার দিকে হাসপাতাল সড়কের রাজধানী ক্লিনিকের অদূরে টায়ারে আগুন জ্বালানোর খবর পেয়ে দ্রুত হাজির হয় পুলিশ।

প্রহসনের নির্বাচন থেকে বিরত থাকতে সাধারণ ভোটারদের প্রতি চুয়াডাঙ্গা জেলা ছাত্রদলের নেতৃবৃন্দ এক প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে আগামী ৫ জানুয়ারি একতরফা পক্ষপাতগ্রস্ত জনমত পরিপন্থি একটি হাস্যকর নির্বাচনের আয়োজন করেছে আওয়ামী লীগ ও তার গুটিকয়েক দোসররা। যে নির্বাচনে ভোটের আগেই ১৫৪ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে বিশ্বরেকর্ড সৃষ্টি করেছে। প্রধান বিরোধীদল ও বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয়তম রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ প্রায় সকল নিবন্ধিত দলও এই অবৈধ প্রহসনের সির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না। বিশ্বের প্রভাবশালী দেশ ও দেশের অভ্যন্তরে সুশীল সমাজ ইতোমধ্যে এ নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করে আয়োজকদের প্রতি ধিক্কার জানিয়েছে। গণতন্ত্রকে বাকরুদ্ধ করে কেবলমাত্র নিজেদের চমর স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর আরেকবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মনোবাসনা পূরণের জন্যই এই ধ্বংসলীলায় মত্ত হয়েছেন। একটি রাজনৈতিক দলের খামখেয়ালি একনায়কতাতান্ত্রিক আচরণে আজ দেশ গভীর সঙ্কটে পতিত। দেশের সাধারণ মানুষ অনিশ্চয়তার প্রহর গুনছে। সরকারিদলের দমন পীড়ন যেকোনো সময়ের মাত্রাকে অতিক্রম করছে। আমরা জানি ভোটাধিকার যেকোনো নাগরিকের অধিকার। কিন্তু একথা প্রণিধানযোগ্য যে ভোট প্রদান করা হয় দেশ ও জাতির স্বার্থ জনগণের কল্যাণে। আজ পরিস্থিতি এমন একটি কঠিন সময়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে যা ভোট প্রদান করা মানে স্বেচ্ছাচারিতা ও স্বৈরাশাসনকে উদ্বুদ্ধ করা। এজনই সাধারণ ভোটারদের প্রতি ছাত্রদল চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার পক্ষ থেকে বিশেষ অনুরোধ, আপনার মূল্যবান ভোট প্রদান করে দেশ ধ্বংসকারী খলনায়কদের সহযোগী হয়ে ইতিহাসের কালো পাতায় প্রবেশ করবেন না। তাই আমাদের আবেদন, আগামী ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের প্রহসনকে না বলুন, দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করুন। সেই সাথে নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য ৪৮ ঘণ্টার হরতাল পালনের আহ্বান জানানো হয়েছে। বিবৃতি প্রদান করেন জেলা ছাত্রদল আহ্বায়ক শরিফ-উর-জামান সিজার, সিনিয়র যুগ্মআহ্বায়ক এমএ তালহা, যুগ্মআহ্বায়ক মুঞ্জুরুল জাহিদ, রাজিব খান, সোহেল আহম্মেদ মালিক সুজন, মোমিনুর রহমান মোমিন, খ ম ইউসুফ, জেডএম তৌফিক খান প্রমুখ।

বিরোধীদলীয় নেতা ১৮ দলীয় জোট নেত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দি করে রাখার প্রতিবাদে ও ৫ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচন বন্ধের দাবিতে কেন্দ্রঘোষিত অবরোধের পাশপাশি দেশব্যাপি ৪৮ ঘণ্টার হরতালের সমর্থনে চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপির বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ সন্ধ্যা ৭ ঘটিকায় চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপি একাংশের কেদারগঞ্জস্থ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক মাহমুদুল হক পল্টু। বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন- জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রউফুন নাহার রিনা। বিশেষ অতিথি ছিলেন- জেলা বিএনপির দফতর সম্পাদক আবু আলা সামসুজ্জামান, জেলা স্বেচ্ছাসেবকদলের আহ্বায়ক হাজি আব্দুল মান্নান, জেলা ছাত্রদলের যুগ্মআহ্বায়ক শাহজাহান খান প্রমুখ। নেতৃবৃন্দ অবরোধের পাশাপাশি ৪৮ ঘণ্টার শান্তিপূর্ণ অবিরাম হরতাল পালন করার জন্য জেলাবাসীকে আহ্বান জানান। এক প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

