অপেক্ষা শুধু পূর্ণাঙ্গ রায়ের

 

স্টাফ রিপোর্টার: সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত রায়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকায় জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী ও জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকরের পরবর্তী প্রক্রিয়া শুরু করতে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি পাওয়া গেলে দণ্ড কার্যকরের পরবর্তী প্রক্রিয়া শুরু করবে রাষ্ট্রপক্ষ। অন্যদিকে এ রায়ের রিভিউ আবেদন করতে গেলে আসামি পক্ষেরও রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রয়োজন।
রায়ের অনুলিপি হাতে পাওয়ার পর আসামি রায় পর্যালোচনার আবেদন (রিভিউ) করতে পারবেন। তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষারও সুযোগ পাবেন। দুটোই নাকচ হয়ে গেলে সরকার দণ্ড কার্যকরের ব্যবস্থা নেবে। এক্ষেত্রে চার যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের কাদের মোল্লা, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ এবং বিএনপির সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায় বাস্তবায়নের আগে পালিত প্রক্রিয়াগুলো দৃষ্টান্ত হিসেবে থাকছে।

রায় কার্যকরের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আগেই বলেছেন, কাদের মোল্লার রিভিউ পিটিশনের রায়ে বলা হয়, পূর্ণাঙ্গ রায়ের প্রত্যায়িত অনুলিপি প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে আসামি রিভিউ চাইতে পারবেন। তিনি বলেন, অপেক্ষা করব এই ১৫ দিনের জন্য। তারা যদি রিভিউ পিটিশন দাখিল না করে, তাহলে আমরা এই রায় কার্যকর করার ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
আসামির প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেনও বলেন, আমরা পূর্ণাঙ্গ অনুলিপির জন্য অপেক্ষা করছি। পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি হাতে পেলে এবং রিভিউয়ের উপাদান পাওয়া গেলে রিভিউ পিটিশন করা হবে। সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে, নিজামীর ফাঁসির দণ্ড বহাল রেখে দেয়া আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় মার্চ মাসেই প্রকাশ হতে পারে। রায় প্রকাশের পর রিভিউ করার জন্য ১৫ দিন সময় পাবেন নিজামী। রিভিউ নিষ্পত্তি হওয়ার পর রায় কার্যকর করতে পারবে সরকার। তবে দণ্ড কার্যকরের আগে জামায়াতের এই নেতা শেষ সুযোগ হিসেবে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার সময় পাবেন। রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা নাকচ হলে বা তিনি প্রাণভিক্ষা না চাইলে সরকার দণ্ড কার্যকরের ব্যবস্থা নেবে।
এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, রিভিউ শুনানির পর কারো ফাঁসি বা মৃত্যুদণ্ড কমেছে, আমার জানা নেই। ইতিহাসে এমন নজির আছে বলেও আমার জানা নেই। সে ক্ষেত্রে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাবেক মন্ত্রী জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীকে ফাঁসির দড়িতেই ঝুলতে হবে। অপরদিকে, জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীর ফাঁসির দণ্ড বহাল রেখে গত ৮ মার্চ চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেছেন আপিল বিভাগ। সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ে মীর কাসেমের ফাঁসির আদেশ বহাল থাকায় দণ্ড কার্যকরে রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপির জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় চূড়ান্ত দণ্ড বহাল রেখে আপিল বিভাগের রায় প্রকাশের সময়সীমা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসি কার্যকর হওয়া প্রথম ব্যক্তি জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের রায় ২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ঘোষণা করেন আপিল বিভাগ। রায় ঘোষণার ২ মাস ১৭ দিন পর একই বছরের ৫ ডিসেম্বর ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করে আপিল বিভাগ। সব প্রক্রিয়া শেষে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ২০১৪ সালের ৩ নভেম্বর আপিল বিভাগ কামারুজ্জামানের মামলা নিষ্পত্তি করে ট্রাইব্যুনালের দেয়া ফাঁসির রায় বহাল রাখেন। আপিল বিভাগের রায় ঘোষণার সাড়ে ৩ মাস পর ২০১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদ- বহাল রাখা রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করেন।
৫ মার্চ কামারুজ্জামান রিভিউ আবেদন করলে ৬ এপ্রিল আপিল বিভাগ তা খারিজ করে দেন। রিভিউ আবেদন খারিজের পর কামারুজ্জামান রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা না চাওয়ায় ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল রাত ১০টার পর দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে এই জামায়াত নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে জেল কর্তৃপক্ষ।
২০১৫ সালের ১৬ জুন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে ট্রাইব্যুনালের দেয়া ফাঁসির রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। রায় ঘোষণার সাড়ে ৩ মাস পর একই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর মুজাহিদের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। আর বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে আপিলের রায় ঘোষণা করা হয় ২০১৫ সালের ২৯ জুলাই। ২ মাসের ব্যবধানে ৩০ সেপ্টেম্বর সাকা চৌধুরীর আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। মুজাহিদের রায় প্রকাশের একই দিনে সাকা চৌধুরীর রায়ও প্রকাশ হয়।
এরপর এই দুজন ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করেন। শুনানি শেষে আপিল বিভাগ তা খারিজ করে দিলে গত বছরের ২১ নভেম্বর রাতে তাদের দণ্ড কার্যকর করা হয়। পর্যালোচনায় দেখা যায়, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাগুলোর ক্ষেত্রে আপিলের রায় ঘোষণার পর থেকে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করতে আড়াই থেকে সাড়ে তিন মাস সময় লেগেছে। ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত ৫ম ব্যক্তি হিসেবে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী ও ৬ষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে মীর কাসেমের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।
গত ৬ জানুয়ারি নিজামীর ফাঁসির দণ্ড বহাল রেখে রায় ঘোষণা করেন আপিল বিভাগ। সে হিসাবে দুই মাস পেরিয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আগামী এপ্রিল মাসে শুরু হতে যাওয়া সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন ছুটির আগেই নিজামীর ফাঁসির পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হতে পারে। এর আগে আপিল বিভাগে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ছয়টি রায়ের মধ্যে চারটিতে জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, দলটির সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি হয়েছে। আপিল বিভাগের আরেক রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। তবে সেই রায়ের রিভিউ এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। অপরদিকে আপিল বিভাগের রায়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। এ ছাড়া শুনানি চলাকালে জামায়াতের আমির গোলাম আযম ও বিএনপির প্রাক্তন মন্ত্রী আবদুল আলীমের মৃত্যু হওয়ায় তাদের আপিলের নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। ফাঁসি কাশিমপুরেই চান মীর কাসেম গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর সাথে দেখা করেছেন তার স্ত্রী ও পরিবারের লোকজন। শনিবার এই সাক্ষাতের পর তার ছোট ছেলে মীর আহমদ বিন কাসেম জানান, তার বাবা জেল কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করেছেন, তাকে ফাঁসি দেয়া হলে যেন কাশিমপুর কারাগারেই দেয়া হয়। প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ গত ৮ মার্চ মীর কাসেমকে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেয়া সাজা বহাল রেখে রায়ের সংক্ষিপ্তসার জানিয়ে দেয়। জামায়াত আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের পর মীর কাসেম ছিলেন আলবদর বাহিনীর তৃতীয় প্রধান ব্যক্তি। তার জোগানো অর্থেই স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী শক্ত ভিত্তি পায়। কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২-এর সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক বলেন, শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মীর কাসেম আলীর স্ত্রী খন্দকার আয়শা খাতুন, ছেলে মীর আহমদ বিন কাসেম, মেয়ে সুমাইয়া রাবেয়া, পুত্রবধূ তাহমিনা আক্তার ও সায়েদা তাহমিদা আক্তার, ভাতিজি আফরোজা জয়নবজসহ সাতজন তার সঙ্গে দেখা করতে কারাগারে আসেন। প্রায় আধাঘণ্টা তারা কারাগারের একটি কক্ষে তার সঙ্গে কথা বলেন। প্রতি মাসে একবার মীর কাসেমের পরিবারের লোকজন আসেন। এবার ফাঁসির রায় বহালের আদেশের পর শনিবারই প্রথম পরিবারের ওই সদস্যরা মীর কাসেম আলীর সঙ্গে দেখা করলেন। মীর কাসেমের ছোট ছেলে মীর আহমদ বলেন, ফাঁসির রায় বহালের ব্যাপারে তার বাবা বলেছেন, তার প্রতি অবিচার করা হয়েছে। আমরা পূর্ণাঙ্গ রায়ের কপি পাওয়ার পরই ন্যায়বিচার চেয়ে আদালতে রিভিউ আবেদন করব। দেখা করার সময় তিনি সুস্থ ও প্রফুল্ল ছিলেন। আপিলে মৃত্যুদণ্ডের রায় বহালের সময় বাবা জেল কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করেছেন, সবশেষেও যদি তাকে ফাঁসিই দেয়া হয় তা যেন কাশিমপুর কারাগারেই দেয়া হয়, বলেন মীর আহমদ।