অপরদিকে বিকেল ৩টার দিকে জেলা বিএনপির অর্থবিষয়ক সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম সমর্থিতরা হরতালের সমর্থনে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। সভাপতিত্ব করেন জেলা বিএনপি নেতা আইনুর হোসেন পচা। প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা মৎস্যজীবীদলের সভাপতি আবু বক্কর সিদ্দিক বকুল। বিশেষ অতিথি ছিলেন- জেলা বিএনপির সহসভাপতি আরশেদ আলী কালু, মৎস্যজীবীদলের সাধারণ সম্পাদক ওহিদুল ইসলাম ওহিদ, কৃষকদলের সভাপতি হামিদুল হক নেতাজী প্রমুখ।

মেহেরপুর অফিস জানিয়েছে, ৬ষ্ঠ দফায় ১৮ দলীয় জোটের ডাকা অনির্দিষ্টকালের অবরোধের তৃতীয় দিনে গতকাল শুক্রবার মেহেরপুর থেকে দূরপাল্লার ও আন্তঃজেলা বাস চলাচল বন্ধ ছিলো। তবে ছোট ছোট যানবাহন চলাচল করতে দেখা গেছে। তবে রাতের বেলা সবজি বোঝাই ট্রাক রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার উদ্দেশে ছেড়ে যেতে দেখা গেছে।

এদিকে দিনরাত অব্যাহত রয়েছে গ্রেফতার অভিযান। গত বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে মেহেরপুর সদর উপজেলার কুলবাড়িয়া গ্রামে নিজ বাড়ি থেকে জামায়াতকর্মী ইবাদত হোসেনকে (৪৭) গ্রেফতার করেছে সদর থানা পুলিশ। হরতাল-অবরোধে সড়কের ধারে সরকারি গাছ কাটা ও সরকারি কাজে বাধা দেয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগে সদর থানা পুলিশের দায়ের করা মামলার আসামি হিসেবে তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। গতকাল শুক্রবার আদালতের মাধ্যমে তাকে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে বলে জানালেন সদর থানার ওসি রিয়াজুল ইসলাম।

এদিকে বিগত অবরোধগুলোতে জোটের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন সড়কে অবরোধসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করলেও এবারের অবরোধে তারা মাঠে নেই। যৌথবাহিনীর অভিযানে গ্রেফতারের ভয়ে নেতাকর্মীরা আত্মগোপন করেছে বলে জানালেন জোটের কয়েকজন নেতাকর্মী। এদিকে অবরোধের কারণে জেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও সড়কগুলোতে আইনশৃঙ্খলারক্ষা বাহিনীর বিপুল পরিমাণ সদস্য টহলে রয়েছেন।

অপরদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেজা জিয়াকে গৃহবন্দি করায় মেহেরপুরে আজ শনিবার সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দিয়েছে ১৮ দল। বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মেহেরপুর-১ আসনের সাবেক এমপি মাসুদ অরুন গতকাল শুক্রবার দুপুর ২টার দিকে এক প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, বেগম খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দি করে রেখেছে সরকার।

ঝিনাইদহ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, আজ শনিবার ঝিনাইদহ জেলায় সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দিয়েছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। গত কয়েক দিন ধরে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করে রাখার প্রতিবাদ ও পাতানো নির্বাচন বন্ধের দাবিতে এ হরতাল আহ্বান করা হয়।

ঝিনাইদহ জেলা বিএনপি কার্যালয়ে জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সভায় জেলা বিএনপির সভাপতি মসিউর রহমান, সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক, বিএনপি নেতা এমএ মজিদ, জাহিদুজ্জামান মনা, মুন্সি কামাল আজাদ পান্নু উপস্থিত ছিলেন। জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক অ্যাডভোকেট এমএ মজিদ হরতালের আহ্বানের খবর নিশ্চিত করে বলেন, আজ শনিবার ঝিনাইদহ জেলার ৬ উপজেলায় ১৮ দলের আহ্বানে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালিত হবে। বিএনপি চেয়ারপারসনকে বাসভবনে অবরুদ্ধ করে রাখা ও পাতানো নির্বাচন বন্ধের দাবিতে হরতালের ডাক দেয়া হয়েছে। এদিকে শুক্রবার বিকেলে জেলা শহরসহ উপজেলা পর্যায়ে হরতালের সমর্থনে মিছিল করেছে ১৮ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা।